কর্মচারীদের পেশাজীবী সংগঠন এবং ট্রেড ইউনিয়নের রাজনৈতিক আচরণ by মোঃ ফিরোজ মিয়া

প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের সমিতি ছাড়াও কর্মচারীদের বেশকিছু পেশাজীবী সংগঠন রয়েছে। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী নয় এমন ব্যক্তিদের দ্বারা বা সমন্বয়ে গঠিত পেশাজীবী সংগঠনের সঙ্গে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের যুক্ত হতে এবং কর্মচারী পেশাজীবী সংগঠনের সঙ্গে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী নয় এমন পেশাজীবীদের যুক্ত হতে দেখা যায়। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে এরূপ পেশাজীবী সংগঠনের ফেডারেশনও রয়েছে, যার কারণে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন দেখা দেয়, প্রজাতন্ত্রের চাকরিজীবী এবং প্রজাতন্ত্রের চাকরিজীবী নয়, এমন পেশাজীবীদের সমন্বয়ে কোনো পেশাজীবী সংগঠন গঠন করা বা এরূপ সংগঠনের ফেডারেশন গঠন করা আচরণবিধি সমর্থন করে কি-না?
আইন-বিধি সর্বদাই আইনি ভাষায় (ল ল্যাংগুয়েজ) লেখা হয়। আইন ও বিধির কিছু বিষয় থাকে প্রকাশ্য এবং কিছু বিষয় থাকে অন্তর্নিহিত। যে কারণে আইন ও বিধিকে সাধারণ অর্থে ব্যাখ্যা করার সুযোগ থাকে না। আইন ও বিধিকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে এর অন্তর্নিহিত অর্থকেও বিবেচনায় নিতে হয়।
প্রজাতন্ত্রের চাকরিতে বিভিন্ন পেশাজীবী রয়েছেন। বিদ্যমান আচরণবিধির প্রকাশ্য ও অন্তর্নিহিত অর্থ ব্যাখ্যায় প্রতীয়মান হয় যে, প্রজাতন্ত্রের চাকরিরত পেশাজীবীদের সমন্বয়ে পেশাজীবী সংগঠন বা সমিতি গঠন আচরণবিধি দ্বারা সমর্থিত। কিন্তু ওই সংগঠনে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী নয় এমন কোনো ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করা আচরণবিধি সমর্থন করে না। এছাড়া প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী নয় এমন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত কোনো পেশাজীবী সংগঠনের সদস্যও কোনো কর্মচারী হতে পারেন না বা থাকতে পারেন না। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের সমন্বয়ে গঠিত পেশাজীবী সংগঠন বা সমিতি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের দ্বারা গঠিত নয় এমন পেশাজীবী সংগঠনের সঙ্গে ফেডারেশনও করতে পারে না। এছাড়া প্রজাতন্ত্রের পেশাজীবী কর্মচারীদের এবং প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী নয় এমন পেশাজীবীদের সমন্বয়ে কোনো পেশাজীবী সংগঠন গঠন করা বা এরূপ কোনো ফেডারেশন গঠন করা আচরণবিধি দ্বারা সমর্থিত নয়।
তবে কোনো নির্দিষ্ট পেশার উন্নয়ন, উৎকর্ষ সাধন, সেবা, কল্যাণ ইত্যাদি এবং সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক উদ্দেশ্যে গঠিত সংগঠনে সরকারের অনুমোদনক্রমে যুক্ত হওয়া বা তার সদস্য বা কর্মকর্তা হওয়ার ক্ষেত্রে আচরণবিধি অন্তরায় নয়।
প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের সমন্বয়ে গঠিত পেশাজীবী সংগঠন কেবল তাদের চাকরি সংক্রান্ত বিষয়ে নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় সরকারের কাছে দাবি-দাওয়া পেশ করতে পারে। কিন্তু এজন্য কোনোরূপ মিছিল, মিটিং বা চাকরির শৃংখলার পরিপন্থী কোনো কার্যকলাপ করতে পারে না। এছাড়া কর্মচারীদের সমন্বয়ে গঠিত কোনো পেশাজীবী সংগঠন বা সমিতি কোনোরূপ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে কোনোভাবেই জড়িত হতে বা থাকতে পারে না। রাজনৈতিক সভা, সমাবেশ, মিছিল, শোভাযাত্রা, মৌন মিছিল, মানববন্ধন ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ করতে বা তা সংগঠনে বা আয়োজনে কোনোরূপ সাহায্য বা সহযোগিতা করতে পারে না। তারা প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে জাতীয় সংসদ, স্থানীয় সংস্থা বা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কোনো নির্বাচনে কোনোরূপ সমর্থন, সাহায্য বা সহযোগিতা করতে পারে না। যার কারণে কোনো কল্যাণমূলক সংগঠন বা তার কোনো অংশ যখনই কোনো রাজনৈতিক কার্যকলাপে প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে বা গোপনে যুক্ত হয় বা যুক্ত হয়েছে বলে ধারণা জন্মে, তখন প্রজাতন্ত্রের কোনো কর্মচারী ওই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারেন না। তাকে অবশ্যই ওই সংগঠনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করতে হয়।
শ্রমিক নিয়োগ, মালিক ও শ্রমিকের সম্পর্ক, মজুরি নির্ধারণ ও পরিশোধ, দুর্ঘটনায় জখমের কারণে ক্ষতিপূরণ, ট্রেড ইউনিয়ন গঠন, শিল্পবিরোধ উত্থাপন ও নিষ্পত্তি, শ্রমিকের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, কল্যাণ এবং চাকরির অবস্থা ও পরিবেশ ইত্যাদি উদ্দেশ্যে শ্রম আইন, ২০০৬ জারি করা হয়। এই আইনানুযায়ী শ্রমিক ও মালিকের সম্পর্ক অথবা শ্রমিক ও শ্রমিকের সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণের জন্য অর্থাৎ শ্রমিকস্বার্থ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যেই ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করার বিধান রয়েছে। তবে একটি প্রতিষ্ঠানে সর্বাধিক তিনটি ট্রেড ইউনিয়ন করা যায় এবং প্রতিটি ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য সংখ্যা মোট শ্রমিকের কমপক্ষে ৩০ শতাংশ হতে হয় এবং একই শ্রমিক একসঙ্গে একাধিক ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য হতে পারে না। এছাড়া শ্রমিকদের নিজ পছন্দমতো যে কোনো ট্রেড ইউনিয়নে যোগদানের অধিকার রয়েছে। অর্থাৎ কোনো শ্রমিককে তার পছন্দ অনুযায়ী ট্রেড ইউনিয়নে যোগদান করতে বাধ্য করা বা কোনো ট্রেড ইউনিয়নে যোগদান থেকে বিরত রাখা যায় না। আইন অনুযায়ী প্রতিটি ট্রেড ইউনিয়ন রেজিস্ট্রিকৃত হতে হয়। অরেজিস্ট্রিকৃত কোনো ট্রেড ইউনিয়ন সদস্য ভর্তি বা কোনো কার্যক্রম পরিচালনা করলে এর জন্য আইনে শাস্তির বিধান রয়েছে। রেজিস্ট্রিকৃত ট্রেড ইউনিয়নের সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে নিজস্ব প্রতিনিধি নির্বাচনের, সমিতির প্রশাসন ও কর্মতৎপরতা, সংগঠনের ও কর্মসূচি প্রণয়নের অধিকার রয়েছে।
রেল বিভাগ, ডাক, তার ও টেলিফোন বিভাগ, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, গণপূর্ত বিভাগ, গণস্বাস্থ্য বিভাগ, বাংলাদেশ সরকারি মুদ্রণালয়- এসব সরকারি প্রতিষ্ঠানের এবং বিধিবদ্ধ সংস্থাগুলোর শ্রমিকদেরও ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার রয়েছে। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের যাদের ওপর সরকারি কর্মচারীদের জন্য প্রযোজ্য আচরণবিধি প্রযোজ্য, তারা ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য, কর্মকর্তা বা কর্মচারী হতে পারেন না।
ট্রেড ইউনিয়নের মূল উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্যই হল শ্রমিক ও মালিক সম্পর্ক বজায় রাখা, শ্রমিকস্বার্থ সংরক্ষণ ও বিরোধ নিষ্পত্তি এবং এই বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে একটিমাত্র দরকষাকষি প্রতিনিধি (সিবিএ) থাকে। কোনো প্রতিষ্ঠানে একাধিক ট্রেড ইউনিয়ন থাকার ক্ষেত্রে গোপন ভোটের মাধ্যমে সিবিএ প্রতিনিধি নির্বাচণের বিধান রয়েছে।
শ্রম আইন অনুযায়ী যৌথ দরকষাকষির প্রতিনিধির (সিবিএ) সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক কোনো কমিটি, আলাপ-আলোচনা, সালিশ, মধ্যস্থতা সংক্রান্ত কার্যক্রম সম্পর্কে মালিককে অবহিত করা ব্যতীত এবং অন্য কোনো শ্রমিক মালিকের বিনা অনুমতিতে তার কর্ম সময়ে কোনো ট্রেড ইউনিয়নের কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত থাকতে পারেন না। এছাড়া ট্রেড ইউনিয়নের কর্মকর্তাদের এবং শ্রমিকদের অসৎ আচরণের জন্য জেল-জরিমানারও বিধান রয়েছে। এখন প্রশ্ন হল, কীরূপ কার্যকলাপ অসৎ আচরণের আওতায় পড়ে? অনেক অসৎ আচরণের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ অসৎ আচরণগুলো হচ্ছে- কোনো শ্রমিক বা শ্রমিক ইউনিয়ন বা ওই ইউনিয়নের পক্ষে কোনো ব্যক্তি কর্তৃক কোনো শ্রমিককে কোনো ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য বা কর্মকর্তা হতে বা সদস্য বা কর্মকর্তা হওয়া থেকে বিরত থাকতে ভীতি প্রদর্শন বা প্রলুব্ধ করা; কোনোরূপ ভীতি প্রদর্শন, বল প্রয়োগ, চাপ প্রয়োগ, হুমকি প্রদর্শন, কোনো স্থানে আটক, শারীরিক আঘাত, পানি, শক্তি বা টেলিফোন সুবিধা বিচ্ছিন্ন করা বা কোনো ট্রেড ইউনিয়নের তহবিলে চাঁদা প্রদান করার বা না করার জন্য বাধ্য করা; প্রতিষ্ঠানে উচ্ছৃংখলতা, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, অগ্নিসংযোগ বা ভাংচুর করা; কর্তৃপক্ষের আইনসঙ্গত বা যুক্তিসঙ্গত আদেশ এককভাবে বা সংঘবদ্ধভাবে ইচ্ছাকৃতভাবে লংঘন; প্রতিষ্ঠানের আইন-বিধি অমান্য করা ইত্যাদি। এছাড়া যে কোনো অনিয়মতান্ত্রিক পন্থায় মালিক বা তার প্রতিনিধিকে কোনো দাবিনামায় দস্তখত করতে বা কোনো দাবি গ্রহণ করতে বা মেনে নিতে বাধ্য করা; বেআইনি ধর্মঘট, ঘেরাও, পরিবহন বা যোগাযোগ ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি বা কোনো সম্পত্তির ধ্বংস সাধন করা।
ট্রেড ইউনিয়নের উদ্দেশ্য ও তার সদস্য বা সিবিএ কর্মকর্তাদের আচরণ বিশ্লেষণে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, তারা শ্রমিক কল্যাণ ও শ্রমবিষয়ক কার্যক্রম ছাড়া অন্য কোনো কার্যক্রমে জড়িত হতে পারে না। এছাড়া রেজিস্ট্রিকৃত প্রতিটি ট্রেড ইউনিয়নেরই একটি বাধ্যতামূলক গঠনতন্ত্র থাকে, ওই গঠনতন্ত্রের বাইরে কোনো কর্মকাণ্ডও পরিচালনা করা যায় না। সুতরাং ট্রেড ইউনিয়নের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয়, কোনো ট্রেড ইউনিয়ন কোনোক্রমেই রাজনৈতিক কোনো কার্যকলাপে অংশগ্রহণ করতে পারে না, কোনো রাজনৈতিক সংগঠন বা দলকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সাহায্য-সহায়তাও করতে পারে না।
সুতরাং প্রজাতন্ত্রের পেশাজীবী কর্মচারীদের সংগঠন এবং ট্রেড ইউনিয়নগুলো তাদের নিজেদের চাকরিগত স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে বা কোনো কল্যাণমূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করবে, এটাই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা।
মোঃ ফিরোজ মিয়া : অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব, চাকরি সংক্রান্ত বিভিন্ন গ্রন্থের লেখক

No comments

Powered by Blogger.