ছেলে জন্মের খবরটি পেলেন না রাজ্জাক

পরিবারে এসেছে নতুন মুখ। আনন্দ-উচ্ছ্বাসের বদলে পরিবারের সবার মলিন মুখ। নবজাতকের খবরটি পাননি তার বাবা। তিনি কি অবস্থায় আছেন সেটি জানা নেই পরিবারের অন্য সদস্যদের। তাকে নিয়ে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় দিন পার হচ্ছে সবার। বাবা দিবসে বাবা হয়েছেন বিজিবির নায়েক আবদুর রাজ্জাক। যাকে ধরে নিয়ে আটকে রেখেছে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি)।
জেলার সিংড়া উপজেলার বলিয়াবাড়ি গ্রামের তোফাজ্জল হোসেন তারা মোল্লার ছেলে আব্দুর রাজ্জাক দেশমাতৃকার সেবায় আত্মনিয়োগ করতে ২১ বছর আগে তৎকালনী বিডিআর-এ যোগ দেন। মিয়ানমার সীমান্তে কর্মরত থাকা অবস্থায় গত বুধবার মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। এ খবর পাওয়ার পর থেকে পরিবারের সদস্যরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, রাজ্জাক অপহৃত হওয়ার পর বিজিবি তাদের কিছু জানায়নি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে ছেলের হাত-পা বাঁধা ছবি দেখে তারা এ ঘটনা জানতে পারেন। এ খবর পেয়ে যোগাযোগ করলে পরে বিজিবির সিও ফোন করে তাদের জানান, পতাকা বৈঠক করে একদিনের মধ্যেই রাজ্জাককে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। কিন্তু এখনও সরকারের পক্ষ থেকে তাকে উদ্ধারের কোন ব্যবস্থাই তারা দেখতে পাচ্ছেন না।
এদিকে রোববার ১১টার দিকে রাজ্জাকের স্ত্রী আসমা বেগম একটি ফুটফুটে পুত্র সন্তান প্রসব করেন। রাজ্জাকের বাবা তোফাজ্জল হোসেন জানান, গত সোমবারে তার সঙ্গে ছেলে রাজ্জাকের শেষ কথা হয়। এরপর আর কোন খবর পাননি। ফেসবুকে বিদেশী গণমাধ্যমে ছবি দেখে তারা রাজ্জাক অপহরণের খবর জানতে পারেন।  সপ্তম শ্রেণীতে পড়ুয়া ছেলে রাকিবুল ইসলাম ও চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ুয়া মেয়ে ফারিয়া জাহান রিতু বাবার অনুপস্থিতি যেন মেনে নিতে পারছে না। তারা জানে না তাদের বাবার কি হয়েছে। তাদের এ অবস্থায় প্রতিবেশীরাও স্তব্ধ হয়ে গেছে। সরকারের কাছে আব্দুর রাজ্জাককে সুস্থ অবস্থায় তাদের মাঝে অতি দ্রুত ফিরিয়ে দেয়ার দাবি পরিবারের সদস্য তথা এলাকাবাসীর।
সহসাই বিচারিক কার্যক্রম শুরু হতে পারে
এদিকে কূটনৈতিক রিপোর্টার জানান, মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির জিম্মায় থাকা বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) নায়েক আবদুর রাজ্জাককে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ফেরত আনতে জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে সরকার। গতকালও এ নিয়ে নেপি’ডর সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। ঢাকাস্থ দেশটির রাষ্ট্রদূত মিও মিন্ট থান এবং ইয়াংগুনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সুফিউর রহমানের মাধ্যমে এ যোগাযোগ হয়েছে। কিন্তু কোন কিছুতেই কাঙিক্ষত ফল পাওয়া যায়নি। কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, ফেরতের আশ্বাস দূরে থাক, নায়েক রাজ্জাকের বিরুদ্ধে অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে নিয়মিত মামলা সাজানোর পথেই হাঁটছে মিয়ানমার। সহসাই মামলা দায়ের এবং পরবর্তী বিচারিক কার্যক্রম শুরু হতে পারে বলে নেপি’ড এবং ইয়াংগুনের সূত্রে ঢাকায় বার্তা এসেছে। দেশটির বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ রয়েছে এমন সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, মিয়ানমারের সীমান্তে আগেও বাহিনী পর্যায়ে উত্তেজনা হয়েছে। সেখানে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু পরিস্থিতি এত ঘোলাটে হয়নি। গত বছরের মে মাসে বান্দরবানের পাইনছড়ি সীমান্তে বিনা উসকানিতে বিজিবি সদস্যদের ওপর গুলি বর্ষণ, নায়েক সুবেদার মিজানুর রহমানকে হত্যা এবং তার লাশ আটকে রাখার বিজিপির রুঢ় আচরণের সম্প্রতিক সময়ের উদাহরণ উল্লেখ করে ঢাকার এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, নেপি’ড থেকে যে খবর আসছে তাতে জটিলতার বার্তা স্পষ্ট। দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তর কূটনৈতিক সমাধানে আন্তরিকতা দেখালেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ‘কঠোর’ মনোভাব দেখাচ্ছে। তারা আটক বিজিবি সদস্যের বিচার করতে চায়। এ জন্য নতুন করে কিছু বিষয় ঢাকার বিবেচনায় উপস্থাপন করা হয়েছে জানিয়ে ওই কর্মকর্তা গতকালও বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার আন্তর্জাতিকভাবে চাপে রয়েছে। সেই চাপ দিন দিন বাড়ছে। তা থেকে দৃষ্টি সরানোর জন্যই সীমান্তের একটি সামান্য ঘটনাকে টেনে দীর্ঘসূত্রতায় নিয়ে যাওয়ার কৌশল নেয়া হয়েছে বলেই মনে হয়। তবে সরকার এখন পর্যন্ত কূটনৈতিকভাবেই বিষয়টির সমাধান চাইছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা। বিভিন্ন সূত্রে মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিশেষ করে মন্ত্রীর যে ‘কঠোর’ মনোভাবের প্রকাশ পেয়েছে সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে গতকাল সন্ধ্যায় পররাষ্ট্র দপ্তরের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, যে কোন ঘটনার পর বিভিন্ন সূত্রে নানা কথা প্রকাশ পায়। কিন্তু এতে কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোন প্রভাব পড়ে না। বিজিবি নায়েক রাজ্জাককে অক্ষত অবস্থায় দ্রুত ফেরত আনতে নেপি’ডর সঙ্গে ঢাকার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। মিয়ানমার তার অবৈধ অনুপ্রবেশের যত অভিযোগই আনার কিংবা মামলা সাজানোর চেষ্টা করুক না কেন- ঘটনার প্রকৃত তথ্য-প্রমাণ বাংলাদেশের কাছে রয়েছে জানিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, কূটনৈতিকভাবেই তাকে দ্রুত ফেরত আনা সম্ভব হবে বলে ঢাকা আশাবাদী। উল্লেখ্য, নায়েক রাজ্জাকের নেতৃত্বে বিজিবির ছয় সদস্যের একটি দল গত মঙ্গলবার মধ্যরাতে নাফ নদীতে টহল দানকালে মিয়ানমারের রইগ্যাদং ক্যাম্পের বিজিপির একটি দল ট্রলারে করে বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশ করে। একপর্যায়ে টহল দলটি বিজিবির নৌযানের কাছে গিয়ে থামে। বিজিপির ট্রলারটিকে বাংলাদেশের জলসীমা ছেড়ে যেতে বলা হলে তারা নায়েক রাজ্জাককে জোর করে ট্রলারে তুলে নেয়। এ সময় বিজিবির অন্য সদস্যরা বাধা দিলে দুপক্ষের মধ্যে গুলিবিনিময় হয়। এতে বিজিবির সিপাহি বিপ্লব কুমার গুলিবিদ্ধ হন। এরপর বিজিপির ট্রলারটি রাজ্জাককে নিয়ে মিয়ানমারের দিকে চলে যায়। বিপ্লবকে চট্টগ্রামের সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ঘটনার পর বিজিবি-বিজিপির মধ্যে পতাকা বৈঠক আহ্বান করা হয়েছিল একাধিকবার। কিন্তু মিয়ানমান ওই আহ্বানে সাড়া দেয়নি। ঢাকাস্থ দেশটির রাষ্ট্রদূতকে এরই মধ্যে তলব করে ঘটনার প্রতিবাদ এবং আটক বিজিবি সদস্যকে দ্রুত ফেরত দেয়ার তাগিদ দেয়া হয়েছে। দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতও মিয়ানমারের নতুন পররাষ্ট্র সচিবের (পারমানেন্ট সেক্রেটারি) সঙ্গে দেখা করে আটক সদস্যকে ফেরত দেয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.