মিরপুরে বাস আটকে ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি

চাঁদা না দিয়ে রাজধানীর মিরপুরের বাঙলা কলেজের সামনে দিয়ে বাস চলাচলে অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে কলেজ শাখা ছাত্রলীগ। কলেজের সামনে দিয়ে বাস চালাতে হলে ছাত্রলীগের সভাপতি-সেক্রেটারিকে নির্দিষ্ট অঙ্কের চাঁদা দিতে হয়। না হলে বিভিন্ন অজুহাতে বাস ভাঙচুর বা অগ্নিসংযোগ করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ নিয়ে পুলিশে অভিযোগ করেও কোন লাভ হয় না। উল্টো পুলিশের পক্ষ থেকে বাস মালিকদের বলা হয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সমঝোতা করে চলতে। এ কারণে অনেকটা বাধ্য হয়ে কোন কোন বাস কোম্পানির মালিক বাঙলা কলেজের ছাত্রলীগের সভাপতি-সেক্রেটারিকে মাসিক হারে, কোন কোন কোম্পানি দৈনিক ভিত্তিতে চাঁদা পরিশোধ করে। চাঁদার পরিমাণ কম হওয়ায় গত বুধবার গাবতলী-আব্দুল্লাহপুর রুটে চলাচলকারী নিউ পল্লবী এক্সপ্রেসের ৮টি বাস কলেজ প্রাঙ্গণে আটকে রাখা হয়। দুপুরে আটকানোর পর সন্ধ্যায় কলেজ প্রাঙ্গণ থেকে বাসগুলো উদ্ধার করে পুলিশ। কিন্তু এ ঘটনাতেও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা নিতে অনীহা প্রকাশ করছে থানা পুলিশ। মামলা না নিয়ে উল্টো পুলিশের পক্ষ থেকেই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সমঝোতা করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, চাঁদা ছাড়া বাস চলাচলে অঘোষিত এই নিষেধাজ্ঞা জারির প্রধান দুই হোতা বাঙলা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি এইচ এম জাহিদ মাহমুদ ও মজিবুর রহমান ওরফে অনিক। দিদার নামে এক ব্যক্তিকে দিয়ে চাঁদার টাকা তোলা হয়। গত সেপ্টেম্বর মাসে জাহিদ ও অনিক সভাপতি-সেক্রেটারি হয়েছেন। এরপর থেকেই তারা বেপরোয়া চাঁদাবাজি শুরু করেছেন। অনেকেই মন্তব্য করছেন, আগের সভাপতি-সেক্রেটারি এত বেপরোয়া ছিল না। বাস মালিকরা বলছেন, বাঙলা কলেজের সামনে দিয়ে সিটিং সার্ভিসেরই প্রায় দুই শতাধিক বাস চলে। এছাড়া লোকাল বাস তো আছেই। প্রতিটি বাসের কাছ থেকেই চাঁদা আদায় করা হয়। তবে কোন কোন বাস মালিক মাসিক হারে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের চাঁদার টাকা পরিশোধ করে থাকেন। একাধিক বাস মালিক ছাত্রলীগের সভাপতি-সেক্রেটারিকে নিয়মিত চাঁদা দেয়ার কথা স্বীকার করলেও তাদের নাম প্রকাশ না করতে অনুরোধ করেছেন। তাদের ভাষ্য, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে কথা বললেই নানা অজুহাতে কলেজের সামনে বাস আটকানো ও ভাঙচুর শুরু করবে। একজন মালিক বলেন, একটি বাসের সামনের গ্লাস লাগাতে প্রায় ২০ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। সাইড গ্লাস লাগাতে খরচ হয় ১০ হাজার টাকা। ওই মালিক বলেন, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে চাঁদা আদায় করে। নিজেরাই হাতে বা মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে কোন একটি পরিবহন সার্ভিসের বাস দুর্ঘটনায় সে আহত হয়েছে- মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে পরে ওই সার্ভিসের কয়েকটি গাড়ি আটকিয়ে কলেজ ক্যাম্পাসের ভেতর আটকে রাখে। মালিককে ফোন করে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে বাস ছাড়িয়ে আনতে বলে।
সূত্র জানায়, গাবতলী থেকে বাঙলা কলেজের সামনে দিয়ে যে বাসগুলো চলাচল করে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- রফরফ পরিবহন, বসুমতি পরিবহন, পল্লবী সুপার সার্ভিস, প্রজাপতি পরিবহন, নিউ পল্লবী এক্সপ্রেস ও জাবালে নূর পরিবহন। প্রায় প্রত্যেক বাস মালিকই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীকে নিয়মিত চাঁদা দিলেও ভয়ে অনেকেই মুখ খুলতে চান না। নিউ পল্লবী এক্সপ্রেসের পরিচালক (অর্থ) সিরাজুল হক জানান, গত অক্টোবর মাসে তারা গাবতলী-আবদুল্লাহপুর রুটে ৩০টি বাস নামান। বাস চলাচল শুরুর কয়েক দিন পরেই বাঙলা কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বাসপ্রতি প্রতিদিন ২০০ টাকা করে চাঁদা দাবি করেন। তা না হলে বাস চলাচল বন্ধ করে দিতে বলেন। তারা বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় থানা পুলিশ, এমপি ও যুবলীগের ঢাকা মহানগর উত্তরের এক নেতাকে জানান। তারাও হস্তক্ষেপ করে বিষয়টি সুরাহা করতে পারেননি। পরে বাধ্য হয়ে বাসপ্রতি ২০০ টাকা হারে প্রতিদিন ৬০০০ এবং মাসে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা চাঁদা দেয়া শুরু করেন। কিন্তু সম্প্রতি সভাপতি ও সেক্রেটারি বাসপ্রতি ৩০০ টাকা করে দাবি করে। তারা এতে রাজি না হলে মোবাইলে বিভিন্ন হুমকি-ধমকি দিতে থাকেন। এ বিষয়ে গত মাসের ২২ তারিখ পল্লবী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি নং ২৬৮০) করেন। সেখানেও থানা পুলিশ তাকে পরামর্শ দেয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নাম উহ্য রাখতে।
সিরাজুল হক বলেন, গত বুধবার দুপুরে হঠাৎ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের আটটি বাস (ঢাকা মেট্রো ব-১১ সিরিয়ালের-৭১৫৭, ৭০১৯, ৭১০৯, ৭১১৮, ৭০৩৮, ৭১৭৩, ৭০৬৮ ও ৭১৪৯) কলেজ ক্যাম্পাসে নিয়ে আটকে রাখে। পরে বিষয়টি মিরপুরের সহকারী পুলিশ কমিশনার সাখাওয়াতকে জানালে তিনি থানা পুলিশকে বাসগুলো উদ্ধারের নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন। কিন্তু সন্ধ্যায় বাস উদ্ধারের পর থানায় গিয়ে কয়েক ঘণ্টা বসে থাকলেও পুলিশ মামলা নিতে অনীহা প্রকাশ করে। দারুসসালাম থানার ওসি রফিকুল ইসলাম ও সেকেন্ড অফিসার এমরানুল কবির তাদের বলেন, ‘ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে পারবেন না। যেভাবে পারেন ম্যানেজ করে চলেন।’ সিরাজুল হক বলেন, তার লিখিত একটি অভিযোগ থানার সেকেন্ড অফিসার হাতে নিয়েছেন কিন্তু বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত তা নথিভুক্ত করেননি। দারুসসালাম থানার ওসি রফিকুল ইসলাম বলেন, এ ঘটনায় মামলা হয়নি। মামলা না নেয়ার অভিযোগও তিনি অস্বীকার করেন। পুলিশের মিরপুর অঞ্চলের উপ-কমিশনার নিশারুল আরিফ বলেন, আমি আমার এডিসি’র মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পেরেছি। আমি সঙ্গে সঙ্গে তাকে মামলা নিতে নির্দেশনা দিয়েছি। যদি থানা পুলিশ মামলা না নিয়ে থাকে তাহলে আমি এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো।

No comments

Powered by Blogger.