কয়েকজনের হটকারিতায় গোটা বাংলাদেশের অপমান

সুধীর গৌতম
ওয়েস্ট ইন্ডিজের টিম বাসে ঢিল ছুড়েছিল একজনই। কিন্তু অপমানিত হয়েছিল পুরো বাংলাদেশ। বিশ্ব মিডিয়া এই একজন হটকারীর নাম আসেনি। খবর এসেছিল, ওয়েস্ট ইন্ডিজের টিম বাস বাংলাদেশের সমর্থকদের দ্বারা আক্রান্ত। গতকাল তিন-চারজন একইভাবে অপমান করলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটকে। ভারতীয় ক্রিকেটের সমর্থক সুধীর গৌতম কাল স্টেডিয়াম থেকে বেরোনোর পথে আক্রমণের শিকার হয়েছেন বলে খবর। সুধীরকে অনেকেরই চেনার কথা। ক্রিকেটপাগল মানুষটা শচীন টেন্ডুলকারের ভীষণ ভক্ত। সারা গায়ে ভারতীয় জাতীয় পতাকার তেরঙা রং মাখেন। পিঠে লেখা থাকে টেন্ডুলকারের নাম আর ‘১০’ সংখ্যাটি। প্রচণ্ড রোদ কিংবা প্রবল শীতেও এই বেশ বদলায় না। তাঁর এই পাগলামি ​দেখে খোদ টেন্ডুলকার ডেকে নিয়েছিলেন। অনেক দিন টেন্ডুলকার নিজে তাঁর নামে বরাদ্দের একটা করে টিকিট দিয়ে আসতেন সুধীরকে।
খেলাপাগল দরিদ্র এই মানুষটা সাইকেল চালিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে এসেছিলেন বলে শোনা যায়। ঘুমিয়েছেন ফুটপাতে, গ্যারেজে। কখনো কোনো নিম্ন-মধ্যবিত্তের বাড়িতে আশ্রয় মিলেছে। কিন্তু বারবার বাংলাদেশে এসেছেন। এ দেশের মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন। তাঁকে দেখেই অনুপ্রাণিত হয়েছেন ‘টাইগার শোয়েব’ আর ‘টাইগার মিলন’রা।
সেই শোয়েব ফোনে প্রথম আলোকে বলছিলেন, ‘সুধীর আমার আপন ভাইয়ের মতো। আমরা একসঙ্গে গ্যালারিতে থাকি। খেলা তো খেলাই। মাঠে খেলা হবে, বাইরে আমরা উদযাপন করব। কিন্তু তা-ই বলে গায়ে হাত তুলতে হবে! আমিও তো ভারতে গেছি, শ্রীলঙ্কায় গেছি, জিম্বাবুয়েতে গেছি। এমনও হয়েছে গ্যালারির একটা অংশে শুধু আমি একা বাংলাদেশের সাপোর্ট করছি। কই, কেউ তো কখনো গায়ে হাত তোলেনি।’ শোয়েবের প্রশ্ন, এখন তিনি যদি ভারতে গিয়ে কখনো মার খান, কোন গলায় প্রতিবাদ করবেন?
ভারতের প্রায় সব সংবাদমাধ্যমেই এই খবর প্রকাশিত হয়েছে। এনডিটিভি থেকে আনন্দবাজার পর্যন্ত। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের খবর, সুধীর স্টেডিয়াম থেকে বের হওয়ার​ পর পরই কয়েক জন লোক তাঁকে ঘিরে ধরে। হাত থেকে ভা​রতের জাতীয় পতাকা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। স্টেডিয়ামের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন পুলিশ কর্মী তাঁকে উদ্ধার করে সিএনজিতে তুলে দেন। কিন্তু তাতেও নিরস্ত হয়নি সেই খ্যাপাটে সমর্থকেরা। সেই সময় সুধীরের সিএনজি লক্ষ্য করেও ইট-পাটকেল ছোড়া হয়।
এই ঘটনার পর থেকে সুধীরের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে যাচ্ছেন টাইগার শোয়েব। সুধীরকে তিনি বোঝাতে চান, এই তিন-চারজন সমর্থক বাংলাদেশের আসল সমর্থক নয়। এদের কাছ থেকে কষ্ট পেয়ে তিনি যেন পুরো বাংলাদেশের ওপর অভিমান না করেন। বাংলাদেশে আসা বন্ধ না করেন। কিন্তু সুধীরের নম্বরটি বন্ধ!
মাইক আথারটনের কথাটা এখনো নিশ্চয়ই অনেকের মনে আছে। ২০১১ বিশ্বকাপে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে হয়েছিল উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। এমনিতেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের টিকিট ছাড়া হয়েছিল কম। বেশির ভাগই ছিল ভিআইপিদের জন্য বরাদ্দ। কিন্তু ভীষণ দুঃসময়েও ক্রিকেটটাকে ভালোবেসে, আঁকড়ে ধরে ধরে ধরে সেই হামাগুড়ি দিতে থাকা সময়টা থেকে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে এত দূর নিয়ে এসেছে এ​ দেশের সাধারণ মানুষই। মাঠে ঢুকতে না পারলাম তো কী হলো! তাঁরা স্টেডিয়ামের বাইরেই নিজেদের মতো করে শুরু করেন উদযাপন। ​সেটাই যেন সত্যিকারের ‘উদ্বোধনী’ অনুষ্ঠান।
স্টেডিয়াম থেকে বাইরের এই দৃশ্য দেখে বাংলাদেশের ক্রিকেটের এক সময়ের কট্টর সমালোচক আথারটন লিখেছিলেন, ‘মাত্রই বিশ্বকাপ শুরু হলো। কে চ্যাম্পিয়ন হবে না জানি। তবে ক্রিকেটকে ভালোবাসার দিক দিয়ে বাংলাদেশের সমর্থকেরাই সারা বিশ্বে চ্যাম্পিয়ন।’
এই সম্মানের গায়ে যারা কলঙ্কের দাগ ফেলে, সেই মুষ্টিমেয় সমর্থকেরা কি আদৌ বাংলাদেশের ক্রিকেটের সত্যিকারের সমর্থক?

No comments

Powered by Blogger.