সংশোধন হচ্ছে ‘কোর্ট ফি’ আইন

জমিজমা ক্রয়-বিক্রয়, আইন-আদালত, সম্পত্তি বিক্রি, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে সরকারকে নির্দিষ্ট অঙ্কের কোর্ট ফি দিতে হয়। বর্তমানে এ ফি  দিতে হয় সরকারি মুদ্রণালয়ের (বিজি প্রেস) ছাপানো ফরমের মাধ্যমে। এসব পেতে অনেক সময় গ্রাহকদের গ্রাম থেকে শহরে বা জেলা/উপজেলার নির্দিষ্ট স্থানে যেতে হয়। সব জায়গায় এসব কোর্ট ফি ফরম পাওয়া যায় না। ফলে প্রয়োজনের সময় গ্রাহকদের অনেক দুর্ভোগে পড়তে হয়। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মোবাইল ব্যাংকিংসহ বিভিন্ন ডিজিটাল ব্যবস্থা চালু হয়েছে। তাই ইন্টারনেটে কোর্ট ফি পরিশোধের বিষয়টি সময়ের দাবি হিসেবে বিভিন্ন মহলে আলোচিত হয়। এ কারণে কোর্ট ফি সেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে ১৮৭০ সালের কোর্ট ফি আইন সংশোধন করতে যাচ্ছে সরকার। কাল জাতীয় সংসদ ভবনের মন্ত্রিসভা কক্ষে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা বৈঠকে দ্য কোর্ট ফিস (অ্যামেন্ডম্যান্ট) অ্যাক্ট, ২০১৫ এর খসড়া নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য উঠছে। এর আগে কয়েকবার এ আইন সংশোধন করা হলেও তা ছিল শুধু মূল্য বাড়ানোর প্রয়োজনে। এবার আইন সংশোধন করা হচ্ছে মানুষের  দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশে। এ আইন সংশোধিত হওয়ার পর প্রত্যন্ত এলাকার লোকজনও ই-পেমেন্ট বা অনলাইন পেমেন্ট ব্যবস্থায় সহজেই কোর্ট ফি দিতে পারবে। আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ‘কোর্ট ফিস অ্যাক্ট ১৮৭০’ আইনটি সংশোধনের অনুরোধ জানিয়ে গেল বছরের ২রা সেপ্টেম্বর আইন ও বিচার বিভাগে একটি উপানুষ্ঠানিক পত্র পাঠায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। ওই চিঠিতে বলা হয়, জনগণের হয়রানি রোধকল্পে, সহজে এবং দ্রুততার সঙ্গে জনসেবা পৌঁছে দেয়ার স্বার্থে ই-পেমেন্টের মাধ্যমে ও অনলাইনে কোর্ট ফি জমার সুযোগ সৃষ্টি করতে বিদ্যমান ‘কোর্ট ফিস অ্যাক্ট ১৮৭০’-এর সংশোধনী আনা প্রয়োজন। চিঠিতে বলা হয়, প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার পর কোর্ট ফি ফরম ছাপানো, সংরক্ষণ ও পরিবহনে বিশাল ব্যয় কমানোসহ জালিয়াতিও রোধ করা সম্ভব হবে। এর ভিত্তিতে দ্য কোর্ট ফিস অ্যাক্ট, ১৮৭০ এর সংশোধনী আনার জন্য প্রস্তাবনা দিতে আইন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (মতামত) আবু আহমদ জমাদারকে সভাপতি করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা ছিলেন- একই মন্ত্রণালয়ের উপসচিব উম্মে কুলসুম, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ইনফরমেশন (এ২আই) প্রোগ্রামের উপসচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা, আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগের উপসচিব মো. রফিকুল হাসান ও একই মন্ত্রণালয়ের উপ-সলিসিটর (দেওয়ানি) শেখ হুমায়ুন কবির। কমিটিকে এক মাসের মধ্যে সরকারের কাছে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। এর ভিত্তিতেই আইন ও বিচার বিভাগের সচিবের কাছে রিপোর্ট জমা দেয় এ সংক্রান্ত কমিটি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সরকারি বিভিন্ন সেবা গ্রহণের জন্য নাগরিকদের নির্ধারিত হারে কোর্ট ফি দিতে হয় এবং নির্ধারিত প্রতিষ্ঠানে দাখিল করতে হয়। তবে কোর্ট ফি ফরম সংগ্রহ করতে নাগরিকদের নানা হয়রানিতে পড়তে হয়। আইন সংশোধনের পরে এ হয়রানির হাত থেকে রেহাই পাবে সবাই। গ্রামের বা বাড়ির কাছেই ব্যাংক, মোবাইল অপারেটরের মাধ্যমে কোর্ট ফি জমা দেবে মানুষ। আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এরই মধ্যে কোর্ট ফি আইনের কয়েকটি ধারা সংশোধনের জন্য খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে। সংশোধিত আইনের ৩৪(১) ধারায় বলা হয়েছে, সরকার সময়ে সময়ে বিধি জারি করে কোর্ট ফি ও বিভিন্ন ধরনের স্ট্যাম্প আইনে বর্ণিত বিধান অনুসারে ছাপাতে ও বিক্রি করতে লোক নিয়োগ করতে পারবে। এ ধারার সঙ্গে সংশোধনী হিসেবে ৩৪(১)-এর (১এ) সংযোজনের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। সংশোধনীতে বলা হয়েছে, সরকার যে কোন সরকারি ও শিডিউলভুক্ত ব্যাংককে অথবা প্রতিনিধিকে, মোবাইল অপারেটর অথবা অন্য যে কোন কর্তৃপক্ষকে স্ট্যাম্প বা কোর্ট ফি ফরম বিক্রি করার দায়িত্ব দিতে পারবে। একই আইনের ৩৫(১) ও (২) ধারায় বলা হয়েছে, সরকার সারা দেশে স্ট্যাম্প বা কোর্ট ফি ফরম বিক্রি করার জন্য যাদের নিয়োগ দেবে তা সরকারি প্রজ্ঞাপন দ্বারা করবে। আবার এ ধরনের নিয়োগ বাতিল করতেও পারবে। আইনে আরেকটি উপধারা সংযোজন করার প্রস্তাব করে বলা হয়েছে, এই আইনে যা কিছু থাকুক না কেন, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কোর্ট ফি ফরম কেনার জন্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে যে কোন মূল্যের কোর্ট ফি দিতে পারবে। উল্লেখ্য, ১৮৭০ সালের কোর্ট ফি আইনেই এখনও কোর্ট ফির ব্যবহার, ক্রয়-বিক্রয় চলছে। মাঝে ২০০২ ও ২০১০ সালে কোর্ট ফি আইন সংশোধন করে কোর্ট ফির মূল্য বাড়ানো হয়েছে। এই প্রথম কোর্ট ফি ব্যবহারে ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন ধরনের দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা, আপিল ও দরখাস্তের জন্য কোর্ট ফি প্রয়োজন হয়। এছাড়া চুক্তিপত্র, জমি রেজিস্ট্রেশন, জমির নামজারি, পর্চা, উত্তরাধিকার সনদ, বাড়িভাড়া চুক্তি ইত্যাদির জন্য নির্ধারিত কোর্ট ফি সরকারকে দিতে হয়। টাকা জমা দিতে হয় ব্যাংকের মাধ্যমে। আদালতের স্ট্যাম্প ভেন্ডারদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে এসব সংগ্রহ করতে হয়। কিন্তু ফরম সংগ্রহ করা সহজলভ্য নয়। এগুলো সহজ করার জন্য সমপ্রতি আইন মন্ত্রণালয় আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইন ও বিচার বিভাগের সচিব আবু সালেহ শেখ মোহাম্মদ জহিরুল হক মানবজমিনকে বলেন, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, জমি রেজিস্ট্রি, সম্পত্তি বেচাকেনা, সর্বস্তরের আদালতে মামলা পরিচালনাসহ বিভিন্ন কাজে কোর্ট ফি দিতে হচ্ছে। গত বছর শুধু জমি রেজিস্ট্রি খাত থেকে সরকার প্রায় সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করেছে। যদি ই-পেমেন্টে এসব কোর্ট ফি পরিশোধের ব্যবস্থা নেয়া যায় তবে রাজস্ব আয়ের পরিমাণ আরও বাড়বে। এর মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন একধাপ এগুবে বলে মনে করছি।

No comments

Powered by Blogger.