আম বয়ানে শুরু ইজতেমার প্রথম পর্ব by ইকবাল আহমদ সরকার ও এমএ হায়দার সরকার

কঠোর নিরাপত্তা ও ব্যাপক প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে টঙ্গীর তুরাগতীরে এবারের বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব শুরু হয়েছে গতকাল। ইজতেমা সর্বাত্মকভাবে সফল করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সতর্ক নজরদারি ও প্রশাসনের তরফে নেয়া হয়েছে নানা প্রস্তুতি। টঙ্গীর তুরাগ তীরে ফজরের নামাজের পর তাবলীগ জামাতের অন্যতম শীর্ষ মুরব্বি পাকিস্তানের মাওলানা মোহাম্মদ এহসানের আম বয়ানের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে ৫০তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব। পাকিস্তানের ওই মাওলানার বয়ান সঙ্গে সঙ্গেই বাংলায় তরজমা করেন বাংলাদেশের মাওলানা আবদুুল মতিন। দেশ-বিদেশের লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসল্লি আর আলেম-ওলামাদের উপস্থিতিতে এই ইজতেমা শুরু হলেও তাদের রেওয়াজ অনুযায়ী শুরুতে কোন ধরনের আনুষ্ঠানিকতা ছিল না। তিন দিন ধরে ইজতেমায় ইমান, আমল, আখলাখসহ তাবলীগের ৬ উসুল বা মূলনীতির ওপর বয়ান করবেন তাদের শীর্ষ মুরব্বিগণ।  ইতিমধ্যে দেশী-বিদেশী মুসল্লিদের পদচারণায় ইসলামী মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে বিশ্ব ইজতেমা ময়দান। দেশের ৩২টি জেলার কয়েক লাখ মুসল্লি জেলা ভিত্তিক ৪০টি আলাদা খিত্তায় বিভক্ত হয়ে অবস্থান করছেন চটের তৈরি বিশাল প্যান্ডেলের ভেতরে নাম্বার অনুযায়ী খুঁটির পাশের অস্থায়ী নিবাসে। বিশ্বের অর্ধশতাধিক দেশ থেকে পাঁচ হাজারের বেশি সংখ্যক তাবলীগের মেহমান ইজতেমায় অংশ নিচ্ছেন। এর আগে অবরোধের বাধা, ভোগান্তি আর দুর্ভোগ মাথায় নিয়ে রাতভর বাস ট্রেন, টেম্পো যে যেভাবে পেরেছেন সেভাবেই ইস্তেমা ময়দানে এসেছেন। শীতের ভোগান্তি সত্ত্বেও কেবলমাত্র দীনের শিক্ষা গ্রহণ, আল্লাহকে রাজি খুশি আর পরকালে কামিয়াব হতে ইজতেমার কষ্টকে আমলে নিচ্ছেন না ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা। শামিয়ানার নিচে অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে অবস্থান নিয়ে ইজতেমায় আসা মুসল্লিরা মুরব্বিদের বয়ান শুনছেন। বিশ্ব ইজতেমার প্রথম দিন লাখো মুসল্লি তুরাগ তীরে জুমার নামাজ আদায় করেছেন। জুমার নামাজ শেষে লাখো মুসল্লির উপস্থিতিতে শুরু হয়েছে বিভিন্ন ভাষায় বয়ান। ইজতেমা ময়দানকে ঘিরে যেকোন অশুভ শক্তি যেন কোন ধরনের নাশকতা সৃষ্টি করতে না পারে তা এড়াতে পুরো ইজতেমা ময়দান নিরাপত্তার চাদরে মুড়িয়ে দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এ লক্ষ্যে নেয়া হয়েছে পাঁচ স্তরেররের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ইজতেমা এলাকায় দেশী-বিদেশী মুসল্লিদের নিরাপত্তা, নির্বিঘ্নে চলাফেরা,  যে কোন ধরনের নাশকতা থেকে রক্ষাসহ অবরোধের মতো কর্মসূচিকে মাথায় রেখে প্রশাসন নিয়েছে বিশেষ তৎপরতা। তিন ধরনের অবস্থান নেয়ার জন্য নানা আয়োজন নিয়ে মুসল্লিগণ সন্তুষ্ট হলেও অবরোধ নিয়ে, সড়কে ভোগান্তি নিয়ে ক্ষোভের শেষ নেই। পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ জানান, ওই এলাকায় যে কোন ধরনের নাশকতা মোকাবিলা আর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নির্বিঘ্ন করতে র‌্যাব-পুলিশের আধুনিক সব ব্যবস্থাই রয়েছে। দেশী-বিদেশী মুসল্লিদের নির্বিঘ্নে চলাফেরা, প্যান্ডেলে সুশৃঙ্খল অবস্থান, কোন ধরনের নাশকতা থেকে রক্ষাসহ অবরোধের মতো কর্মসূচিকে মাথায় রেখেও পুলিশ প্রশাসনের বিশেষ তৎপরতা রয়েছে। বিএনপির ডাকা অবরোধের কারণে এবার গত বছরের তুলনায় মুসল্লিদের সমাগম অনেক কম হয়েছে। অন্য বছরগুলোয় ইজতেমার জুমার নামাজকে ঘিরে শুক্রবার সকাল থেকে টঙ্গীর চারপাশে যে ধরনের যানজট ও জনস্রোত লেগে থাকতো এবার কিন্তু তেমন চিত্র দেখা যায়নি। বরং সকাল ১০টার দিকেও তার উল্টো চিত্র দেখা গেছে । স্বাভাবিক দিনের চেয়ে টঙ্গীর ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক ও অন্যান্য কয়েকটি সড়কে যানবাহনের সংখ্যা অনেক কম দেখা গেছে । মুসল্লির সংখ্যাও কম দেখা গেছে। এর পরও ইজতেমা ময়দান ও পাশের সড়কজুড়ে ছিল জুমার নামাজের দেশের সবচেয়ে বড় জামাত। শিল্প নগরী টঙ্গী ও আশপাশের লোকজনের যাত্রা ছিল জুমার নামাজ ঘিরে ইজতেমা ময়দানের দিকে। জুমার নামাজের ইমামতি করেন কাকরাইল মসজিদের ইমাম হাফেজ মো. জোবায়ের। জুমার নামাজে দেশের লাখ লাখ মুসল্লির সঙ্গে বিশ্বের ৫১টি দেশ থেকে আগত ৫ হাজার মুসল্লি অংশ নেন। মাগরিবের নামাজের পর ভারতের মাওলানা সা’দ বয়ান করেন। ইজতেমায় বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের তাবলীগ মারকাজের শুরা সদস্য ও তাবলীগের শীর্ষ স্থানীয় মুরব্বিগণ বয়ান পেশ করেন। মূল যে ভাষায়ই হোক তা মূল প্যান্ডেলে বাংলায় এবং বিদেশী নিবাসে প্যান্ডেলে বিদেশীদের অবস্থান অনুযায়ী ইংরেজি, আরবি, তামিল, মালয়, তুর্কি ও ফরাসিসহ বিভিন্ন ভাষায় তাৎক্ষণিক অনুবাদ করা হয়। বিদেশী নিবাসে বিভিন্ন ভাষাভাষি মুসল্লিরা আলাদা আলাদা বসেন এবং তাদের মধ্যে একজন করে মুরব্বি মূল বয়ানকে তাৎক্ষণিক অনুবাদ করে শুনান। এবার আরও যারা বয়ান করবেন তাদের তালিকায় রয়েছেন ভারতের মাওলানা মো. ইসমাইল হোসেন গোদরা, মাওলানা মো. ওমর আলী, ভারতের মাওলানা যোবায়রুল হাসান ও ইসমাইল হোসেন প্রমুখ। বিশ্ব ইজতেমার তিন দিনের কর্মসূচির মধ্যে- রয়েছে আম ও খাস বয়ান, তালিম, তাশকিল, ৬ উছুলের হাকিকত, দরসে কোরআন, দরসে হাদিস, চিল্লায় নাম লেখানো, নতুন জামাত তৈরি, যৌতুক বিহীন বিয়ে। ৩ দিনব্যাপী বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্ব আগামী ১১ই জানুয়ারি রোববার আখেরি মোনাজাতের মধ্যদিয়ে শেষ হবে। তিন দিন ধরে তাবলীগ জামাতের বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের শীর্ষ স্থানীয় আলেম-মুরব্বিগণ ইজতেমার মিম্বর থেকে বয়ান করবেন। আর দীনের শিক্ষা নিয়ে আখেরি মোনাজাতের পর হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ তাবলীগ কর্মী ছড়িয়ে পড়বেন ইসলামের দাওয়াতের কাজে। চার দিন বিরতির পর দ্বিতীয় পর্ব ১৬ই জানুয়ারি শুক্রবার বাদ ফজর থেকে শুরু হবে এবং ১৮ই জানুয়ারি রোববার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে বিশ্ব ইজতেমার সমাপ্তি ঘটবে।

No comments

Powered by Blogger.