সিলেটে খলিল হত্যা- হিসাব মিলছে না অনেক কিছুরই by চৌধুরী মুমতাজ আহমদ

ইব্রাহীম আবু খলিলকে যারা চেনেন তারা জানেন কতটা শান্ত, কতটা বিনয়ী তিনি। আচরণে-স্বভাবে নরম হলেও শরীরের দিক দিয়ে তিনি মোটেও তেমন নন। বলিষ্ঠ সুঠাম দেহ বলতে যা বুঝায় ইব্রাহীম খলিলের শরীরটা ছিল তেমনই। তাকে যে একা কেউ কাবু করতে পারবে, এমনটি সহজেই ভাবতে পারছেন না চেনাজানারা। যদিও শুরু থেকেই ইব্রাহীম খলিলের স্ত্রী ফাতেহা মাশকুরা বলছেন, তিনি একাই হত্যা করেছেন তার স্বামীকে। আদালতে দেয়া জবানবন্দিতেও একই দাবি করেছেন তিনি। তবুও যেন হিসাব মিলছে না। হিসাব মিলছে না আরও অনেক কিছুরই।
গত ১৮ই মে ভোরে নিজ ঘরে খুন হন সিলেট নগরীর সওদাগরটুলার বাসিন্দা তাবলিগ জামাতের শীর্ষস্থানীয় কর্মী ইব্রাহীম আবু খলিল। তাকে গলা কেটে হত্যার পর লাশ বালিশ চাপা দিয়ে শয়নকক্ষের খাটের নিচে রাখা হয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ওইদিনই স্ত্রী ও এক ছেলেকে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে ইব্রাহীমের স্ত্রী ফাতেহা পুলিশের কাছে স্বামী খুনের দায় স্বীকার করেন। আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতেও খুনের দায় একা নিজের কাঁধে নেন স্ত্রী ফাতেহা মাশকুরা। ফাতেহা মাশকুরার জবানবন্দিতে তার স্বামী ইব্রাহীম খলিলের চারিত্রিক স্খলন প্রমাণের প্রচেষ্টাই বারবার ঘুরেফিরে এসেছে। তবে তার সেই স্বীকারোক্তিমূলক  বক্তব্যেও যেন খাপে খাপে মিলছে না। রহস্যের জালে তাই আটকে আছে পুলিশ। অবশ্য তদন্ত কর্মকর্তা কোতোয়ালি মডেল থানার এসআই কামাল হোসেন বলছেন, প্রযুক্তির সহায়তায় সে জাল ছিঁড়ে তিনি প্রায় সমাধানের পথে পৌঁছে গেছেন।
জবানবন্দিতে ফাতেহা মাশকুরার বক্তব্য, তিনি প্রথমে ঘরে থাকা রেলের স্লিপার দিয়ে ইব্রাহীম খলিলের মাথায় আঘাত করেন, ‘স্লিপারটি দেখে আমার মাথা গরম হয়ে যায়। ওটা তুলে স্বামীর মাথায় জোরে আঘাত করি। মাথা ফেটে রক্তাক্ত হয়ে যায়।’ তবে ইব্রাহীম খলিলের শোবার ঘর থেকে রেলের যে স্লিপার পুলিশ জব্দ করেছে তা সহজেই তোলার মতো নয়। পুলিশের মালখানায় রক্ষিত স্লিপারটির ওজন ১২ থেকে ১৫ কেজির মতো হবে। এটা দিয়ে মাথায় আঘাত করলে যে গতিতে তা ছুটে যাবে এবং এর ওজন দুইয়ে মিলে ‘মাথা ফেটে রক্তাক্ত’ হওয়ার কথা নয়। পুরো মাথাই থেঁতলে যাওয়ার কথা।
ফাতেহা মাশকুরা তার জবানবন্দির একেবারে শেষ পর্যায়ে বলছেন, ‘আমি সজ্ঞানে এ কাজ করিনি’। তবে ঘটনার বিচারে তার এ বক্তব্য মোটেও মজবুত নয়। ঘটনা পরম্পরা বলছে তিনি পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়েই তার স্বামী ইব্রাহীম খলিলের কক্ষে প্রবেশ করেন এবং ঝোঁকের মাথায়ও এ কাণ্ডটি ঘটাননি। হত্যাকাণ্ডটি যে ধীরেসুস্থে সংঘটিত হয়েছে এর ইঙ্গিত দেয় ইব্রাহীম খলিলের হাতে বাঁধা মোটা রশি। অবশ্য জবানবন্দিতে রশি বা হাত বাঁধা প্রসঙ্গে কোন বক্তব্য নেই ফাতেহা মাশকুরার। যদিও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত ছবিতে ইব্রাহীম খলিলের হাতে মোটা রশি বাঁধা দেখা গেছে।
হাত বাঁধতে হলে অবশ্যই আঘাত করার আগেই তা বাঁধার কথা। আর তখন ঘুম ভেঙে যাওয়ার কথা ইব্রাহীম খলিলের। কিন্তু তার ‘ঘুম ভাঙেনি’। অবশ্য ফাঁক রেখেছেন ফাতেহা মাশকুরা। নিজে যেচেই বলছেন, ওইদিন ঘুমের ওষুধ খেয়েই ঘুমিয়েছিলেন ইব্রাহীম খলিল। তিনি তথ্য দেন, ‘তার এলার্জি ও ব্যথা থাকায় ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাতেন।’ অর্থাৎ নিয়মিতই ঘুমের ওষুধ সেবন করতেন ইব্রাহীম খলিল। তার মানে স্বাভাবিক ঘুমের জন্যই তিনি এ ওষুধ খেতেন, নিশ্চয়ই অচেতনের মতো ঘুমানোর জন্য নয়। কেউ রশি দিয়ে হাত বাঁধতে গেলে সে ঘুম ভেঙে যাওয়ার কথা। আর ঘুম ভেঙে গেলে স্ত্রীকে রুখে দেয়ার মতো শক্তি ইব্রাহীম খলিলের শরীরে যথেষ্টই ছিল। ঘুম যদি ভেঙে যায়, তবে কেন তিনি পারেননি স্ত্রীকে প্রতিহত করতে। তবে কি অন্য আর কেউ ছিলেন ফাতেহা মাশকুরার সহযোগী হিসেবে? পুলিশও ধারণা করছে, একা হয়নি এ হত্যাকাণ্ড। বাবাকে হত্যা করেছেন কিন্তু মায়ের প্রতি কোন ক্ষোভ নেই যেন তাদের সন্তানদের। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই কামাল হোসেনও মোটামুটি নিশ্চিত হত্যাকাণ্ডে ফাতেহা মাশকুরার সহযোগী ছিলেন কেউ।
ইব্রাহীম খলিলের পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে, ইব্রাহীম খলিলের বাসার বয়োবৃদ্ধ গৃহকর্মী শুক্কুরি বেগম ঘটনার রাতে ঘুমিয়ে ছিলেন নিজের রুমে। হঠাৎ একটি আর্তচিৎকার শুনেন, ‘ইয়াল্লা’। ঘুম ভেঙে যায় তার। ছুটে বেরিয়ে যেতে চান খুঁজ নিতে। বেরোতে পারেন না, দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। শুক্কুরি বেগম যাতে বের না হতে পারেন এর জন্যই কি দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করা হয়েছিল? ঝোঁকের মাথায় হত্যাকাণ্ডে এমন প্রস্তুতি থাকার কথা নয়।
হত্যার পর আলামত হিসেবে পুলিশ একটি ভেজা জায়নামাজ উদ্ধার করে। রক্ত লেগে থাকায়ই জায়নামাজটি ধোয়া হয়েছিল। ঝোঁকের মাথায় হত্যাকাণ্ড ঘটালে ইব্রাহীম খলিলের স্ত্রী ফাতেহা মাশকুরা মানসিকভাবে এতটা স্থির থাকার কথা নয় যে জায়নামাজ ধুয়ে রাখার কথা তার মাথায় আসবে। শুক্কুরি বেগমের বরাত দিয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্রটি জানাচ্ছে, ঘটনার পর পুরো সুস্থ স্বাভাবিকই ছিলেন ফাতেহা মাশকুরা। সকালে প্রথমে গৃহকর্মী শুক্কুরি বেগমকে ডেকে নিয়ে প্রবেশ করেন ইব্রাহীম খলিলের রুমে। লাশ দেখে কান্নাকাটি করেন। পরে আবার ছোট ছেলে সাজিদকে নিয়ে রুমে প্রবেশ করে কান্নাকাটি করেন তিনি। সূত্রটি বলছে, এর আগে যে ফাতেহা মাশকুরা স্বামীর লাশটি দেখেছেন তিনি সেটা চেপে যান ছেলের কাছে।
হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েও ফাতেহা মাশকুরা কেন এতটা শান্ত। সেটা কি তার অতীতের কোন লুকিয়ে থাকা অধ্যায়ের কারণে। মানবজমিনের অনুসন্ধানে একটি সূত্র থেকে নিশ্চিত হওয়া গেছে, অতীতেও একটি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল ফাতেহা মাশকুরার নাম। ঘটনার সময়কাল প্রসঙ্গে সূত্রটি নির্দিষ্ট তথ্য দিতে না পারলেও বলছে, কয়েক বছর আগে ইব্রাহীম খলিলের বাসায় মিনা নামে কিশোরী এক গৃহকর্মী কাজ করতো। ইব্রাহীম খলিলের স্ত্রী ফাতেহা মাশকুরার নির্যাতনে তারই গ্রামের বাড়ি থেকে আনা ওই কিশোরীর মৃত্যু হয়। পরে বিষয়টির মীমাংসা হয় আপসে। ইব্রাহীম খলিল হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই কামাল হোসেন খোঁজ নিয়েছিলেন ওই হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গেও। তিনি কথা বলেছিলেন ফাতেহা মাশকুরার বোনের সঙ্গে। তিনি মিনা নামের ওই গৃহকর্মীর মৃত্যুর বিষয়টি তদন্ত কর্মকর্তাকে নিশ্চিত করেন। তবে জানান, মেয়েটির মৃত্যু হয়েছিল রেললাইনে কাটা পড়ে।
ইব্রাহীম খলিল হত্যাকাণ্ডের তদন্তে বড় বোমাটি বেরিয়ে এসেছে গৃহকর্মী শুক্কুরি বেগমের কাছ থেকেই। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র তথ্য দিয়েছে, শুক্কুরি বেগম জানিয়েছেন, গভীর রাতে ইব্রাহীম খলিলের বাসায় এক যুবকের আনাগোনা ছিল। কে সে যুবক? সেই কি হত্যাকাণ্ডে ফাতেহা মাশকুরার সহযোগী? পুলিশ তাকেই খুঁজছে এখন। পুলিশ তার অনেকটাই কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। শুধু অপেক্ষায় আছে জোরালো প্রমাণ আর মোক্ষম সময়ের।

No comments

Powered by Blogger.