কালশী: জ্বলন্ত এপিটাফ এর এক বছর by ফারুক ওয়াসিফ

এক বালিকা তার মায়ের চোখের মণিতে পাহাড়-নদী-লতাপাতা দেখতে পায়। কালশীর বিহারি মানুষদের চোখের দিকে তাকালে দেখতে পাই আগুন-মৃত্যু, বঞ্চনা আর নির্যাতনের ছায়াছবি। মানুষের চোখে যার যার জীবনের সুখ-দুঃখের ছাপ পড়ে। একটানা কষ্টে থাকলে সেই ছাপ স্থায়ী হয়ে যায়। বিহারিদের যন্ত্রণার শুরু আছে, শেষ নেই। তারা পাকিস্তানেও শরণার্থী ছিল, বাংলাদেশেও শরণার্থী। আর সবাই তো জানেই, শরণার্থীদের কোনো দেশ নেই। তারা সংখ্যালঘুদের মধ্যে সংখ্যালঘু, নিপীড়িতের মধ্যে নিপীড়িত। কেউ যদি বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান, চাকমা-মান্দি-গারো-ত্রিপুরা-মণিপুরি জনগোষ্ঠীর দুঃখ বোঝেন, তাহলে আটকে পড়া পাকিস্তানি নামে পরিচিত উর্দুভাষীর দুঃখটাও বুঝবেন। তিনি আরও জানবেন, অন্য সংখ্যালঘুদের যদিও বা যাওয়ার জায়গা আছে, তাদের কারও কারও ক্ষমতা-বিত্তের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠার সুযোগ যদিও থাকে, বিহারিদের সেসব কিছুই নেই। তাদের জীবন পতঙ্গের জীবন, ভাসমান, উড়ন্ত এবং খরচযোগ্য৷
গত বছরের এই দিনে ঢাকার মিরপুরের কালশীর বিহারি ক্যাম্পে সংঘবদ্ধ হামলা করে এক পরিবারের সাতজনকে পেট্রল ঢেলে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। আরও তিনজন মারা গিয়েছিলেন পুলিশ ও মাস্তানদের গুলিতে। আহত হয়েছিলেন পঞ্চাশাধিক। ভাঙচুর হয়েছিল বেশ কটি ঘর ও দোকান।
এই এক বছরে এসবের তদন্তে কোনো অগ্রগতি নেই। উল্টো কালশী বস্তির অজ্ঞাতনামা ৩ হাজার ৭১৪ জনের বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা করা হয়। এর মধ্যে চারটি পুলিশের, দুটি বেসরকারি ব্যক্তির করা। বাংলাদেশে অবস্থানরত বিহারিদের সংগঠন এসপিজিআরপির কালশী শাখার সেক্রেটারি শওকত হোসেনের কথায়, ‘আমরা প্রমাণ দিলাম, ভিডিও ফুটেজ দিলাম; অথচ কেউ কিছু করল না। এখন উল্টা ভয়ে থাকি, কখন চার্জশিট হয়, আর আমাদের কারে কারে ধরে নিয়ে যায়। আমরা জীবন দিলাম, মাইর খাইলাম, মামলাও খাইলাম।’
ওই ঘটনায় এক পরিবারেই পুড়ে মারা গিয়েছিলেন সাতজন। খুনিরা বাইরে থেকে ঘরের তালা লাগিয়ে পেট্রল ঢেলে আগুন দিয়েছিল। ওদিকে পুলিশের গুলির মুখে কারোরই সাহায্যের হাত নিয়ে এগিয়ে আসার সাহস ছিল না। যাঁরা সাহস করেছিলেন, তাঁদের গুলিবিদ্ধ অথবা আটক হতে হয়েছে। সে সময় বিহারিপল্লিতে গিয়ে শুনেছিলাম, ‘প্রতিবাদ করায় ১০ জন মারা গেছে, যদি প্রতিবাদ না করতাম তাহলে পুরো বস্তি জ্বালায়া দিত, আরও মানুষ মরত।’
নিজেদের তারা এখনো মানুষ মনে করে। কিন্তু আইনের চোখে তারা ‘নাগরিক’ নয়, কেবলই ভোটার। বাঙালি সমাজের অনেকেই তাদের কলঙ্ক, ময়লা, অপরাধী মনে করে, মানুষ মনে করে না।
স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের সাতজনের মর্মান্তিক মৃত্যু সয়ে উঠতে হয়েছিল যাঁকে, তাঁর নাম ইয়াসিন। শওকত হোসেনকে জিজ্ঞাসা করি, আপনারা কেন মামলা করলেন না?
তিনি বললেন, ‘কার ওপর মামলা করব? করে থাকতে পারব? মামলা করতে চাইছিল ইয়াসিন। কিন্তু তারেও তো মাইরা ফালানো হইল। পুলিশ বলে, অ্যাকসিডেন্ট! কিন্তু সবাই জানে ইয়াসিন মামলা করবে—এই ভয়ে হেরেও মাইরা ফালাইল!’
তখনই খেয়াল হলো আচ্ছা, ইয়াসিনের আরও এক কন্যা তো পুড়তে পুড়তেও বেঁচে গিয়েছিল ওই জতুগৃহ থেকে। তার কী খবর! সেই মেয়েটির নাম ফারজানা, বয়স ১৪-১৫। তাদের পরিবারে যদি দুর্ভাগ্যের আগুন না জ্বলত, তাহলে এখন সে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ত। গত বছরের ভয়াবহ ট্র্যািজডির পর তার আর পড়ালেখা করার মতো অবস্থা ছিল না। মা, ভাইবোন, বোনের বাচ্চাদের পুড়ে কয়লা হতে দেখাও যেন যথেষ্ট নয়, মাস খানেকের মধ্যে বাবাও মারা গেলেন এক বিতর্কিত সড়ক দুর্ঘটনায়। তার খালাতো বোন জানাল, ফারজানা এখন ভালো আছে। সে আবার পড়ালেখায় মন দিচ্ছে। আগামী বছর ক্লাস সিক্সে ভর্তি করা হবে, তাই ক্লাস ফাইভের বই পড়ছে পুনরায়।
‘ফারজানা ভালো আছে’ শুনে খটকা লাগল। এটা কেমন ভালো থাকা? বিহারিদের নেতা শওকত বলেছিলেন, ‘কে মামলা করবে, কার ওপর মামলা করব। বাঁইচা থাকলে ইয়াসিন মামলা করত! ইয়াসিনের পর তার মেয়ে সুস্থ হয়ে উঠলে মামলা করবে বলে শুনেছিলাম!’ বিপদটা এখানেই, ফারজানা যদি তার পুরো পরিবারের হত্যাকারীদের শাস্তির দাবি করে বসে? সেই এতিম মাসুম বাচ্চার ফরিয়াদ যদি ক্ষমতাবানদের কারও মনে জ্বালা ধরায়, তাহলে তো ফারজানার পক্ষেও প্রাণ বাঁচানো কঠিন হবে! ফারজানা তাই এককথায় ‘ভালো আছে’। সহায়-স্বজন সব হারিয়ে মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প নামক অকহতব্য বাস্তবতায় বাস করেও তাকে ‘ভালো’ থাকতে হয়!
সাতজনকে পুড়িয়ে মারা, তিনজনকে গুলি করে হত্যা করার সুস্পষ্ট প্রমাণ আছে। ইয়াসিনের বাসচাপা পড়ে মৃত্যুর ঘটনাকে হত্যাকাণ্ড বলার মতো লোক আছে। তবু প্রশাসনের তরফ থেকে মামলা হলেও সুনির্দিষ্ট কাউকে অভিযোগ করা হয়নি। সেই মামলার অভিযোগপত্রও যেন হওয়ার নয়। নিহত ও আক্রান্ত ব্যক্তিদের নামে কেউই ক্ষতিপূরণ পায়নি। যে ঘরটি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, তার মালিক জুম্মন সেখানে বাড়ি বানিয়ে মাদ্রাসা করেছেন।
পরিস্থিতি এখন শান্ত, মনের তলায় ভয়ানক আতঙ্ক। যুবক বয়সী অনেকেই এলাকা ত্যাগ করেছেন। যদি আপনি কালশীতে যান, যদি সেদিনের কথা জিজ্ঞাসা করেন, উত্তর পাবেন না। কেবল ভালো করে তাদের চোখের গভীরে তাকালে দেখবেন শোকের হুতাশন, হত্যার ফরিয়াদ, অমানবিকতার জ্বালা সেখানে ধিকিধিকি জ্বলছেই।
শওকত যেহেতু নেতা, সেহেতু তাঁকে কিছু কথা সাহস করে বলতেই হয়। তিনি বলছিলেন, ‘ভোটার হয়ে কী লাভ হলো? পাঁচ বছর পরপর খালি প্রতিশ্রুতি দেওয়ার লোক আসে, কোনো অধিকারই আসে না। আমাদের বাচ্চারা কাউন্সিলর-এমপির সুপারিশ ছাড়া স্কুলে ভর্তি হইতে পারে না। তাও সবাইকে ভর্তি নেওয়াও হয় না। আমরা ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারি না। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার যেমন হয়েছে, তেমনি দেরিতে হলেও একদিন আমরাও বিচার পাব’।
ধন্য আশা কুহকিনী। এই দেশে সংবিধান মোতাবেক সব নাগরিক সমান। এর মধ্যে নাগরিকদের একটি অংশ অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি সমান। কিন্তু বিহারিরা তো নাগরিকই নয়। তারা রোহিঙ্গাদের মতোই রাষ্ট্রহীন প্রাণী। রোমান সাম্রাজ্যের আইনে এ রকম মানুষদের বলা হতো হোমো সাসের। এরা ছিল বধ্যোগ্য, এদের বাঁচতে হতো ক্ষমতাবানদের করুণার ওপর।
২০১৪ সালের ১৪ জুন রাজধানীতে প্রকাশ্যে, দিনের আলোয় যা হয়েছে, তা-ই কি শেষ? রামু থেকে সাঁথিয়া, বান্দরবান থেকে কালশী পর্যন্ত বিচারহীনতার যে দাপট, তাতে কালশী যেন বাংলাদেশে মানবতার জ্বলন্ত এপিটাফ। আসুন, আমরা এ রকম মৃত্যু ও অবিচারের সঙ্গে বসবাসের স্নায়বিক ব্যায়াম করে চলি!
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
bagharu@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.