চিকিৎসক বাবার চোখে মেয়ের প্রথম ১৮ বছর by শিশির মোড়ল

বাবা অধ্যাপক লুৎফুল কবীরের সঙ্গে চিকিৎসক
ফারহাত লামিসা কবীর l ছবি: প্রথম আলো
‘আমি জানি, প্রত্যেকের কাছেই তার বাবা সাধারণ কোনো ব্যক্তি নন। তারপরও বলব, আমার আব্বু সত্যি অসাধারণ, অতুলনীয়। চিকিৎসক বাবা অনেকেরই আছে। কিন্তু আমার আব্বু আমাকে নিয়ে যা করেছেন, সন্তানের প্রতি গভীর স্নেহের চেয়েও তা বাড়তি কিছু।’
বাবা এ আর এম লুৎফুল কবীর সম্পর্কে গভীর আবেগ আর ভালোবাসার এই কথাগুলো ফারহাত লামিসা কবীরের। এমবিবিএস পাস করে ফারহাত বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ থেকে গত সপ্তাহে ইন্টার্নশিপও শেষ করেছেন। আর বাবা লুৎফুল কবীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের অধ্যাপক।
ফারহাত প্রথম আলোকে বলেন, ‘আব্বু আমার জন্মের পর থেকে আমার বেড়ে ওঠা, বড় হওয়া শুধু দেখেননি, রীতিমতো পর্যবেক্ষণ করেছেন। পর্যবেক্ষণ করেই শেষ করেননি, আমার ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত তা নোট নিয়েছেন এবং একটি শিশুর বেড়ে ওঠা সেই নোটবইয়ে তুলে ধরেছেন। অনন্যতা না থাকলে এই কাজটি তিনি করতেন না।’ এরপর বললেন, ‘বিশ্ব বাবা দিবসে আব্বুর প্রতি রইল গভীর ভালোবাসা।’
শিশুস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এ আর এম লুৎফুল কবীর পেডিয়াট্রিক প্র্যাকটিস অন প্যারেন্টস প্রেজেন্টেশন নামে একটি বই লিখেছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘বইটি মূলত শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশ সম্পর্কে।’ চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী ও পেশাজীবী চিকিৎসকদের জন্য লেখা ৯৩০ পৃষ্ঠার বইয়ের একটি অধ্যায়ে একমাত্র সন্তান ফারহাত লামিসা কবীরের বেড়ে ওঠার তথ্য দিয়েছেন তিনি।
চিকিৎসক বাবা ও মেয়ের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফারহাত লামিসার জন্মের পর থেকে নিয়মিত তাঁর ওজন, উচ্চতা এবং মাথার পরিধি পরিমাপ করতেন লুৎফুল কবীর। ফারহাত বলেন, তাঁর বাবা প্রতি ছয় মাস পরপর সবকিছু পরিমাপ করতেন। এভাবে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত চলে। ১৮ বছরের সেই হিসাব বইয়ে তুলে দিয়েছেন বাবা। ১৯৯০ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত কোন বছর ফারহাতের ওজন, উচ্চতা ও মাথার পরিধি কত ছিল, তা এই বইয়ে বর্ণনা করা আছে। বইটি জার্মানি থেকে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে বলে লেখক জানিয়েছেন।
লুৎফুল কবীর বলেন, ‘সবচেয়ে দ্রুত বাড়ে মানুষের মস্তিষ্ক। পূর্ণবয়স্ক একজন মানুষের মস্তিষ্কের যে আকার, তার দুই-তৃতীয়াংশ তৈরি হয় জীবনের প্রথম দুই বছরে। এ সময় অনেক শিশুর মাথার তাপমাত্রা একটু বেশি থাকে। অনেক বাবা-মা চিন্তিত হন। কিন্তু চিন্তার কিছু নেই।’ এই শিশু বিশেষজ্ঞ বলেন, শিশুর বৃদ্ধি ও বিকাশ অব্যাহত থাকা দরকার। যদি কখনো তা থেমে যায়, তাহলে বুঝতে হবে সমস্যা আছে।
শিশুর জ্বর হলে, বমি বা বমি বমি ভাব হলে, মাথাব্যথা হলে, খিঁচুনি হলে, মুখ বেঁকে গেলে, কানে জ্বালা হলে, মামস হলে, নাক দিয়ে রক্ত পড়লে, মুখে ঘা হলে, ওজন-উচ্চতা কম হলে, দীর্ঘদিন কাশি থাকলে, শ্বাসকষ্ট হলে, পেটে ব্যথা হলে, জন্ডিস দেখা দিলে এবং এ রকম আরও কয়েক ডজন সমস্যা দেখা দিলে সেই নির্দিষ্ট রোগের লক্ষণ ও করণীয় সম্পর্কে বইটিতে বলা আছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে রোগনির্ণয় ও চিকিৎসাপদ্ধতি সম্পর্কে ব্যাখ্যা করা আছে।
ফারহাতের বৃদ্ধি ও বিকাশ পর্যবেক্ষণ করার বিষয়টি কি পরিকল্পিত ছিল—এমন প্রশ্নের উত্তরে লুৎফুল কবীর বলেন, ‘এ কাজটি আমি যে করব, তা ওর জন্মের আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম।’
বইটি সম্পর্কে দেশের কয়েকজন শিশু বিশেষজ্ঞের মতামত বইয়ের শুরুতে দেওয়া হয়েছে। তাঁদের মধ্যে প্রয়াত অধ্যাপক এম এস আকবরের মন্তব্যে বলা হয়েছে, একজন ফরাসি চিকিৎসক ১৭৫৯ থেকে ১৭৭৭ সাল পর্যন্ত তাঁর পুত্রসন্তান বেড়ে ওঠা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। আর বাংলাদেশি কন্যাসন্তানের বেড়ে ওঠার পর্যবেক্ষণ করার ঘটনা এই অঞ্চলের জন্য নতুন। লুৎফুল কবীর বলেন, ‘সন্তানকে পর্যবেক্ষণ করার অনুপ্রেরণা আমি পেয়েছিলাম ফরাসি চিকিৎসক ডি মন্টবিলার্ডসের কাছ থেকে।’

No comments

Powered by Blogger.