বিজেপি নেতার বক্তব্য প্রসঙ্গে by ড. নিমচন্দ্র ভৌমিক

ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) কেন্দ্রীয় নেতা তথাগত রায়ের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে গেছে। তারা কয়েকটি সভা ও অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন এবং বক্তব্য দিয়েছেন। ড. মাহবুব উল্লাহ ৬ জানুয়ারি যুগান্তরে প্রকাশিত এক নিবন্ধে ২ জানুয়ারি বেদান্ত সংস্কৃত মঞ্চের সভায় বিজেপি নেতা তথাগত রায়ের বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন এবং নিজ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। তার এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তথাগত রায়ের বক্তব্যের অপব্যাখ্যা করা হয়েছে বলে মনে করি। এ বিষয়ে সঠিক তথ্যটি সবার অবহিত হওয়া প্রয়োজন। মঞ্চের আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তথাগত রায় যা বলেছেন তার সারাংশ হল- আমি বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে এটা বলতে পারি না, তবে বাংলাদেশের বিষয়টা ভিন্ন, আপনাদের বোঝার জন্য বলছি। ভারত সরকার আওয়ামী লীগ সরকারকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে। ভারত সরকার উপলব্ধি করেছে, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার চেয়ে ভালো কোনো সরকার হতে পারে না। এখানকার হিন্দুদের জন্যও এর চেয়ে ভালো সরকার কি হতে পারে? আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য কোনো সরকারের ওপর ভরসা করা যায়? যদি অন্যদের ওপর ভরসা করা না যায়, তাহলে পুরো সমর্থন আওয়ামী লীগকে দিন। বাংলাদেশের পাওনা ভারত বুঝিয়ে দেবে। তিস্তা চুক্তি হবে ও স্থলসীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়িত হবে- এটি নিশ্চিত করেই বলতে পারি। তিনি পরিসংখ্যান উল্লেখ করে এও বলেন, পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান জনগোষ্ঠীর আনুপাতিক হার বেড়ে গেছে।
ড. মাহবুব উল্লাহ বলেছেন, ৫ জানুয়ারি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পালন করেছে গণতন্ত্রের বিজয় দিবস। অন্যদিকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট গণতন্ত্র হত্যা দিবস হিসেবে পালন করেছে। দেশে বিরাজ করছে টানটান উত্তেজনা। তার অভিমত, তথাগত রায়ের যুক্তিতে বোঝা যায়, ভারত সরকার আওয়ামী লীগ সরকারকে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে এবং হিন্দু ধর্মীয় লোকদের প্রকাশ্যে এ সরকারকে সমর্থন জানানোর আহ্বান জানিয়েছে, যা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নগ্ন হস্তক্ষেপ ছাড়া আর কী হতে পারে? তার বক্তব্য অনুযায়ী, তথাগত রায়ের বক্তব্যে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টির পরিষ্কার উসকানি বিদ্যমান। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু প্রশ্নটি অবান্তর। এ কথাটি বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া একাধিকবার স্পষ্ট করে দিয়েছেন। তার দৃষ্টিতে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে আমরা সবাই বাংলাদেশী। তথাগত রায়ের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অন্য দেশের চেয়ে আলাদা। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের দাদাগিরি সুবিদিত। বাংলাদেশের সৎ আকাক্সক্ষা ও শুভেচ্ছা ভারতের বৃহৎ প্রতিবেশীসুলভ দাম্ভিকতার ফলে এগোতে পারে না। পৃথিবীর অনেক দেশেরই বৃহৎ প্রতিবেশী থাকে। তবে বাংলাদেশ যে বৃহৎ রাষ্ট্রকে প্রতিবেশী হিসেবে পেয়েছে, তার আচরণ অন্য যে কোনো বৃহৎ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের আচরণকে ম্লান করে দেবে। তিনি সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের কথা তুলে ধরেছেন, পানি সমস্যার বিষয় উল্লেখ করেছেন, পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা সম্পর্কে তথাগত রায় বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়েছেন বলেও উল্লেখ করেছেন। পাশাপাশি নির্বাচনের সময় ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বক্তব্যেরও সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ভারতীয় কংগ্রেসের ভরাডুবির পর বিএনপিকে আশ্বস্তবোধ করতে দেখা গেছে। বিএনপি দ্রুত গতিতে মোদির বিজয়কে অভিনন্দিত করেছে।
ড. মাহবুব উল্লাহ অভিমত ব্যক্ত করেছেন- ভারত একটি সম্প্রসারণবাদী রাষ্ট্র। পাশাপাশি বলেছেন, বর্তমান ভারত সরকার বাংলাদেশে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্পর্কে কী মনোভাব পোষণ করছে তা তিনি জানেন না। তবে মোদি যদি বাংলাদেশ সফরে এসে এ সুযোগে সেরকম একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার জন্য জনচক্ষুর আড়ালেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি তাগাদা দেন, তাহলে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেয়ার পথে সেটি হবে একটি শুভ উদ্যোগ। নরেন্দ্র মোদির সরকার নিশ্চয়ই তার কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে অবগত আছেন, বাংলাদেশে গত ছয় বছরে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা খুব শান্তিতে দিনাতিপাত করতে পারেননি। তাদের মন্দির-বিগ্রহ ধ্বংস করা হয়েছে। এসব ঘটেছে কিছু ক্ষমতাধর ব্যক্তির লোভের ফলে। ক্ষমতাসীন দল এদের কতটা নিবৃত করতে পেরেছে সেটিও দেখার বিষয়।
বাংলাদেশের দীর্ঘ ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ভারত ও বাংলাদেশ পরস্পরের প্রতিবেশী দেশ এবং বিশ্বস্ত বন্ধু। আমাদের প্রতিটি গণআন্দোলনে ভারত নৈতিক সমর্থন দিয়েছে এবং উন্নয়ন-অগ্রগতিতে সহযোগিতা করছে। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারত সর্বাত্মকভাবে আমাদের সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। দলমত নির্বিশেষে ভারতবাসী এগিয়ে এসেছেন।
বিজেপির প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি তৎকালীন বিরোধী দলের অন্যতম নেতা অটল বিহারী বাজপেয়ী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। সর্বদয়নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ ৭১-এর সেপ্টেম্বরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দিল্লিতে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। ভারত শরণার্থীদের আশ্রয়, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে লাখ লাখ বাঙালির সঙ্গে হাজার হাজার মিত্র বাহিনীর সৈন্যও মৃত্যুবরণ করেছেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে দ্রুততম সময়ে ১৯৭২ সালের মার্চে মিত্র বাহিনীকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। এ ধরনের ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
দীর্ঘ মুক্তি সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গণপরিষদ ১৯৭২ সালে অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সংবিধান রচনা করে, যা পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান হিসেবে স্বীকৃত। স্থলসীমান্ত চুক্তি, গঙ্গার পানির ব্যাপারে অস্থায়ী সমঝোতা ও অন্যান্য চুক্তিও সম্পাদিত হয়। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাতিল ও অন্যান্য নীতিমালাকে অকার্যকর করে ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক বিভেদগামী শক্তিকে পুনর্বাসিত করা হয়। বিএনপি এ ধারাকে ধারণ করেই রাজনীতি করতে থাকে। স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু দলে দলে দেশত্যাগ করতে থাকে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলতে থাকে এবং দ্বিপাক্ষিক আলোচনা অব্যাহত থাকে। ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার ভারত সফরের সময় সমঝোতা স্মারকে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে অভিবাসী বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় এসে ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানি চুক্তি স্বাক্ষর করে। ভারতের কংগ্রেসি-অকংগ্রেসি সব সরকার ও দলই বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান ও ক্রান্তিলগ্নে নৈতিক সমর্থনসহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। পাশাপাশি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগের বিষয়ে তাদের উৎকণ্ঠা প্রকাশ পেয়েছে।
এ প্রেক্ষাপটে এবং বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির আলোকে বিজেপি নেতার বক্তব্য যথাযথ বলে মনে করি। প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগেও ভারত নির্বাচনের মাধ্যমে সংবিধান ও গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখার প্রতি সমর্থন দিয়েছে। নির্বাচনের পর সরকারকে শুধু ভারত নয়, রাশিয়া ও চীনও সমর্থন দিয়েছে। পরবর্তী সময়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ও জাপান এ সরকারকে মেনে নিয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা এবং শীর্ষ পর্যায়ের যোগাযোগ ও বক্তব্যে আশা করা যায়, শিগগিরই তিস্তা চুক্তি হবে এবং সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়িত হবে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও সংযোগ ও সহযোগিতা এগিয়ে চলেছে। আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে সমুদ্রসীমাও নির্ধারিত হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের সঙ্গে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতা অব্যাহত রয়েছে এবং বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ড. মাহবুব উল্লাহ একদিকে হস্তক্ষেপের কথা বলছেন, অন্যদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার জন্য তাগাদা দেয়ারও অনুরোধ জানাচ্ছেন। এটা দ্বৈতনীতি (ডাবল স্ট্যান্ডার্ড) নয় কি? প্রসঙ্গত, বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতা নজরুল ইসলাম খান ভারতের টাইমস অব ইন্ডিয়াকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ভারতকে তার ভাষায় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে সহায়তা করার আহ্বান জানিয়েছেন। ভারত বৃহৎ প্রতিবেশী ও শক্তিশালী দেশ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলংকা, ভুটান, মালদ্বীপসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সীমান্তসহ অন্যান্য সমস্যা প্রায় সমাধান করেছে এবং দেশগুলোর অখণ্ডতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে সামরিকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োজনে সহযোগিতা করছে। সেক্ষেত্রে ভারতকে সম্প্রসারণবাদী আখ্যা দেয়া কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত নয়। আসুন শান্তি, গণতন্ত্র ও অগ্রগতির পথে আমরা সবাই এগিয়ে যাই।
ড. নিমচন্দ্র ভৌমিক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক রাষ্ট্রদূত

No comments

Powered by Blogger.