সুন্দরবনে তেলের ট্যাংকার-ডুবি মরছে হাঁস-গুইসাপ, ভারী তেলে জড়াচ্ছে গুল্ম-শ্বাসমূল

তেল ছড়িয়ে পড়ার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে সুন্দরবন এলাকায়। ট্যাংকার-ডুবির তিন দিন পর শুক্রবার ওই এলাকায় কয়েকটি হাঁস ও গুইসাপ মারা যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। গুল্ম ও শ্বাসমূলে জড়াচ্ছে ভারী ফার্নেস অয়েল। এদিকে বৃহস্পতিবার বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত উপকূলে মাইকিং করে জনসাধারণকে সুন্দরবনের বিভিন্ন নদী ও খালের তেল তুলে নেয়ার যে আহ্বান জানিয়েছিল কর্তৃপক্ষ, তাতে বেশ সাড়া মিলেছে। সুন্দরবনে ছড়িয়ে পড়া ফার্নেস অয়েল অপসারণে স্বতঃর্ফূতভাবে এগিয়ে এসেছে জেলে, বাওয়ালীসহ জনসাধারণ। শুক্রবার সকালে তারা দলবেঁধে নেমে পড়েছে সুন্দরবনের নদী ও খালে। হাতের কাছে সুবিধাজনক যা পেয়েছে, তা-ই নিয়ে তারা তেল অপসারণে কাজ করছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, সনাতন পদ্ধতিতে তেল অপসারণে তারা ব্যবহার করছে থালা-বাসন, চট, কলাপাতা, ফোম ইত্যাদি। আর সংগ্রহ করছে ঘটি-বালতি-পলিথিনে। তবে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত পদ্মা অয়েল কোং লিমিটেড দুটি অস্থায়ী ডিপোতে স্থানীয় জনসাধারণের সংগ্রহ করা ফার্নেস অয়েল  কিনছে কি না তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এদিকে ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনের ভবিষ্যৎ ক্ষতির আশঙ্কা বিবেচনায় নিয়ে ভাসমান তেলের ওপর রাসায়নিক পাউডার না ছিটানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বন বিভাগ।
আর সুন্দরবনে শেলা নদীতে ফার্নেস অয়েলের ওপর রাসায়নিক পাউডার ছিটানোর জন্য চট্টগ্রাম থেকে আনা কান্ডারী-১০ জাহাজটি বৃহস্পতিবার বিকাল থেকে জয়মনির ঘোল এলাকায় নোঙর করে রয়েছে। রাসায়নিক পাউডার ছিটানোর ছাড়পত্র দেয়নি পরিবেশ অধিদফতর।
বৃহস্পতিবার মন্ত্রণালয়ের গঠিত উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন নয় সদস্যের তদন্ত  কমিটি শুক্রবার দুপুরে সরেজমিন পরিদর্শন করেছে। কমিটি সাংবাদিকদের জানিয়েছে, তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বাস্তব অবস্থা দেখেছে। পরে সিদ্ধান্ত জানাবে।
মঙ্গলবার দুর্ঘটনার পর ‘ওটি সাউদার্ন স্টার-৭’-এর নিখোঁজ মাস্টার মোকলেসুর রহমানের (৫০) এখনো কোনো হদিস মেলেনি।
সুন্দরবনের অভ্যন্তরে বিলুপ্তপ্রায় ইরাবতিসহ ছয় প্রজাতির ডলফিনের অভয়াশ্রমের মধ্যে অয়েল ট্যাংকার ডুবি ও তেল ছড়িয়ে পড়ায় সুন্দরবনের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন জাতিসংঘ, ইউনেসকো, বন বিভাগসহ পরিবেশবিদরা।
গত চার দিনে সুন্দরবনের বিভিন্ন শাখানদী ও খালে পরিবেশ ও প্রাণিকুলের জন্য ক্ষতিকর যে পরিমাণ কালো ফার্নেস অয়েল ছড়িয়ে পড়েছে, তা ভাবিয়ে তুলেছে বন বিভাগকে।
বন বিশেষজ্ঞদের মতে, তেলের কারণে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির মুখে পড়তে পারে প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন। আর জোয়ার-ভাটার প্রভাবে ফার্নেস অয়েল পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন হ্রাস পেয়ে সেখানকার  জলজ প্রাণীর জীবন সংকাটপূর্ণ করে তুলেছে।
ইতিমধ্যে ছয়টি হাঁস, একটি গুইসাপ মারা যাওয়ার খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে। এ ছাড়া নদী-তীরবর্তী এলাকায় গুল্ম ও উদ্ভিদের শ্বাসমূল ভারী ফার্নেস অয়েলে জড়িয়ে যাচ্ছে।
যদিও ঠিক এ মুহূর্তে  উদ্ভিদ জগতের ক্ষতির বিষয়টি চোখে পড়ছে না, তবে আগামী ২০-২৫ দিনের মধ্যে গুল্মগুচ্ছ ও উদ্ভিদের রং বিবর্ণ হয়ে মারা যেতে পারে বলে  পরিবেশবিদরা আশঙ্কা করছেন ।
এ ব্যাপারে বাগেরহাট সরকারি পিসি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ উদ্ভিদবিদ প্রফেসর শেখ বুলবুল কবির সাংবাদিকদের বলেন,  সুন্দরবনের ব্যাপক এলাকা জুড়ে তেল ছড়িয়ে পড়ায় (ডিও) পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন কমে যাওয়ায় ডলফিনসহ অন্যান্য প্রাণিকুলের ক্ষতি হবে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেখানকার নদীতে থাকা ডলফিন যদি অন্যত্র সরে গিয়ে থাকতে পারে, তবে এ ধরনের হুমকি থেকে নিজেরাই তাদের রক্ষার করতে সক্ষম হবে। তবে ছড়িয়ে পড়া তেলের প্রভাবে সুন্দরবনের জ্বলজ প্রাণী ও উদ্ভিদের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির আশঙ্কা  রয়েছে।
প্রফেসর শেখ বুলবুল  বলেন, যেহেতু প্রকৃতিগতভাবেই ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট তাদের ক্ষতি কাটিয়ে ওঠে, তাই নিয়মিত জোয়ার-ভাটা অব্যাহত থাকলে সুন্দরবনও এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠবে বলে তিনি আশা করেন।
এদিকে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যসহ ক্ষয়-ক্ষতি নিরূপণে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবকে প্রধান করে নয় সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি ১৫ দিনের মধ্যে রিপোর্ট পেশ করবে।
ভাসমান তেল সুন্দরবনে ছড়িয়ে পড়া রোধে ও তেল তোলার সুবিধার্থে জোয়ারের সময় খালগুলোতে ফার্নেস অয়েল যাতে ঢুকতে না পারে সে জন্য বৃহস্পতিবারই  খালগুলোর মুখে নেট দিয়ে প্রতিবন্ধক  দেয়া হয়।
এদিকে তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির বাগেরহাট জেলা শাখার সদস্যসচীব ফররুক হাসান জুয়েল তাদের জাতীয় কমিটির বরাত দিয়ে দাবি করেন, “একটি অয়েল ট্যাংকারের তেলে যদি সুন্দরবনের এ অপূরণীয় ক্ষতি হতে পারে  তাহলে সুন্দরবনের পাশে রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হলে কী হুমকির সৃষ্টি হবে তা বলাই বাহুল্য।” তিনি বলেন, “সরকারের এ হটকারী সিদ্ধান্তের ফলে বনটি একসময় ধ্বংস হয়ে যাবে। আমরা সরকারকে এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে অবিলম্বে সুন্দরবনের পাশে তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র  নির্মাণ বন্ধের দাবি জানাই।” 

No comments

Powered by Blogger.