যেকোনো পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত

রিয়াদ মনসুর
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) সদস্যপদের জন্য আবেদন করে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ইসরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরাগভাজন হয়েছে। ইসরায়েল জানিয়েছে, শুল্ক হিসেবে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রাপ্য ১২ কোটি ৭০ লাখ ডলার তারা সময়মতো হস্তান্তর করবে না। এর ফলে বিকল্প অর্থের ব্যবস্থা না হলে জানুয়ারি মাসে সরকারি কর্মচারীদের বেতন দেওয়াই ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের জন্য হয়তো সম্ভব হবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও তাদের বার্ষিক অনুদান আটকে দেওয়া হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে। এর ফলে যে অর্থনৈতিক চাপের সৃষ্টি হবে, তার প্রতিক্রিয়ায় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের দেউলিয়া হওয়ার আশঙ্কা আছে। এমনকি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন কর্তৃপক্ষ এর কর্তৃত্বও হারাতে পারে। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতেও দমে যাচ্ছে না ফিলিস্তিনিরা। মঙ্গলবার প্রথম আলোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে জাতিসংঘে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত রিয়াদ মনসুর সে প্রত্যয়ই ব্যক্ত করলেন। মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, যেকোনো পরিস্থিতির জন্য তাঁরা প্রস্তুত। তবে তিনি আশা প্রকাশ করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল অর্থনৈতিক শাস্তির পথে যাবে না। শুল্ক বাবদ সংগৃহীত অর্থ হস্তান্তরে ইসরায়েলের অস্বীকৃতি প্রসঙ্গে রাষ্ট্রদূত মনসুর বলেন, ‘এই অর্থ আমাদের, তা প্রদানে অস্বীকার করে ইসরায়েল আরেকটি বেআইনি কাজ করছে।’ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সদস্যপদ প্রসঙ্গে মনসুর জানান, প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে তারা আইসিসির কাছে আবেদন ১৩ জুন ২০১৪ থেকে কার্যকর করার অনুরোধ করেছে। এতে করে গাজায় ইসরায়েলের গত বছরের হামলাকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে বিবেচনায় নিতে পারবেন আদালত। জাতিসংঘ মহাসচিব জানিয়েছেন, আইসিসিতে ফিলিস্তিনের সদস্যপদ আগামী ১ এপ্রিল থেকে কার্যকর হবে। একই সময় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ আরও ১৬টি আন্তর্জাতিক সংস্থায় যোগদানে সক্ষম হবে। রাষ্ট্রদূত মনসুর বলেন, ‘আমরা যা করেছি তা শুধু সভ্য ও আইনসম্মতই নয়, তা সম্পূর্ণ আমাদের এখতিয়ারের ভেতর। আইসিসিতে আমাদের সদস্যপদের উদ্দেশ্য শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় ন্যায়বিচার প্রার্থনা। জবাবে তারা আমাদের শাস্তি দিতে চায়। এটা অভাবনীয়। আমাদের বিশ্বাস, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তা ঠেকাতে উদ্যোগী হবে।’ ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ দুই বছর ধরেই জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্যপদ লাভের পাশাপাশি আইসিসিতে অন্তর্ভুক্তির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সমর্থন ছাড়া পূর্ণ সদস্যপদ অর্জন সম্ভব নয়। বিকল্প হিসেবে ২০১২ সালের নভেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ‘পর্যবেক্ষক সদস্য’ হিসেবে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়। তখন থেকেই ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ বলে আসছিল, শান্তি আলোচনায় অগ্রগতি না হলে তারা আইসিসিতে যোগ দেবে এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য ইসরায়েলকে এই আদালতের কাঠগড়ায় আনতে চেষ্টা করবে।
বিশেষ করে ইউরোপের প্রভাবশালী কয়েকটি দেশের সাম্প্রতিক সমর্থনে নৈতিকভাবে বলীয়ান হয়ে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এখন আইসিসির মাধ্যমে ইসরায়েলের ওপর চাপ সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছে। তবে এই কূটনৈতিক কৌশলের সুফল পাওয়ার আগে তাদের আপাতত নিজের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই করতে হবে। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা লিখেছে, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষই চায়, ইসরায়েলি শাস্তিমূলক ব্যবস্থার জেরে তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ুক। কারণ, সে ক্ষেত্রে একসময় আব্বাস সরকারের পতন হবে। দখলদার রাষ্ট্র হিসেবে সব দায়দায়িত্ব বর্তাবে ইসরায়েলের ওপর। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ সত্যি সত্যি এই রকম কোনো রণকৌশল অনুসরণ করছে কি না জানতে চাওয়া হলে রাষ্ট্রদূত মনসুর নেতিবাচক জবাব দেন। তবে তিনি স্বীকার করেন, ইসরায়েলের ‘অবৈধ কার্যকলাপ’ অব্যাহত থাকলে তেমন পরিস্থিতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ নিজে তার সীমান্ত এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে না। তার সীমানায় সব আমদানি-রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ করে ইসরায়েল। শুল্ক বাবদ তার সব উপার্জনও আসে ইসরায়েলি হাত ঘুরে। ইসরায়েলের অর্থনৈতিক অবরোধের জেরে আব্বাস সরকারের পতন হলে তার দায়িত্ব নিতে রাজি নয় ফিলিস্তিনিরা। রাষ্ট্রদূত মনসুর বললেন, ‘যদি তেমন অবস্থার সৃষ্টি হয়, সে ক্ষেত্রে আমাদের দোষারোপ করা হবে অযৌক্তিক। ... অধিকৃত অঞ্চলের অধিবাসীরা যদি অনাহার ও রোগভোগের সম্মুখীন হয়, দখলদার হিসেবে আন্তর্জাতিক আইনে জবাবদিহি করতে হবে ইসরায়েলকে।’ ইসরায়েলি দখলের অবসান ও ২০১৭ সালের মধ্যে পূর্ণ স্বাধীনতা দাবি করে গত সপ্তাহে নিরাপত্তা পরিষদে তোলা প্রস্তাবটি ন্যূনতম নয়টি সমর্থনসূচক ভোট না পাওয়ায় নাকচ হয়ে যায়। ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ইঙ্গিত করেছেন, তাঁরা একই প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদে বারবার উত্থাপন করবেন। তাঁর কথায়, ‘আমরা ক্লান্ত হব না, হাল ছেড়ে দেব না।’ এই রণকৌশল কতটা কার্যকর হবে—এ প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রদূত মনসুর বলেন, সব সম্ভাব্য পথই তাঁরা অনুসরণ করবেন। জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্যপদের চেষ্টাও অব্যাহত রাখবেন। তিনি স্মরণ করেন, বাংলাদেশও প্রথম চেষ্টায় জাতিসংঘের সদস্যপদ অর্জন করেনি। চীনের ভেটোর কারণে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।

No comments

Powered by Blogger.