ভারী বর্ষণ ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস- পানির নিচে কক্সবাজারের ২২০ গ্রাম by আব্দুল কুদ্দুস

কক্সবাজার সদরের খুরুলিয়া এলাকায় বন্যার
পানিতে ডুবে যাওয়া একটি মাদ্রাসা l প্রথম আলো
রামুর গর্জনিয়ায় ডুবে যাওয়া ঘরবাড়িl প্রথম আলো
টানা ছয় দিনের ভারী বর্ষণ ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে কক্সবাজারের আট উপজেলায় লাখো মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। তলিয়ে গেছে ২২০ গ্রাম। কয়েক হাজার মানুষকে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়া হলেও বেশির ভাগ মানুষ রয়েছে গৃহহীন অবস্থায়। আঞ্চলিক সড়ক তলিয়ে যাওয়ায় ভেঙে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থাও।
এদিকে ঘরবাড়ি বন্যার পানিতে ডুবে থাকায় জ্বলছে না চুলা। ফলে দুর্গত এলাকায় খাবার ও পানীয় জলের সংকট দেখা দিয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কক্সবাজার শহরের প্রধান সড়কের বাজারঘাটা এলাকায় কোমরসমান পানি। বড় বাজার এলাকার প্রায় তিন শ দোকান এখন ডুবে আছে পানিতে। এ ছাড়া টেকপাড়া, বার্মিজ মার্কেট, লারপাড়াও শত শত ঘরবাড়ি পানির নিচে। এদিকে হোটেল-মোটেল জোনের শতাধিক হোটেলের নিচতলায় পানি ঢুকে পড়েছে।
কক্সবাজার সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান জি এম রহিম উল্লাহ জানান, ভারী বর্ষণে শহরের বাজারঘাটা, বড়বাজার, গোলদীঘিরপাড়, টেকপাড়া, সমিতিপাড়া, কুতুবদিয়াপাড়া, নাজিরারটেকসহ উপজেলার অন্তত ৮০টি গ্রাম পানির নিচে তলিয়ে গেছে। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে এক লাখ মানুষ। শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। চলাচলের পথ বন্ধ থাকায় পোহাতে হচ্ছে চরম দুর্ভোগ।
জনপ্রতিনিধিরা জানান, বিভিন্ন উপজেলায় হাজার হাজার একর ফসলি জমি, চিংড়ি ঘের ও মৎস্যপ্রকল্প তলিয়ে গেছে।
জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেন সরেজমিন বন্যা কবলিত বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এসে গতকাল শনিবার বিকেলে প্রথম আলোকে জানান, বন্যার পানিতে হাজার হাজার ঘরবাড়ি নিমজ্জিত। পানিবন্দী লাখো মানুষ। পাহাড়ি ঢলের পানিতে গ্রামীণ অবকাঠামো রাস্তাঘাট বিলীন হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়েছে। বহু শিক্ষা ও ধর্মীয়প্রতিষ্ঠান বন্যার পানিতে ডুবে গেছে। তিনি পানিবন্দী লাখ লাখ মানুষকে সহযোগিতা করতে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের অনুরোধ জানান।
জেলা প্রশাসক বলেন, গতকাল পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন এলাকায় সরকারের পক্ষে ১৪৫ মেট্রিকটন চাল ও নগদ ১১ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। তা ছাড়া বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও ব্যক্তি বিশেষের উদ্যোগে বন্যাদুর্গত এলাকায় শুকনো খাবার ও ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে।
রামু উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান রিয়াজ-উল আলম জানান, পাহাড়ি ঢলে বাঁকখালী নদীর পানি উপচে রামুর হাইটুপি, মেরংলোয়া, পশ্চিম মেরংলোয়া, গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়া, কাউয়ারকোপ, ফতেখাঁরকূল, রাজাকূল, মিঠাছড়িসহ অন্তত ৬৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী হয়ে পড়ে অন্তত ৯০ হাজার মানুষ। বন্যার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় টেকনাফ-কক্সবাজার, কক্সবাজার-ঈদগাহ, কক্সবাজার-রামু ও রামু-নাইক্ষ্যংছড়ি সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। জরুরি প্রয়োজনে লোকজন এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যাচ্ছেন ছোট ছোট ডিঙি নৌকা নিয়ে।
রামু উপজেলা গর্জনিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান তৈয়ব উল্লাহ চৌধুরী জানান, ইউনিয়নের অন্তত আটটি গ্রাম তলিয়ে গেছে। রামু-নাইক্ষ্যংছড়ি সড়কের কয়েকটি অংশ ভেঙে যাওয়ায় যানবাহন চলাচল বন্ধ রয়েছে। রামু-তেমুহনী-জাদিমুরা সড়কও ভেঙে পড়ছে।
কুতুবদিয়া উপজেলা পরিষদ সূত্র জানায়, প্রবল বর্ষণ আর সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে উপজেলার উত্তর ধুরুং, ফয়জনিরবাপেরপাড়া, সতরউদ্দিন, চর ধুরুং, আকবরবলীপাড়া, বাতিঘরপাড়া, আলীফকির ডেইলসহ ১৮ গ্রামের পাঁচ শতাধিক ঘরবাড়ি প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দী প্রায় ১০ হাজার মানুষ।
চকরিয়া উপজেলা পরিষদের মেয়র জাফর আলম বলেন, মাতামুহুরী নদীর পানি উপচে দুই তীরের চিরিঙ্গা, বরইতলী, কৈয়ারবিল, কাকারা, কোনাখালী, শাহারবিল, বিএমচর, পুর্ববড়ভেউলা, ঢেমুশিয়া ইউনিয়নের ৫৪টি গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে। পানিবন্দী প্রায় ৯০ হাজার মানুষ।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) চকরিয়া চিরিঙ্গা শাখা প্রকৌশলী মোহাম্মদ আলী জানান, মাতামুহুরীর পানির স্রোতে কোচপাড়া শহর রক্ষাবাঁধ ভেঙে পৌরসভার কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে হুমকির মুখে পড়েছে, বিপুল সংখ্যক ঘরবাড়ি, সড়ক ও বিভিন্ন শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান।
আমাদের চকরিয়া, মহেশখালী ও টেকনাফ প্রতিনিধি জানান, পেকুয়া সদর ইউনিয়নের নন্দীখালী, বাজারপাড়া, হরিণফাঁড়ি, জালিয়াপাড়া, মোরাপাড়া, টেকপাড়াসহ ১১টি গ্রামের ১৫ হাজার মানুষ পানিবন্দী। মহেশখালী উপজেলার ধলঘাটা, মাতারবাড়ি, কুতুবজোম, ঘটিভাঙা, সোনাদিয়া, বড়মহেশখালী, আমতলী, চরপাড়া, মুদিরছড়া, জালিয়াপাড়াসহ ১৩ গ্রামে পানি বাড়ছে। এতে অন্তত ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দী। টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, কাটাবুনিয়া, সাবরাং, মহেশখালীয়াপাড়া, শামলাপুর, বাহারছড়াসহ উপজেলার ১৩টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে ৪০ হাজার মানুষ পানিবন্দী। উখিয়া উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের অন্তত ১৫ হাজার মানুষ পাঁচ দিন ধরে পানিবন্দী জীবন কাটাচ্ছেন।

No comments

Powered by Blogger.