দায় নৌমন্ত্রণালয়ের

সুন্দরবনের ভেতরের নদী দিয়ে যান চলাচল বন্ধে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। নিয়মিতভাবে নৌযান চলায় প্রতিনিয়ত ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। আর এ কারণেই এই পথে নৌচলাচল নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করেছে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়সহ দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠন। কিন্তু এ সুপারিশের পরও নৌযান চলাচল বন্ধ না হওয়ায়, প্রায় দুই বছর ধরে বিষয়টি লিখিত বা মৌখিকভাবে সরকারকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে সংগঠনগুলো। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য। সূত্র আরও জানায়, সময়মতো কার্যকরী পদক্ষেপ না নেয়ায়, সুন্দরবনের ভেতরের নৌপথ বন্ধ করে বিকল্প পথ মংলা-ঘাসিয়াখালী চ্যানেল চালু করতে ব্যর্থ হয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। উল্টো বছরের পর বছর সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌযান চলাচলের অনুমতি দিয়েছে সংস্থাটি। দীর্ঘদিন ধরে নৌযান চলাচল, উচ্চ শব্দের হর্ন বাজানো ও তেলবাহী জাহাজ দুর্ঘটনার ফলে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য এবং জাতিসংঘ ঘোষিত বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি সুন্দরবনের পরিবেশ বিপন্ন হতে চলেছে। জাহাজ ডুবে ফার্নেস অয়েল ছড়িয়ে পড়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দুষ্প্রাপ্য প্রাণী ইরাবতী ডলফিনের অভয়ারণ্য। পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, বারবার তাগাদা দেয়া সত্ত্বেও সুন্দরবনের ভেতরের নৌচলাচল বন্ধ না করায় এ দুর্ঘটনার প্রধান দায় বর্তায় নৌমন্ত্রণালয় ও অধীনস্থ সংস্থাগুলোর ওপর।
এদিকে তেল পরিবহন সংক্রান্ত কোনো ধরনের নিয়মনীতি না মেনেই ঝুঁকিপূর্ণভাবে শতাধিক তেলের ট্যাংকার সাগরে ও নদীপথে চলাচল করছে। নিয়ম অনুযায়ী তেলবাহী কোনো জাহাজ সাগরে চলাচল করতে এবং সংশ্লিষ্ট জাহাজগুলো নির্মাণের আগেই বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) মালিকানাধীন কোম্পানির ছাড়পত্র নিতে হয়। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, এক্ষেত্রে মোটা অংকের টাকা আন্ডার হ্যান্ডলিং করে ছাড়পত্র ছাড়াই শত শত জাহাজ তৈরি হচ্ছে এবং সেগুলো নির্বিঘেœ চলাচল করছে।
জানা গেছে, সুন্দরবনে দুর্ঘটনাকবলিত তেলবাহী ওটি সাউদার্ন-৭ উদ্ধার ও নদী দূষণ রোধে নেয়া কার্যক্রমের সার্বিক বিষয়ে খোঁজখবর রাখছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঘটনা তদন্তে অতিরিক্ত সচিব নুরুল করিমকে আহবায়ক করে পৃথক কমিটি গঠন করেছে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। তেল অপসারণের সুবিধার্থে শ্যালা নদীতে আপাতত নৌযান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বিকল্প হিসেবে সুন্দরবনের আংশিক ভেতরের আরেক নদী সুপতি দিয়ে চলাচল করতে বলা হয়েছে।
বারবার তাগাদা সত্ত্বেও সুন্দরবনের ভেতরের নদীতে নৌযান চলাচল বন্ধ না করার বিষয়ে জানতে চাইলে নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান যুগান্তরকে বলেন, মংলা বন্দরের সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগের একমাত্র পথ হচ্ছে সুন্দরবনের ভেতরের এ নদীটি। এটি ব্যবহার করে ভারতের সঙ্গে নৌ প্রটোকলের জাহাজ চলে। সুন্দরবনের ভেতরের এ নৌপথটি বন্ধ করে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো তা ভালো হতো না। মংলা বন্দরের সঙ্গে নৌযোগাযোগ বন্ধ হয়ে যেত। পৌনে তিন বছরেও পুরনো নৌপথ মংলা-ঘাসিয়াখালী চালু করতে না পারা মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মংলা-ঘাসিয়াখালী নৌপথে দুই বার ড্রেজিং করা হয়। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড খালগুলোতে বাঁধ নির্মাণ করায় পানি প্রবাহ কমে নদীতে প্রচুর পরিমাণে পলি জমে তা বন্ধ হয়ে যায়। ওই নদী পথটি স্থায়ীভাবে চালু রাখার বিষয়ে আমরা বিশেষজ্ঞ টিম দিয়ে জরিপ কার্যক্রম চালিয়েছি। পাশাপাশি বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজার দিয়ে খনন কাজ চলছে। তিনি আরও বলেন, পুরনো নৌপথটি চালু করতে দুটি আন্তর্জাতিক টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। একটি চীনা কোম্পানিকে কার্যাদেশ দেয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। আরেকটি টেন্ডার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। আশা করছি আগামী এক বছরের মধ্যে এ পথটি চালু করতে পারব।
সূত্র জানায়, পলি জমে ৩১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে মংলা-ঘাসিয়াখালী নৌপথটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল থেকে বিকল্প রুট হিসেবে সুন্দরবনের জয়মনিরগোল-চাঁদপাই-দুধমুখী নৌরুটে জাহাজ চলাচলের অনুমতি দেয় নৌমন্ত্রণালয়। এটি নৌপ্রটোকলের রুট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সুন্দরবন ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য এবং জাতিসংঘ ঘোষিত বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি। জাতিসংঘের ওই দুই সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী সুন্দরবনের ভেতর এই এলাকা দিয়ে নৌযান চলাচল নিষিদ্ধ। বিষয়টি জানিয়ে বন বিভাগ থেকে একাধিকবার এবং জাতিসংঘের জলাভূমিবিষয়ক সংস্থা রামসার কর্তৃপক্ষ, বিজ্ঞান-শিক্ষা ও ঐতিহ্যবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো থেকে নৌপথটি নিয়ে আপত্তি তুলে তা পৃথক চিঠির মাধ্যমে বারবার নৌপথটি বন্ধের আহ্বান জানায়। তা সত্ত্বেও নৌমন্ত্রণালয় ও বিআইডব্লিউটিএ ওই পথটি বন্ধ করেনি এবং বিকল্প পথ তৈরির কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। সূত্র আরও জানায়, ২০১১ সালের ২২ জানুয়ারি উচ্চপর্যায়ের এক কারিগরি সেমিনারে বিশেষজ্ঞরা নৌপথটি খননের পাশাপাশি অন্যান্য প্রশমনমূলক ব্যবস্থা যেমন জোয়ার-অববাহিকা (টাইডাল বেসিন) তৈরির পরামর্শ দেন। সম্প্রতি এক সার্ভের রিপোর্টে একই ধরনের মতামত আসলেও তা বাস্তবায়ন করতে ব্যর্থ হয়েছে নৌমন্ত্রণালয়।
নৌমন্ত্রণালয় ও বিআইডব্লিউটিএ সূত্র জানায়, নিজস্ব ড্রেজার দিয়ে ধীরগতিতে নৌপথটি খননের কাজ চলছে। আশপাশ খালগুলোতে বাঁধ থাকায় এবং বিঞ্চু ও দাউদখালী নদী খনন না করায় ড্রেজিং কার্যক্রম টেকসই হচ্ছে না। তাই খননের পাশাপাশি দুটি আন্তর্জাতিক টেন্ডার আহ্বান করা হয়েছে। একটি টেন্ডারে চায়না হারবার কোম্পানিকে কার্যাদেশ দিতে বিআইডব্লিউটিএ থেকে নৌমন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। আরেকটি টেন্ডারের দরপত্র গ্রহণের তারিখ আগামী ২৪ ডিসেম্বর নির্ধারিত রয়েছে। পাশাপাশি খুলনা, নড়াইল, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর হয়ে আরেকটি নৌপথ খনন কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। এটিও টেন্ডার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। তারা আরও বলেন, এ দুটি নৌপথ চালু না হওয়া পর্যন্ত সুন্দরবনের ভেতরের পথ দিয়েই নৌযান চলাচল করবে। এর বিকল্প কোনো পথ চালু করতে পারেনি বিআইডব্লিউটিএ।
ঝুঁকিপূর্ণভাবে শতাধিক তেলের ট্যাংকার সাগরে ও নদীপথে চলাচল করছে : তেল পরিবহন সংক্রান্ত কোনো ধরনের নিয়মনীতি না মেনেই ঝুঁকিপূর্ণভাবে শতাধিক তেলের ট্যাংকার সাগরে ও নদীপথে চলাচল করছে। নিয়ম অনুযায়ী তেলবাহী কোনো জাহাজ সাগরে চলাচল করতে হলেই বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) ছাড়পত্র নিতে হয়। সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর ও পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্রের আগেই বিপিসি থেকে এই ছাড়পত্র নিতে হয়। অর্থাৎ জাহাজ নির্মাণ করার আগেই বিপিসির ছাড়পত্র লাগে। জাহাজ নির্মাণ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সাধারণ জাহাজ বানানোর চেয়ে তেলবাহী জাহাজ নির্মাণ অনেক ব্যয়বহুল। এ কারণে বিপিসির মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর ছাড়পত্র পেতে অনেক কাঠখড় পোহাতে হয় জাহাজ মালিকদের। এ ক্ষেত্রে শতভাগ নিয়ম-কানুন পূরণ করতে পারে না মালিকরা। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য বিপিসির নিয়ম-কানুন শতভাগ মেনে জাহাজ নির্মাণ করতে গেলে ব্যয় অনেক বেড়ে যায়। যার কারণে ছাড়পত্র পেতে অধিকাংশ জাহাজ মালিকরা বিপিসির মালিকানাধীন কোম্পানি পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার সঙ্গে গোপন আঁতাত করছে। এই ক্ষেত্রে কোটি কোটি টাকার গোপন ডিলিং হয় দুই পক্ষের মধ্যে। একই অভিযোগ উঠেছে সম্প্রতি সুন্দরবনের ভেতরে ডুবে যাওয়া তেলবাহী ট্যাংকার ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ এর ক্ষেত্রে। অভিযোগ উঠেছে, অধিকাংশ শর্ত পূরণ না করেই গোপনে বাংলাদেশ পেট্রলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) আওতাধীন কোম্পানি পদ্মা অয়েলের কাছ থেকে জাহাজ নির্মাণের ছাড়পত্র নিয়েছিল ওটি সাউদার্ন স্টার-৭। জানা গেছে, এই ছাড়পত্র নিতে জাহাজের মালিকানা প্রতিষ্ঠান মেসার্স হারুণ অ্যান্ড কোম্পানির সঙ্গে পদ্মা অয়েলের ছাড়পত্র প্রদানকারী বিভাগের একটি দুর্নীতিবাজ চক্রের মোটা অংকের টাকা আন্ডারহ্যান্ড ডিলিং হয়েছে। যার কারণে তৈরির পর থেকে এখন পর্যন্ত পদ্মা অয়েলের কোনো টিম জাহাজটি পরিদর্শন করেনি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পদ্মা অয়েলের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, নিয়ম অনুযায়ী তেলবাহী যে কোনো জাহাজ নির্মাণের আগে সংশ্লিষ্ট জাহাজের গভীরতা, ফিটনেস, ইঞ্জিনের মান, পাটাতনের পুরুত্ব, ধারণক্ষমতা অনুযায়ী জাহাজের আয়তন, চলাচলের সময় পানির নিচে ও পানির ওপরে কতটুকু থাকবে তার পরিমাপ, স্টাফ ও চালকের যোগ্যতাসহ প্রায় ৩০ থেকে ৩৫টি শর্ত পূরণের সার্টিফিকেট দেখাতে হয়। এগুলোর অনুমোদনের পরই কেবল এ ধরনের তেলবাহী জাহাজ তৈরি করার অনুমতি দেয়া হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পদ্মা অয়েলের ওই কর্মকর্তা জানান, মেসার্স হারুণ অ্যান্ড কোম্পানি জাহাজ নির্মাণের আগে না করে নির্মাণের পর মোটা অংকের টাকা ঘুষ দিয়ে সার্টিফিকেটগুলো নিয়ে পদ্মা অয়েলের সঙ্গে চুক্তি করেছিল। জানা গেছে, এই সার্টিফিকেট দেয়ার সময় সংশ্লিষ্ট বিভাগ সরেজমিন ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ এ গিয়ে কোনো ধরনের তদন্ত পর্যন্ত করেনি। এমনকি নির্মাণের পর থেকে প্রতি দুই বছর পরপর ছাড়পত্র নবায়ন করতে হয়। জানা গেছে, এই নবায়নের ক্ষেত্রেও পদ্মা অয়েল কর্তৃপক্ষ সরেজমিন জাহাজটি পরিদর্শন না করেই ছাড়পত্র দিয়ে আসছে। শুধু পদ্মা অয়েলই নয়, বিপিসির মালিকানাধীন যমুনা, মেঘনার ক্ষেত্রেও তেলের ট্যাংকারের ছাড়পত্র দেয়ার ক্ষেত্রে এ ধরনের আন্ডারহ্যান্ড ডিলিংয়ের অসংখ্য অভিযোগ আছে। জানা গেছে, বিপিসির মালিকানাধীন এই তিনটি কোম্পানির সঙ্গে প্রায় ৫শ’ তেলের ট্যাংকারের চুক্তি রয়েছে। কোম্পানিগুলোর সংশ্লিষ্ট বিভাগ এসব তেলের ট্যাংকারের মালিকদের কাছ থেকে প্রতি মাস মোটা অংকের টাকা মাসোহারা পাচ্ছে। বিপিসির একটি সূত্র জানায়, সিস্টেম লস কমানোর জন্য গত বছর থেকে ১২-১৫ বছরের পুরনো জাহাজে তেল পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও গত দুই বছর ধরে অবৈধভাবে ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ জ্বালানি তেল পরিবহন করছে। অভিযোগ আছে, এই ক্ষেত্রেও পদ্মার সঙ্গে জাহাজটির মালিকানা প্রতিষ্ঠান মেসার্স হারুণ অ্যান্ড কোম্পানির অবৈধ ডিলিং হচ্ছে। জানা গেছে, এই পদ্মা অয়েলের সঙ্গে ওটি সাউদার্নের মালিক আমির হোসেন ফরিদ ও বরিশালের ব্রাউন কম্পাউন্ডারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা এই ঘটনাটি তদন্তের দাবি জানিয়ে অবিলম্বে বিপিসির কোম্পানিগুলোর সঙ্গে চুক্তিভুক্ত অন্য জাহাজগুলোর সঙ্গে করা চুক্তি তদন্তের দাবি জানান। অন্যথায় ভবিষ্যতে আরও ভয়াবহ বিপর্যয় আসতে পারে নদীপথে।
এদিকে পদ্মা অয়েল সূত্রে জানা গেছে, নদীর পানিতে ভাসমান তেল উদ্ধারের জন্য স্থায়ী জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে পদ্মা অয়েল ওই এলাকায় দুটি পারচেজিং সেন্টার খুলছে। তারাই দ্বিগুণ বেশি দামে এই তেল কিনে নেবে বলে স্থানীয়দের জানিয়েছে। দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে গ্রামবাসী তেল সংগ্রহ করে নিতে পারবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
এদিকে মঙ্গলবার ভোরে ফার্নেস তেলবাহী ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ অপর একটি মালবাহী জাহাজের ধাক্কায় ডুবে যাওয়ার ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘ। এ ঘটনায় সুন্দরবনের কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তা অনুসন্ধানে জাতিসংঘের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল শিগগিরই বাংলাদেশে আসতে পারে।
জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থার বিবৃতি ও বক্তব্য : জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর পলিন টেমেসিস বৃহস্পতিবার এক লিখিত বিবৃতিতে বলেন, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে সব ধরনের বাণিজ্যিক নৌযান চলাচল বন্ধে সরকারের কাছে আবার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ। এ ধরনের বনের ভেতর দিয়ে নৌযান চললে তা দীর্ঘ মেয়াদে জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করে। পলিন টেমেসিস বলেন, সুন্দরবনের যে এলাকাটিতে তেল ছড়িয়ে পড়েছে, এটি বিশ্বের বিপদাপন্ন দুই প্রজাতি গাঙ্গেয় ও ইরাবতি ডলফিনের বিচরণ ক্ষেত্র। এ ছাড়া অনেক সমৃদ্ধ জলজ প্রাণী রয়েছে সেখানে। সুন্দরবন ইউনেসকো ঘোষিত একটি বিশ্ব ঐতিহ্য। তাই সুন্দরবনের ভেতরে এই দুর্ঘটনায় জাতিসংঘ উদ্বিগ্ন।
তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এবং পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) সুন্দরবনের ভেতরে জাহাজডুবিতে তেল ছড়িয়ে পড়ার ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়েছে।
তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, দুর্ঘটনা শুধু দেশের জন্য নয়, পুরো এ অঞ্চলের জন্য বড় ধরনের বিপর্যয়। এজন্য নৌ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্টরা দায়ী। তিনি বলেন, আগে যেসব চ্যানেলে জাহাজ চলত, চিংড়ি ঘের, লিজসহ উন্নয়নের নামে সেগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। বাধ্য হয়ে সুন্দরবনের ভেতরে অবৈধ রুটে এসব জাহাজ চলাচল করছে। সরকার এগুলো দেখছে না। তিনি বলেন, কয়লাকেন্দ্রিক বিদ্যুৎ নির্মাণের ক্ষেত্রে কয়লা পরিবহনেও এ ধরনের বিপর্যয় আসতে পারে। এ ধরনের বিপর্যয় এড়াতে সরকারের কোনো প্রস্তুতি ছিল না, এখনও নেই। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে নদী দূষণরোধে নেমেছে। একইভাবে সরকারকে সর্বশক্তি নিয়ে নামতে হবে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌপথ এবং এর পাশে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন যে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, তার কিছুটা লক্ষণ এ দুর্ঘটনা থেকে দেখা গেল। সরকার এখনই যদি নৌপথ বন্ধ না করে এবং রামপাল প্রকল্প সুন্দরবনের পাশ থেকে সরিয়ে না নেয়, তাহলে আমরা সুন্দরবনের বিশ্ব ঐতিহ্যের সম্মান হারাব তো বটেই, এক সময় বনটিই ধ্বংস হয়ে যাবে।
পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও বিআইডব্লিউটিএর সাবেক সচিব সৈয়দ মনোয়ার হোসেন বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক দায় নৌ মন্ত্রণালয়ের। কারণ মূল চ্যানেল মংলা-ঘাষিয়াখালী নৌপথ চালু রাখতে ব্যর্থ হয়েছে মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সংস্থা বিআইডব্লিউটিএ।
বেলা’র প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, সুন্দরবনের ভেতরে দুর্ঘটনার বেশির ভাগের দায় নৌ মন্ত্রণালয়ের। বারবার তাগাদা দেয়া সত্ত্বেও সুন্দরবনের ভেতরে নৌযান চলাচলের অনুমতি দিয়েছে। তবে দুর্ঘটনার শিকার ও দায়ী নৌযানের চালক ও মালিকরা দায় এড়াতে পারেন না। তিনি বলেন, শ্যালা নদীতে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত নৌযান বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে নৌ মন্ত্রণালয়। আমরা চাই কখনই ওই পথে নৌযান চলাচলের অনুমতি দেয়া না হোক।
তদন্ত কমিটি গঠন করেছে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় : সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে জ্বালানি তেলবাহী ট্যাংকার ডুবির ঘটনায় পরিবেশ বিপর্যয়ের আশংকা প্রকাশ করেছে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। বিষয়টি সরেজমিন তদন্তপূর্বক সুপারিশসহ প্রতিবেদন প্রদানের জন্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. নুরুল করিমকে আহ্বায়ক করে ৯ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে সুন্দরবনের প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব এবং সম্ভাব্য বিপর্যয় ও ক্ষয়ক্ষতির উত্তরণে সুপারিশ প্রদানের জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হচ্ছেন- খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. দীলিপ কুমার দত্ত, পরিবেশ অধিদফতরের পরিচালক ড. সুলতান আহমদ, খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (বাণিজ্যিক) ড. মো. রেজাউল হক, বিআইডব্লিউটিএর একজন প্রতিনিধি, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের পরিচালক (বিপণন) মীর রেজা আলী, বাগেরহাটের জেলা প্রশাসকের একজন প্রতিনিধি। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের বন অধিশাখার উপসচিব সৈয়দ মেহ্দী হাসানকে কমিটির সদস্য সচিব করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী ১৮ ডিসেম্বরের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এর আগে নৌ মন্ত্রণালয় ও সমুদ্র পরিবহন অধিদফতর আলাদা কমিটি গঠন করেছে।

No comments

Powered by Blogger.