র‌্যাবের বিভাগীয় প্রতিবেদনে ২১ জনের নাম

ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার জামাতা র‌্যাব-১১-এর সাবেক অধিনায়ক চাকরিচ্যুত লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদ মাহমুদ, মেজর আরিফ হোসেন এবং নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট কমান্ডার এমএম রানাকে দায়ী করে নারায়ণগঞ্জের চাঞ্চল্যকর সাত খুনের ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছে র‌্যাব। প্রতিবেদনে সাবেক ঊর্ধ্বতন এ তিন কর্মকর্তাসহ মোট ২১ জন জড়িত থাকার নাম এসেছে।
বিভাগীয় তদন্ত শেষে বুধবার প্রতিবেদনটি হাইকোর্টে দাখিল করা হয়। প্রতিবেদনটি নথিভুক্ত করে বিচারতি মো. রেজাউল হক ও বিচারতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের সমন্বয়ে গঠিত দ্বৈত বেঞ্চ আগামী জানুয়ারি মাসে পরবর্তী আদেশের জন্য ধার্য করেছেন।
জড়িত অন্য যাদের নাম এ প্রতিবেদনে রয়েছে তারা হলেন- এসআই পুর্ণেন্দু বালা, এবি আরিফ হোসেন, নায়েক নাজিম, নায়েক দেলোয়ার, ল্যান্স নায়েক হিরা মিয়া, সৈনিক মহিউদ্দিন মুন্সী, সৈনিক আবদুল আলিম, সৈনিক আলামিন, সিপাহী তৈয়ব, কনস্টেবল সিহাবুদ্দিন, কনস্টেবল আলামিন, হাবিলদার এমদাদ, ল্যান্স নায়েক বেলাল হোসেন, সৈনিক আসাদ, সার্জেন্ট এনামুল, এএসআই বজলু, হাবিলদার নাসির, সৈনিক তাজুল।
আদালত থেকে বের হয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম র‌্যাবের তদন্ত প্রতিবেদন তুলে ধরে সাংবাদিকদের বলেছেন, ঘটনার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অর্থাৎ অপহরণ থেকে শুরু করে লাশ নদীতে ডুবানো পর্যন্ত লে. ক. (অব.) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, কোম্পানী কমান্ডার মেজর (অব.) আরিফ হোসেন জড়িত ছিলেন বলে এ তদন্তে প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয়। কিন্তু লে. কমান্ডার (অব.) এএম রানা অপহরণ পর্যন্ত অংশ নিয়ে আংশিক জড়িত ছিলেন বলে এ তদন্তে প্রতীয়মান হয়। অন্যরা উপস্থিত থেকে সহায়তা করেছেন।
র‌্যাবের এ প্রতিবেদন তাদের অভ্যন্তরীণ উল্লেখ করে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এ প্রতিবেদন কিন্তু বিচারের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। বিচারের ক্ষেত্রে ডিবি তাদের তদন্ত, চার্জশিট, যেভাবে আদালতে তুলবে, তার ভিত্তিতে বিচার হবে। আদালত র‌্যাবকে সংস্থাটির কারা জড়িত, উদ্ধারে গাফিলতি ছিল কিনা, এ বিষয়গুলো দেখে প্রতিবেদন দিতে বলেছিলেন।
ঘটনা সম্পর্কে র‌্যাব সদরদফতর জানত কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আমি এটা দাখিল করেছি, সদরদফতর জানতেন কিনা, সম্পূর্ণ প্রতিবেদন পড়ার পরই এটা বোঝা যাবে। পুরো প্রতিবেদন আমার পক্ষে পড়া সম্ভব হয়নি। র‌্যাব সদরদফতর জানত কিনা, সেটা দেখতে আদালতের নির্দেশনাও ছিল না।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আদালত মন্তব্য করেছেন, এটা যেদিন চূড়ান্ত হল তারপরও কাগজে এসেছে, অনেকে অপরাধ স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিচ্ছে। আমি বলেছি, এটা তো তদন্ত সংস্থা না। প্রাথমিকভাবে যারা জড়িত বলে প্রতীয়মান হয়েছে, তাদের নামই এখানে এসেছে। এর ভিত্তিতে বিচার হবে না। বিচার হবে ডিবির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে।
এক সাংবাদিক বলেন, সাত খুনের পর র‌্যাব সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, র‌্যাব এ ঘটনায় জড়িত নয়। এখন এসে বলছে, এরা জড়িত। এ বিষয়টাকে আপনি কিভাবে দেখছেন? জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, র‌্যাবের সেই সময়ের বক্তব্য সম্পর্কে আমি অবগত নই।
২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন কুমার সরকারসহ সাতজন অপহরণের শিকার হন। এরপর শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ৩০ এপ্রিল ছয়জনের এবং পরদিন ১ মে আরেকজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী একটি মামলা করে। এ মামলায় আরেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা নুর হোসেনসহ ১৩ জনকে আসামি করা হয়। গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) চাঞ্চল্যকর এ ঘটনা তদন্তের দায়িত্বে ছিল। নিহত নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম ৬ কোটি টাকার বিনিময়ে এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে র‌্যাবের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন।
পরে এক স্বতঃপ্রণোদিত আদেশে ৫ মে হাইকোর্টের উপরোক্ত বেঞ্চ সিআইডিকেও এ তদন্তের দায়িত্ব দেয়। বলা হয়, মূল তদন্ত ডিবিই করবে, সিআইডি করবে ছায়া তদন্ত। এছাড়া র‌্যাবের কোনো সদস্য জড়িত ছিল কিনা তার বিভাগীয় তদন্তের জন্য র‌্যাবকে নির্দেশ দেয়া হয়। পাশাপাশি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে ঘটনার সার্বিক তদন্ত করতে বলা হয়। এ আদেশের পর নিয়মিত অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করে আসছিল সংস্থাগুলো।
২৪ নভেম্বর র‌্যাব তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়। বুধবার প্রতিবেদনটি আদালতে উপস্থাপন করা হয়। তদন্ত প্রতিবেদনের মতামতের অংশ আদালতকে পড়ে শোনান অ্যাটর্নি জেনারেল। প্রতিবেদন তুলে ধরে আটর্নি জেনারেল বলেন, সাত জনকে অপহরণের পর র‌্যাব সদরদফতর থেকে তাদের জীবিত উদ্ধারের নির্দেশ দেয়া হয়। কিন্তু র‌্যাব-১১-এর কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। ইচ্ছাকৃতভাবে বিরত থাকে।
এ অভিমত পড়ার পর আদালত বলেন, প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার পরও পত্রিকায় দেখেছি ৫ জন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এগুলোর কি হবে? তাদের নামও এখানে নেই। প্রতিবেদনটি অসম্পূর্ণ। কতখানি নিষ্ঠার সঙ্গে করেছে তাও ভাববার বিষয়। আদালত আরও বলেন, র‌্যাবের প্রতি অধিকাংশ মানুষের আস্থা আছে। কারো কারো ক্ষোভও আছে।
এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এটা চূড়ান্ত বলে গণ্য করা যাবে না। শুনানির একপর্যায়ে আদালত বলেন, এখনকার পরিস্থিতি ও তখনকার পরিস্থিতি এক নয়। হাইকোর্ট থেকে দুটি আদেশ না হলে মানুষ সাক্ষ্য দিতে আসত না। তখন সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেছিল র‌্যাব জড়িত না। এরপর মানুষ সাক্ষ্য দিতে এসেছে। আদালত জানুয়ারি মাসে পরবর্তী আদেশ দেয়া হবে বলে জানান।
আগের প্রধানকে দিয়েই তদন্ত শেষ করার নির্দেশ : হাইকোর্টের আদেশে গঠিত নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের ঘটনা তদন্ত কমিটির আগের প্রধান মো. শাহজাহান আলী মোল্লাকে দিয়েই তদন্ত শেষ করানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বুধবার হাইকোর্টের বিচারপতি মো. রেজাউল হক ও বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের সমন্বয়ে গঠিত দ্বৈত বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
এর আগে মঙ্গলবার কমিটির প্রধান হিসেবে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আবদুল হাকিমকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। আর আগের প্রধান মো. শাহজাহান আলী মোল্লাকে পদোন্নতি দিয়ে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের ভারপ্রাপ্ত সচিবের দায়িত্ব দেয়া হয়।
বুধবার শুনানিকালে আদালত বলেন, নিউজে দেখলাম তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যান পরিবর্তন করা হয়েছে। কমিটি পুনর্গঠনের আগে আদালতকে জানানো উচিত ছিল। এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। তাকে সরকারি কর্মকমিশন (পিএসসি) ভারপ্রাপ্ত সচিব করা হয়েছে। আদালত বলেন, তাহলে নতুন চেয়ারম্যানকে তো প্রথম থেকেই শুরু করতে হবে। তাই আগে যিনি ছিলেন তিনিই দায়িত্ব পালন করবেন।
২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন কুমার সরকারসহ সাতজন অপহরণের শিকার হন। এরপর শীতলক্ষ্যা নদী থেকে ৩০ এপ্রিল ছয়জনের এবং ১ মে আরেকজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় নিহত নজরুল ইসলামের স্ত্রী একটি মামলা করেন। এ মামলায় আরেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা নুর হোসেনসহ ১৩ জনকে আসামি করা হয়। গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) চাঞ্চল্যকর এ ঘটনা তদন্তের দায়িত্বে ছিল। নিহত নজরুল ইসলামের শ্বশুর শহীদুল ইসলাম ৬ কোটি টাকার বিনিময়ে এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে র‌্যাবের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন।
পরে এক স্বতঃপ্রণোদিত আদেশে ৫ মে হাইকোর্ট জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে ঘটনার সার্বিক তদন্ত করতে নির্দেশ দেন। হাইকোর্টের নির্দেশে ৭ মে শাহজাহান আলী মোল্লাকে প্রধান করে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে মন্ত্রণালয়।
কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের দুই উপসচিব মো. আবদুল কাইয়ুম সরকার ও আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন, আইন মন্ত্রণালয়ের দুই উপসচিব মোস্তাফিজুর রহমান ও মিজানুর রহমান খান এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুই উপসচিব শফিকুর রহমান ও সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার। এ কমিটির পক্ষ থেকে হাইকোর্টে বেশ কয়েক দফায় অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। সর্বশেষ গত মাসে কমিটির পক্ষ থেকে তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করতে চার সপ্তাহের সময় চাওয়া হয়।
এ অবস্থায় কমিটির প্রধানকে পরিবর্তন করা হলেও আদালত আগের প্রধানকে দিয়ে তদন্ত শেষ করানোর আদেশ দিয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.