সমগ্র বিশ্বে শান্তির প্রত্যাশা মালালা’র

নারী শিক্ষা অধিকার আন্দোলনের অকুতোভয় সৈনিক মালালা ইউসুফজাই অসলোতে আয়োজিত জমকালো আয়োজনে গ্রহণ করেন নোবেল শান্তি পুরস্কার। বিশ্ব নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে বক্তব্য দিয়েছেন স্বাচ্ছন্দ্য ভঙ্গিমায়। বিশ্বব্যাপী মেয়েদের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে তার দৃঢ় অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছেন তিনি। বক্তব্যের শুরুতে নোবেল পুরস্কারে নির্বাচিত করার জন্য নোবেল কমিটির প্রতি বিনীত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। বিশ্বের প্রতিটি প্রান্ত থেকে পাওয়া সমর্থন শুভেচ্ছার জন্য শুভানুধ্যায়ীদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছেন তার পিতা মাতার প্রতি। তিনি বলেন, আমার পাখা না কেটে উড়তে দেয়ার জন্য বাবা তোমাকে ধন্যবাদ। আর মাকে ধন্যবাদ আমাকে ধৈর্যশীল হতে এবং সর্বদা সত্য বলতে অনুপ্রাণিত করার জন্য। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস এটাই ইসলামের সত্যিকারের বার্তা। প্রথম পাসতুন, প্রথম পাকিস্তানি এবং প্রথম সব থেকে কমবয়সী হিসেবে এ পুরস্কার গ্রহণ করতে পেরে আমি গর্বিত। কৈলাস সত্যার্থীর সঙ্গে যৌথভাবে নোবেল পাওয়া সম্মানের উল্লেখ করে মালালা বলেন, তিনি শিশু অধিকার আদায়ে দীর্ঘদিনের একজন চ্যাম্পিয়ন। আমি আনন্দিত যে, আমরা একসঙ্গে একমঞ্চে দাঁড়িয়ে বিশ্বকে দেখাতে পেরেছি যে একজন ভারতীয় এবং একজন পাকিস্তানি শান্তিতে একত্র হতে পারে। একসঙ্গে শিশু অধিকারের জন্য কাজ করতে পারে। মালালা বলেন, এ পুরস্কার শুধু আমার জন্য নয়। এটা বিস্মৃত ওই সকল শিশুর জন্য যারা শিক্ষা গ্রহণ করতে চায়। এটা ওই সকল ভীতসন্ত্রস্ত শিশুদের জন্য যারা শান্তি চায়। কণ্ঠহীন ওই সব শিশুদের জন্য এ পুরস্কার যারা পরিবর্তন চায়। আমি এখানে এসেছি তাদের অধিকারের পক্ষে দাঁড়ানোর জন্য। তাদের কণ্ঠ জোরদার করার জন্য। তাদের প্রতি করুণা প্রদর্শনের সময় এটা নয়। এখন পদক্ষেপ নেয়ার সময় যেন আর কখনও কোন শিশুকে আমরা শিক্ষাবঞ্চিত না দেখি। আমি দেখেছি মানুষ আমাকে বিভিন্ন ভাবে বর্ণনা করে। কেউ বলে, তালেবানের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়েছিল যে মেয়েটি। কেউ বলে নিজ অধিকারের জন্য লড়াই করেছে যে মেয়ে। কেউ আবার এখন আমাকে নোবেল লরিয়েট বলছে। আমি যতটুকু বুঝি, আমি শুধুমাত্র দৃঢ়চিত্ত এবং জেদি একজন মানুষ যে প্রতিটি শিশুর মানসম্পন্ন শিক্ষাপ্রাপ্তি দেখতে চায়। যে নারীদের সমঅধিকার চায় আর বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে শান্তি দেখতে চায়। মালালা বলেন, আমার ১৭ বছরের জীবনের অভিজ্ঞতায় আমি জেনেছি, শিক্ষা মানুষের জীবনের অন্যতম আশীর্বাদ আর অন্যতম প্রয়োজনীয় একটি দিক। নারী শিক্ষার পক্ষে কথা বলার জন্য তালেবানের হাতে গুলিবিদ্ধ হবার ঘটনা স্মরণ করে তিনি বলেন, সেদিন তাদের বন্দুকের গুলি জিততে পারেনি। আমরা বেঁচে গেছি। আর ওই দিনের পর থেকে আমাদের কণ্ঠ আরও জোরালো হয়েছে। আমি আমার গল্প এজন্য বলি না যে এটা এমন ঘটনার একমাত্র নজির। বরং এজন্য বলি যে এটা একমাত্র নজির নয়। এটা অনেকে মেয়েদের জীবনের গল্প। আমাকে একজন মেয়ে, একজন ব্যক্তি বলে মনে হলেও, আমি শুধু আমার কণ্ঠ নই। আমি একা মালালা নই, আমি অনেকে। আমি শাজিয়া, কায়েনাত, মেজন, আমিনা। আমি ওই ৬ কোটি ৬০ লাখ মেয়ে যারা শিক্ষাবঞ্চিত। আমি বিশ্বনেতাদের একত্র হতে আহ্বান জানাই। শিক্ষাকে প্রধান অগ্রাধিকার দিতে আহ্বান জানাই। আমরা যেহেতু আধুনিক যুগে বাস করছি। একুশ শতকে আমরা চাঁদে যেতে পারি। হয়তো মঙ্গলেও যাবো দ্রুত এই একুশ শতকে। একইসঙ্গে আমাদের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে হবে যে সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষার স্বপ্নও যেন বাস্তবায়ন হয়। কাজেই আসুন সবার জন্য সাম্যতা, ন্যায়বিচার আর শান্তি প্রতিষ্ঠা করি। শুধুমাত্র বিশ্বের রাজনীতিক আর বিশ্ব নেতারা নয়। আমাদের সবাইকে অবদান রাখতে হবে। আমি, আপনি। এটা আমাদের দায়িত্ব। আসুন একসঙ্গে উন্নত ভবিষ্যৎ গড়ে তুলি। এখনই, এখানেই।
পুরস্কার গ্রহণকালে মালালা আরও বলেন, মেয়ে শিশুদের শিক্ষার প্রচার, প্রসার ও তাদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের অগ্রপথিক পাকিস্তানের ১৭ বছর বয়সী নির্ভীক কিশোরী মালালা ইউসুফজাই সবচেয়ে কম বয়সে নোবেল পাওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন। মালালার সঙ্গে নোবেল শান্তি পুরস্কার গ্রহণ করলেন ভারতের শিশু অধিকার কর্মী কৈলাস সত্যার্থী (৬০)। এরই মধ্যে বহু বিরল সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন মালালা। নোবেল গ্রহণের প্রাক্কালে এক সংবাদ সম্মেলনে মালালা ইউসুফজাই বলেন, আমরা এখানে শুধু আমাদের পুরস্কার গ্রহণ করতে আসি নি, এই মেডেলটি নিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে আসি নি। আমরা এখানে বিশেষ করে শিশুদের বলতে এসেছি, তোমাদের উঠে দাঁড়াতে হবে, তোমাদের অধিকার সম্পর্কে তোমাদেরকেই মুখ খুলতে হবে। তোমরাই পারো বিশ্বকে পরিবর্তন করতে। ১৫ বছর বয়সে পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকায় মালালার মাথায় গুলি করে তালিবানরা। এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য গুরুতর অবস্থায় তাকে ইংল্যান্ডে পাঠানো হয়। বার্মিংহামের একটি হাসপাতালে তার মাথায় অস্ত্রোপচার করা হয় এবং ধীরে ধীরে সেরে ওঠেন মালালা। সেখানেই স্কুলে ভর্তি হন তিনি এবং তার পরিবারের সদস্যরাও তার সঙ্গে সেখানে বসবাস শুরু করেন। মালালা মেয়ে শিশুদের শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় সেখানেই বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন এবং এ পর্যন্ত নানা বিরল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী হতে চান মালালা
মেয়ে শিশুদের শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের অকুতোভয় কিশোরী পাকিস্তানের মালালা ইউসুফজাই (১৭)। নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হওয়ার আগে মালালা বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন তার ভবিষ্যৎ ইচ্ছার কথা। মালালা বললেন, তিনি রাজনীতিতে ক্যারিয়ার গড়তে চান। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন তিনি। নোবেল জয়ী এ কিশোরী বলছিলেন, আমি আমার দেশের সেবা করতে চাই এবং আমার স্বপ্ন হচ্ছে আমার দেশ উন্নত দেশে পরিণত হবে এবং প্রতিটি শিশু পড়ালেখার অধিকার পাবে। এ খবর দিয়েছে অনলাইন বিবিসি।
বৃটেনে পড়াশোনা শেষ করার পর তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আকাঙ্ক্ষা লালন করতে পারেন বলে মন্তব্য করেন। মালালা বলেন, যদি আমি রাজনীতি এবং প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে আমার দেশকে সবচেয়ে ভালভাবে সেবা করতে পারি, সে ক্ষেত্রে আমি অবশ্যই সেটাকে বেছে নেবো। বেনজীর ভুট্টো তার অনুপ্রেরণা বলে জানান মালালা ইউসুফজাই। ২০০৭ সালে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত দুই মেয়াদে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন বেনজীর।

No comments

Powered by Blogger.