শব্দ–ধুলা–ধোঁয়ায় মানুষের ভোগান্তি- আবাসিক এলাকায় কেসিসির অ্যাসফল্ট প্ল্যান্ট by মামুনুর রশীদ

(খুলনার বয়রা আবাসিক এলাকায় পার্কের জন্য নির্ধারিত এই স্থানে বসানো হয়েছে সিটি করপোরেশনের অ্যাসফল্ট প্ল্যান্ট। কারখানা চালু থাকলে সারাক্ষণই এমন ধুলাবালু উড়তে থাকে। সম্প্রতি তোলা ছবি l প্রথম আলো) নিয়ম লঙ্ঘন করে খুলনা সিটি করপোরেশনের (কেসিসি) অ্যাসফল্ট প্ল্যান্টটি নগরের বয়রা আবাসিক এলাকায় পার্কের জন্য নির্ধারিত স্থানে বসানো হয়েছে। রাস্তার কার্পেটিংয়ের জন্য বালু, পাথর ও পিচের বিশেষ মিশ্রণ তৈরি করা হয় এ প্ল্যান্ট থেকে। কারখানার শব্দ, ধুলা ও ধোঁয়ায় ভোগান্তি পোহাচ্ছে আবাসিক এলাকার মানুষ। ছয়-সাত বছর আগেই প্ল্যান্টটির জীবৎকাল (লাইফটাইম) শেষ হয়েছে। এ কারণে বর্তমানে প্ল্যান্টটি থেকে শব্দ-ধুলা-ধোঁয়ার পরিমাণও বেড়েছে। ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এলাকার হাজারো মানুষসহ প্ল্যান্টটির ৩০০ গজের মধ্যে স্থাপিত বিশেষায়িত একটি হাসপাতালের রোগী ও একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। তা ছাড়া আবাসিক এলাকায় এ প্ল্যান্টটি স্থাপনে সিটি করপোরেশন কোনো পরিবেশ ছাড়পত্রও নেয়নি বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগী ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, ষাটের দশকের শেষের দিকে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ নগরের বয়রা এলাকায় আবাসিক প্রকল্পের জন্য ১৩০ একর জমি অধিগ্রহণ করে। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে চার শতাধিক প্লট বরাদ্দ শুরু হয়। ১৯৯৬ সালে আবাসিক এলাকার রাস্তাঘাট, পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা ও পার্কের অবকাঠামো নির্মাণের জন্য গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ তা কেসিসিকে হস্তান্তর করে। ওই বছরই প্রকল্পের নকশা অনুসারে আবাসিক এলাকার বি ব্লকে প্রায় দুই একরের যে জায়গাটি পার্কের জন্য নির্ধারিত ছিল, সেখানে কেসিসি প্ল্যান্টটি বসায়।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, প্ল্যান্টসহ আশপাশের এলাকা ঝাঁজলো ধোঁয়া ও ধুলায় আচ্ছন্ন। সেই সঙ্গে তীব্র শব্দ দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। প্ল্যান্টের আশপাশের সব কটি বাড়ির দরজা-জানলা বন্ধ। এর এক থেকে দেড় শ গজের মধ্যে রয়েছে একটি বড় লেক, বয়রা গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ, কাঁচাবাজার ও একটি নগর স্বাস্থ্যকেন্দ্র। ৩০০ গজের মধ্যে রয়েছে শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতাল, নাবিক কলোনি ও নৌবাহিনী স্কুল অ্যান্ড কলেজ।
প্ল্যান্টে দায়িত্বরত কেসিসির সহকারী প্রকৌশলী (মেকানিক্যাল) শরিফুল ইসলাম জানান, প্ল্যান্টটিতে প্রতিদিন তিন থেকে পাঁচ টন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন ১৮-১৯ ট্রাক মিশ্রণ তৈরি হয়। এর প্রধান উপকরণ পাথর, মোটা দানার বালু ও বিটুমিন। তবে প্ল্যান্টের ধুলা, ধোঁয়া ও অতিরিক্ত শব্দের বিষয়ে তিনি জানান, প্ল্যান্টটির জীবৎকাল শেষ হওয়ায় এর শব্দ ও বর্জ্যের পরিমাণ দুটিই বেড়েছে।
আবাসিক এলাকার বি ব্লকের বাসিন্দা প্রকৌশলী আসলাম পারভেজ ক্ষোভের সঙ্গে জানান, ধুলা ও ঝাঁজালো ধোঁয়ার জন্য দিন-রাত ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ রাখতে হয়। বয়রা হাউজিং এস্টেট-বি ব্লক কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ রকিবুল ইসলাম জানান, প্ল্যান্টটি সরিয়ে নিতে স্থানীয় লোকজনের উদ্যোগে কয়েকবার প্রতিবাদ ও মানববন্ধন হলেও কেসিসি ব্যবস্থা নেয়নি। প্ল্যান্টটির দূষণে এলাকার শিশু-বৃদ্ধসহ হাজারো মানুষ শ্বাসজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। শেখ আবু নাসের বিশেষায়িত হাসপাতালের উপপরিচালক এম এ আলী জানান, প্ল্যান্টটির ধোঁয়া এবং ধুলা থেকে তাঁর হাসপাতালের রোগীরাও নিরাপদ নন।
এ বিষয়ে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ খুলনা বিভাগীয় কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাঈদ রেজা জানান, পার্কের অবকাঠামো নির্মাণের জন্য তারা জায়গাটি কেসিসিকে হস্তান্তর করেছিল; অ্যাসফল্ট প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য নয়। এলাকার মানুষের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্ল্যান্টটি সরিয়ে নিতে তারা একাধিকবার কেসিসিকে চিঠি দিয়েছে। কিন্তু উত্তর মেলেনি। এ প্ল্যান্টের জন্য বর্তমানে কাছাকাছি জায়গার একটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টের কার্যক্রমও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়ক মাহফুজুর রহমান জানান, পরিবেশ আইন অনুসারে আবাসিক এলাকার তিন কিলোমিটারের মধ্যে এ ধরনের প্ল্যান্ট স্থাপনের নিয়ম নেই। পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়া কীভাবে এটা স্থাপিত হলো, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি। প্ল্যান্টটি সরিয়ে নেওয়া হবে কি না, জানতে চাইলে কেসিসির প্রধান প্রকৌশলী নজরুল ইসলাম জানান, নতুন প্ল্যান্ট বসানোর জন্য নির্ধারিত জায়গায় মাটি ভরাটের কাজ চলছে। এর পরও এটি সরিয়ে নিতে কমপক্ষে দুই বছর লাগবে। এ সময়ের মধ্যে প্ল্যান্ট থেকে বের হওয়া ধোঁয়া এবং ধুলার পরিমাণ যাতে কমিয়ে আনা যায়, এ জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে। খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান জানান, প্ল্যান্টটি স্থাপনের সময় সেখানে বসতি ছিল না। তবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ওই এলাকা থেকে প্ল্যান্টটি সরিয়ে নিতে কাজ করছেন তাঁরা।

No comments

Powered by Blogger.