গানম্যান নিয়ে চলেন চট্টগ্রামের যুবলীগ ক্যাডার বাবর

তিনি মন্ত্রীও নন, এমপিও নন। নন কোনো ভিআইপি কিংবা সিআইপিও। তবুও তিনি চলেন গানম্যান নিয়ে। সব সময় দু’জন গানম্যান থাকে তার সঙ্গে। সকালে কিংবা বিকালে দিনে কিংবা রাতে যেখানেই যান সঙ্গে থাকেন গানম্যান। তবে এসব গানম্যান সরকারি নয়। বেসরকারি। ঢাকার একটি বেসরকারি সিকিউরিটি কোম্পানি থেকে রিক্যুইজিশনে নেয়া। ‘গুরুত্বপূর্ণ’ এ ব্যক্তির নাম হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর। এক সময় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকায় তার নাম থাকলেও এখন তিনি যুবলীগ নেতা। কেন্দ্রীয় যুবলীগের সহ-অর্থ সম্পাদক তিনি। সাম্প্রতিক রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের টেন্ডারবাজি নিয়ে ডাবল মার্ডারের একটি ঘটনায় আসামি হওয়ার পর তিনি কেন্দ্রীয় সদস্যের পদ থেকে বহিষ্কার হন। ওই মামলায় হাইকোর্ট থেকে জামিনে আসার পর অনেকটা ‘প্রমোশন’ হিসেবেই তাকে দেয়া হয় সহ-অর্থ সম্পাদকের পদ। মূলত এ পদ পাওয়ার পর থেকে তিনি গানম্যান বা বডিগার্ড রিক্যুইজিশন নিয়ে চলাফেরা করেন। নগরীর কোতোয়ালি থানাধীন নন্দনকাননে হেলাল আকবর বাবরের বাড়ি। কোতোয়ালি থানার ওসি মহিউদ্দিন সেলিম বুধবার যুগান্তরকে বলেন, ‘বাবরের গানম্যান নিয়ে চলাফেরা করার বিষয়টি তিনিও শুনেছেন। তবে কোনো ভিআইপি বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি না হওয়া সত্ত্বেও তিনি কীভাবে বেসরকারি সিকিউরিটি কোম্পানি থেকে গানম্যান পেলেন বা কোন সিকিউরিটি কোম্পানি তাকে গানম্যান সরবরাহ করেছে তা জানার জন্য খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে।
হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর নিজে সরাসরি গানম্যান নিয়ে চলাফেরা করার কথা স্বীকার না করলেও বুধবার বিকালে যুগান্তরের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আমার জীবনের নিরাপত্তা হুমকির মুখে। জামায়াত-শিবির সব সময় আমাকে টার্গেটে রাখে। তারা যেভাবে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালায়, কলেজ ও রাজনীতির মাঠ দখলে রাখতে চায়, খুন-রাহাজানি করে তাতে প্রতিপক্ষ হিসেবে আমি তাদের টার্গেট। কে না চায় তার জীবনটা বাঁচাতে। নিরাপদ রাখতে। আমিও নিজের জীবনটা নিরাপদ রাখার চেষ্টা করছি। কোনো গানম্যান-টানম্যান নয়। কয়েকজন ভাই-ব্রাদার আছে যারা আমাকে তাদের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। পাহারা দিয়ে রাখে।’ বাবর আরও বলেন, আমাকে ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী বলা হয়’ কিন্তু আমার হাতে কোনো রক্তের দাগ নেই। যেসব মামলা আমার বিরুদ্ধে ছিল তা রাজনৈতিক। ওই মামলাগুলো থেকে আমি একে একে খালাস পাচ্ছি। সর্বশেষ রেলওয়েতে টেন্ডার নিয়ে যে ডাবল মার্ডার হয়েছে ওই ঘটনার সঙ্গেও আমি জড়িত না। তাছাড়া ওই ঘটনার পর আমি একবারের জন্যও সিআরবি (সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং) যাইনি। যারা আমার প্রতিপক্ষ তারাই আমার বিরুদ্ধে রেলের টেন্ডার নিয়ন্ত্রক হিসেবে অপপ্রচার চালায়।
পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, হেলাল আকবর চৌধুরী বাবর এমইএস কলেজ ভিত্তিক ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন। তিনি এমইএস কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস ছিলেন। নগর আওয়ামী লীগ সভাপতি মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী বাবর ছাত্রলীগের গ্র“প-রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে লিপ্ত ছিলেন। তার বিরুদ্ধে রাউজানের আকবর-মুরাদ হত্যা মামলা, বিএনপি নেতা ফরিদ হত্যা মামলা, বিএনপি কর্মী আজাদ হত্যা মামলা এবং সর্বশেষ রেলওয়ের টেন্ডার নিয়ে সংঘটিত ডাবল মার্ডার মামলা ছাড়াও এক ডজনেরও বেশি মামলা ছিল। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে হেলাল আকবর বাবর ছিলেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী। ওই সরকার ক্ষমতায় আসার এক বছরের মাথায় র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার ও ক্রসফায়ার এড়াতে বাবর পাড়ি জমান থাইল্যান্ডে। সেখানে গড়ে তোলেন হোটেল ব্যবসা। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার এক বছর পর আবারও দেশে ফেরেন। এক পর্যায়ে থাইল্যান্ডের ব্যবসা-বাণিজ্য ছেড়ে দেশে ব্যবসা শুরু করেন। শুরু করেন বেনামে ঠিকাদারি। সূত্র জানায়, বিশেষ করে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের শত কোটি টাকার টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। দেড় কোটি টাকার একটি টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সর্বশেষ ২৪ জুন দুপুরে সিআরবি এলাকায় যুবলীগ-ছাত্রলীগের দুই গ্র“পে গোলাগুলি হয়। এতে আরমান নামে এক শিশু ও সাজু পালিত নামে এক ছাত্রলীগ কর্মী নিহত হন। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা শামীমের নেতৃত্বাধীন একটি গ্র“পের সঙ্গে ওই গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় নিহত সাজুর মায়ের দায়ের করা মামলায় আসামি করা হয় হেলাল আকবর বাবরকে। কোতোয়ালি থানা পুলিশ এ মামলায় ঢাকা থেকে বাবরকে গ্রেফতার করে। ডাবল মার্ডারের ঘটনায় দায়ের করা মামলার আসামি হওয়ার পর যুবলীগের সদস্য পদ থেকেও বহিষ্কার করা হয় বাবরকে। এর কয়েক মাস পরেই তিনি উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে বের হন। জামিনে ছাড়া পেয়েই এবার তিনি অন্য বাবর রূপে আভির্ভূত হন। আগে প্রাইভেট কার চালালেও এবার নেন একটি কালো রঙের প্রাডো জিপ। নিয়োগ করেন অস্ত্রধারী দু’জন বেসরকারি সিকিউরিটি বা গানম্যান। সিকিউরিটি কোম্পানির দুই গানম্যান ছাড়াও আনোয়ার হোসেনসহ আরও দু’জন তার সঙ্গে ‘লাইসেন্সধারী’ অস্ত্র নিয়ে সার্বক্ষণিক পাহারায় থাকেন।
সরকারি বা বেরসকারি সিকিউরিটি বা গানম্যান পাওয়ার যোগ্য কে এমন প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রাম মহানগরের সাবেক পিপি তথা দশ ট্রাক অস্ত্র মামলার পিপি অ্যাডভোকেট কামাল উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, সাধারণত মন্ত্রী-এমপি তথা ভিআইপি-সিআইপিদের সরকার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে গানম্যান দিয়ে থাকে। এছাড়া কেউ যদি সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি নেন সে ক্ষেত্রে স্থানীয় পুলিশ স্টেশন বা থানার সুপারিশে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে বেসরকারি সিকিউরিটি বা গানম্যান সরবরাহ করে থাকে।
তবে যুবলীগ ক্যাডার হেলাল আকবর বাবর বেসরকারি সিকিউরিটি কোম্পানি থেকে গানম্যান নিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো নিশ্চিত করলেও কোতোয়ালি থানার ওসি মহিউদ্দিন সেলিম যুগান্তরকে বলেন, হেলাল আকবর বাবরকে গানম্যান প্রদান করার সুপারিশ সংক্রান্ত কোনো রিপোর্ট তার থানা থেকে পাঠানো হয়নি।

No comments

Powered by Blogger.