এ ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতিতে সবাই অসহায় থাকতে পারি না by মইনুল হোসেন

পুলিশকে যদি স্বাধীন ভূমিকা পালন করার সুযোগ দেয়া হতো কেবল তখনই এ কথা বলা সম্ভব হতো যে, গত ৫ জানুয়ারি বিএনপিকে জনসভা করতে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো বাধা দেয়া হয়নি। আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে পুলিশকেই সভা অনুষ্ঠানের ব্যাপারে বিধিনিষেধ আরোপের সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। তাহলে একে পুলিশি শক্তির অপব্যবহার হিসেবে দেখা যেত না। পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, গোয়েন্দা বিভাগের কাছে তথ্য রয়েছে যে, অবরোধ আন্দোলনে র‌্যাব ও পুলিশ সদস্যদের মনোবল ভেঙে দেয়ার জন্য তাদের ওপর পরিকল্পিতভাবে হামলা চালানো হচ্ছে। সংঘর্ষ শুরুই হয়েছে পুলিশকে অতিমাত্রায় রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করতে গিয়ে। পুলিশের দায়িত্ব সভা-সমাবেশ বন্ধ করা নয়, সভা-সমাবেশের আইন-শৃংখলা রক্ষা করা। এভাবেই পুলিশ গণতান্ত্রিক দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে।
সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা থেকেই আন্দোলনের সূচনা হয়েছে। ওইদিন (৫ জানুয়ারি) বিপুলসংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করতে দেখা গেছে এবং তারা বিএনপি নেতাকর্মীদের ক্ষিপ্রগতিতে গ্রেফতার করেছে। সবচেয়ে খারাপ হয়েছে দলটির শীর্ষ নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে পুলিশ বেষ্টনীতে অবরুদ্ধ রাখা। সরকার জনসমর্থন হারিয়ে কতটা দুর্বল হয়ে পড়েছে এ ধরনের কর্মকাণ্ডে সেটাই প্রকটরূপে জনসম্মুখে ধরা পড়েছে। এমনকি পুলিশের বেষ্টনীও তাদের কাছে যথেষ্ট বলে বিবেচিত হয়নি। তাই সরকারকে দরজায় তালা দিয়ে ইট-বালু ভর্তি ট্রাক জড়ো করে পথ অবরোধ করতে হয়েছে যাতে বেগম খালেদা জিয়া বেরিয়ে জনসভায় না যেতে পারেন। তাকে লক্ষ করে মরিচের গুঁড়া ছিটানো হয়েছে। ভেবে কষ্ট হয়, রাজনীতির নামে আর কত নোংরামি দেখতে হবে আমাদের!
অনেক আগে থেকেই সরকারের মন্ত্রীরা এবং তাদের লোকেরা এ ধরনের পরিকল্পনার কথা পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে আসছিলেন এবং তারা বলছিলেন যে, বিএনপি নেতাকর্মীদের রাস্তায় বেরোতে দেয়া হবে না। তারা নিজেদের ভয়ভীতি ও আতংকের বিষয়টিও পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন এ ইঙ্গিত দিয়ে যে, তাদের মধ্যে যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকার বেপরোয়া সংকল্প কাজ করছে। আর তাই সংলাপ ও নির্বাচনের ব্যাপারে সরকার তীব্র অনীহা দেখিয়ে যাচ্ছে। বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতার সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম হল জনগণের ভোটের স্বাধীনতা। তাই এভাবে নির্বাচন না দিয়ে শুধু দল বা ব্যক্তির বাক স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে না, সমগ্র জনগণের বাক স্বাধীনতা অস্বীকার করা হচ্ছে।
অবাধ নির্বাচনের প্রশ্নে জনগণকে মোকাবেলা করার অনিচ্ছা থেকে সরকার তার প্রিয় বক্তব্যই রেখে চলেছে- নতুন করে নির্বাচনও হবে না, সংলাপও হবে না। জনগণের ভোট ও জনমতের তোয়াক্কা না করেই তারা ক্ষমতায় থাকবে। এ ধরনের ভাষা পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশে তো চলার কথা নয়।
গণতন্ত্রের যে সংজ্ঞাই দেয়া হোক না কেন, অবাধ নির্বাচন এড়িয়ে এবং বিরোধীদের কোনো সভা-সমাবেশ করতে না দিয়ে গণতন্ত্র চর্চার কথা বলা কারও মুখে মানায় না। এটা করার অর্থ আসলে সংঘাত-সংঘর্ষকে আমন্ত্রণ জানানো। এ কারণেই আমরা বেদনার্ত হয়ে এ কথা বলতে বাধ্য হয়েছি যে, আমাদের কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্ব নেই- যে নেতৃত্ব দেশকে বিচার বিবেচনা সহকারে শান্তিপূর্ণ পথে পরিচালনা করতে সক্ষম।
জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার, পুলিশি ক্ষমতার রাজনৈতিক ব্যবহার এবং সরকারের গণতান্ত্রিক বৈধতার মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাবলীকে কোনোভাবেই উদ্ভূত সংকট থেকে আলাদা করে দেখা যাবে না। সর্বস্তরে ক্ষমতার অপব্যবহার এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদের লুটপাট জনগণ হৃষ্টচিত্তে মেনে নেবে- এ কথা ভাবার কোনো কারণ দেখি না। এ দেশের জনগণের সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস জানতে হবে। তারা নানা ধরনের শোষণ ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে, জীবন দিয়েছে এবং এখনও দিচ্ছে। সরকারের সঙ্গে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব কেবল বিএনপির মধ্যে সীমাবদ্ধ এটিও ভুল ধারণা। অধিকারহারা জনগণের দুঃসহ জীবনের কথা অস্বীকার করার নয়।
বিএনপিকে নির্মূল করতে পারলেই বর্তমান সরকার জনগণের কাছে ন্যায্য অথবা অধিকতর গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে এটাও সত্য নয়। সরকারের পক্ষে যদি সম্ভব হয় তবে এমন চিন্তা বদলে ফেলাই ভালো হবে।
নিরপেক্ষ নির্বাচনের আতংকে তো তাদেরই ভোগার কথা, যাদের জনগণের ওপর আস্থা নেই। জনগণের ওপর সরকারের আস্থা থাকলে তারা তো অবাধ নির্বাচন দিয়ে তা প্রমাণ করতে পারেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আওয়ামী লীগ তার গৌরবোজ্জ্বল গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের কথা ভুলে জনগণের ভোটে অবিশ্বাসী দলে পরিণত হয়েছে। ন্যায়-অন্যায়ের তোয়াক্কা না করে একশ্রেণীর
রাষ্ট্রীয় সুবিধাভোগী জনগণের শাসনের পরিবর্তে দলনেত্রীকে গোষ্ঠীবিশেষের স্থায়ী শাসনের স্বপ্ন দেখাচ্ছে।
জনগণের ভোটের মাধ্যমে রাজনৈতিক সংকট মোকাবেলা করার পরিবর্তে পুলিশি শক্তির ওপর নির্ভরতা সরকারের দুটি দুর্বলতাকে প্রকট করে তুলেছে। প্রথমত, জনসমর্থনের ব্যাপারে সরকারের নিজের আত্মবিশ্বাসের অভাব। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিকভাবে সমস্যা মোকাবেলার যোগ্যতা দেখাতে অপারগতা। বিএনপির জনসভা অনুষ্ঠানের ফল কী হয় সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করারও ধৈর্য ছিল না সরকারের। ফলে সরকার এটাই প্রমাণ করল- সে জনগণকে ও জনসমাবেশকে কত ভয় পায়।
অন্যদিকে বিএনপির ত্রুটি হচ্ছে, দলটি কোনো পরিষ্কার গণতান্ত্রিক বিকল্প প্রস্তাব উপস্থাপন করতে পারছে না। ঘুরেফিরে একই রাজনীতিতে বৃত্তবন্দি থাকা গণতান্ত্রিক রাজনীতি হতে পারে না। তাদের আন্দোলনে জনগণের ক্ষোভও যুক্ত হচ্ছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু দলীয় লোকদেরসহ অন্যদের নিয়ে বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন গড়ে তোলার চিন্তাভাবনা করতে পারছে না বিএনপি।
বাস্তবতা হল, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পালাক্রমে ক্ষমতায় যাওয়ার নির্বাচনসর্বস্ব গণতন্ত্রের চর্চা করতে গিয়ে গণতন্ত্রের আজ মরণ দশা। গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের পবিত্রতা নেই। উভয় দল মিলেই আইনের শাসন পঙ্গু করেছে। পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করেছে। তাই বিএনপির আন্দোলন ক্ষমতা দখলের দলীয় সংগ্রাম হিসেবেই চিত্রিত হচ্ছে। এ কথার অর্থ এই নয় যে, ধ্বংসাত্মক পরিস্থিতির সহজে অবসান হবে।
যারা ক্ষমতায় আছেন তারা নিজেদের জনপ্রিয় দাবি করছেন, কিন্তু নির্বাচনের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত নন। বিরোধী দলকে দাবিয়ে রাখতে কত পুলিশের দরকার হচ্ছে সেটা কোনো বিষয় নয়। আসলে তারা সংকট উত্তরণের কোনো যুক্তিসঙ্গত পথ খুঁজতে চাইছেন না এবং প্রকারান্তরে নিজেদের নিজেরাই প্রতারিত করছেন।
সরকারের পেছনে জনসমর্থন না থাকাটা যে কোনো সরকারের জন্য মারাত্মক দুর্বলতা। বর্তমান সরকার নির্বাচনী বৈধতা দাবি করে থাকে; কিন্তু বাস্তবে সে বৈধতা তার নেই। সংঘবদ্ধ কিছু অতিলোভী লোকের সরকার নড়বড়ে ভিত্তির সরকার না হয়ে পারে না। এ রকম সরকারকে সর্বদা অনিশ্চয়তার ভয়ে থাকতে হয়-কখন কী হয় এ আশংকায়।
অথচ সবাই মিলে সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সবার জন্য শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজটি অধিকতর সহজ। তবে এটুকু বুঝতে হবে যে, দলতন্ত্র চালিয়ে যাওয়ার সময় শেষ হয়ে গেছে। এ ধরনের অবাস্তব চেষ্টা সংঘাত-সংঘর্ষ আর রক্তপাতকেই দীর্ঘায়িত করবে। জাতি যখন অশুভ ভবিষ্যতের সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন যারা ক্ষমতার লড়াইয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় তাদেরও অসহায় থাকতে হবে এটা মেনে নেয়া যায় না। সবাই মিলেই তো জনগণ।
কথায় কথায় মুক্তিযোদ্ধা বা রাজাকারদের বিষয়টিকে টেনে এনে সমস্যা সমাধানের বিপক্ষে কাজ করার সুযোগ নেই। কারণ চলমান আন্দোলন জনগণের সার্বভৌম অধিকার সম্পর্কিত আন্দোলন- জনগণের ভোটের অধিকার। কারা কোন ধরনের রাজাকার বা মুক্তিযোদ্ধা জনগণই তা নির্ধারণের মালিক। এটা কোনো ব্যক্তির খেয়ালখুশির ব্যাপার নয়।
আমরা তো দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচন ও গণতন্ত্র চর্চা দেখে আসছি। আজ আমাদের অবস্থান যার যেখানেই হোক না কেন, দলীয় সম্পৃক্ততা থাকুক বা না-ই থাকুক, সবাইকে এটা উপলব্ধি করতে হবে যে, গণতন্ত্র তথা জনগণের শাসন বিনির্মাণের কাজটি দলীয় ব্যাপার নয়, এটা জাতীয় দায়িত্ব এবং সেই দায়িত্ব পালনে আমাদের প্রত্যেকের ভূমিকা রয়েছে। রাষ্ট্রীয় শক্তি জনগণেরই শক্তি। এই শক্তির অপব্যবহার কাম্য নয়।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন : আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ

No comments

Powered by Blogger.