ট্যাংকারের তেলে ভাসছে সুন্দরবন by রাশিদুল ইসলাম

সুন্দরবনের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জের মধ্যবর্তী শেলা নদীর মৃগমারী এলাকায় মালবাহী জাহাজের ধাক্কায় সাড়ে তিন লক্ষাধিক জ্বালানি তেল বোঝাই ‘ওটি সাউদার্ন স্টার-৭’ তলা ফেটে তেল নদীতে মিশে যাওয়ায় বিস্তীর্ণ এলাকার পানি বিষাক্ত হয়ে পড়েছে। এতে মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য। এ ঘটনা তদন্তের জন্য স্থানীয়ভাবে পূর্ব বনবিভাগের এসিএফ আবুল কালাম আজাদকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। অপরদিকে সুন্দরবনে তেলবাহী ট্যাংকার ডুবির ঘটনায় তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে সরকার। বুধবার সচিবালয়ে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান সাংবাদিকদের বলেন, সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের নটিক্যাল সার্ভেয়ার অ্যান্ড এক্সামিনার ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন আহমেদকে কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে। এছাড়া সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট গোলাম মাইনুদ্দিন হাসান ও সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের খুলনার অভ্যন্তরীণ জাহাজ পরিদর্শনালয়ের পরিদর্শক মোহাম্মদ আবু জাফর মিয়া এই তদন্ত কমিটিতে আছেন। ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। মন্ত্রী জানিয়েছেন, ট্যাংকারটিকে উদ্ধারের জন্য দুটি উদ্ধারকারী জাহাজসহ তিনটি জাহাজ পাঠানো হয়েছে। এদিকে উদ্ধারকারী জাহাজ প্রত্যয় বরিশাল থেকে এবং নির্ভীক নারায়ণগঞ্জ থেকে ঘটনাস্থলে উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। সন্ধ্যা নাগাদ এ দু’টি জাহাজ ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছবে বলে বন বিভাগের সূত্রে জানা গেছে। দুপুরে বন ও পরিবেশ উপমন্ত্রী আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব, বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব খন্দকার রকিবুর রহমান, প্রধান বন সংরক্ষক মো. ইউনুস আলী, বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মো. শুকুর আলীসহ বনবিভাগ ও মংলা বন্দরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এ ঘটনায় সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) আবুল কালাম আজাদ একটি সাধারণ ডায়েরি ও মেসার্স হারুন অ্যান্ড কোম্পানির ম্যানেজার গিয়াস উদ্দিন বাদী হয়ে এমভি টোটালের নামে একটি পিওআর (প্রসিকিউশন ওপেনস রিপোর্ট) মামলা দায়ের করেছে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত জাহাজের মাস্টার মোকলেস (৫০) নিখোঁজ রয়েছেন। সূত্র জানায়, মঙ্গলবার ভোররাতে এক মালবাহী জাহাজের ধাক্কায় তলা ফেটে ‘এমভি ওটি সাউদার্ন স্টার সেভেন’ নামের একটি তেলবাহী ট্যাংকার ডুবে যায়। ওই ট্যাংকারে থাকা তিন লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৮ লিটার তেল ছড়িয়ে পড়ায় পুরো এলাকায় এখন তেল ভাসছে। এতে সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ গাছের শ্বাসমূলে তেলের আস্তরণ পড়ছে। যে স্থানে জাহাজডুবি হয়েছে ওই এলাকাটি বিলুপ্তপ্রায় ইরাবতী ডলফিনসহ ছয় প্রজাতির ডলফিনের অভয়াশ্রম। পানিতে তেল ছড়িয়ে পড়ায় ডলফিন ও সুন্দরবনের সমৃদ্ধ মৎস্যভাণ্ডারসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী-গাছপালা ক্ষতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও পরিবেশবিদ ড. সরদার শহিদুল ইসলাম জানান, তেলবাহী ট্যাংকার ফেটে যাওয়ায় সুন্দরবনের নদ-নদীতে তেল ছড়িয়ে পড়ায় সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়বে। এ ছাড়া এই তেল জোয়ারভাটার সঙ্গে বনের অভ্যন্তরে তেলের প্রলেপ জমে গেলে বনের মৎস্যসম্পদ ও পশু-পাখিসহ পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। সুন্দরবন পূর্ব বিভাগ বাগেরহাটের ডিএফও আমীর হোসাইন চৌধুরী জানান, জাহাজটি আটকের চেষ্টা চলছে। ডুবে যাওয়া জাহাজ শনাক্ত ও নিখোঁজ ব্যক্তিকে উদ্ধারে সকাল ১০টা থেকে স্থানীয় ডুবুরি দল, কোস্টগার্ড ও সুন্দরবন বন বিভাগ অভিযান শুরু করেছে। নৌবাহিনীও ডুবে যাওয়া জাহাজ শনাক্তের কাজ করছে। ঘটনার জন্য দায়ী পরিবেশ দূষণকারী জাহাজটির বিরুদ্ধে মামলা করা হবে বলে তিনি জানান।
মংলা কোস্ট গার্ড পশ্চিম জোনের কনটিনজেন্ট কমান্ডার ক্যাপ্টেন মেহেদী মাসুদ জানান, তেলের ব্যাপ্তি সুন্দরবনের আশপাশের প্রায় ২০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। দুর্ঘটনাকবলিত নৌযানটির মালিকপক্ষের বরাত দিয়ে এই কোস্টগার্ড কর্মকর্তা আরও জানান, গোপালগঞ্জের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য খুলনার পদ্মা অয়েল কোম্পানির ডিপো থেকে তিন লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৪ লিটার ফার্নেস অয়েল নিয়ে সোমবার বিকালে রওনা হয়েছিল জাহাজটি। রাতে জাহাজটি চাঁদপাই রেঞ্জের জয়মণি ঘোলের কাছে শেলা নদীতে নোঙর করেছিল। ভোর ৫টার দিকে ঘন কুয়াশার মধ্যে আবার যাত্রা শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যে ‘টোটাল’ নামের একটি খালি কার্গো জাহাজ পেছন থেকে সাউদার্ন স্টারকে ধাক্কা দেয়। এতে সাউদার্ন স্টারের তলদেশের একপাশ (খোল) ফেটে যায় এবং জাহাজটি তলিয়ে যায়। টোটাল নামের কার্গো জাহাজটি মংলা বন্দরে পণ্য খালাসের পর চট্টগ্রামের দিকে যাচ্ছিল বলে ক্যাপ্টেন মেহেদী মাসুদ জানান। এর আগে গত ২৪শে নভেম্বর সোমবার ভোরে বাগেরহাটের পূর্ব সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জের হরিণটানা এলাকায় তলা ফেটে নিমজ্জিত হয় যাত্রীবাহী লঞ্চ এমভি শাহীদূত। তবে যাত্রীবাহী হলেও সুন্দরবনের পর্যটক পরিবহন কাজে ভাড়ায় পরিচালিত হচ্ছিল। দুর্ঘটনার সময় লঞ্চে কোন পর্যটক না থাকায় এবং মাস্টারসহ অন্য কর্মচারীরা সাঁতরিয়ে তীরে ওঠায় কেউ হতাহত কিংবা নিখোঁজ হননি। এ দুর্ঘটনার দিনই সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের চলতি দায়িত্বে থাকা প্রধান প্রকৌশলী এ কে এম ফখরুল ইসলাম দুই সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। কমিটির আহ্বায়ক নাজমুল হক এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, আন্তর্জাতিক নৌ সংস্থার (আইএমও) একটি কর্মশালায় অংশগ্রহণের জন্য ২৫শে নভেম্বর থেকে ৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনি লন্ডনে অবস্থান করেন। এ কারণে এখনও প্রতিবেদন জমা দিতে পারেননি। এদিকে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে শেলা নদীতে ১৫ দিন আগে নিমজ্জিত বড় আয়তনের লঞ্চ এমভি শাহীদূত উদ্ধার করা সম্ভব না হওয়ায় ওই পথ দিয়ে নৌযান চলাচল করতে পারছে না।

No comments

Powered by Blogger.