এক দফার আন্দোলনে যাচ্ছে ২০ দল by কাফি কামাল

নির্দলীয় সরকারের অধীনে দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে এক দফার আন্দোলনে যাচ্ছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট। শর্টটার্ম গুচ্ছ কর্মসূচির মাধ্যমে সেটাকে কার্যকর আন্দোলনে রূপ দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিরোধী নেতারা। জোটের বৈঠকে নেতারা কার্যকর আন্দোলনের কৌশল ও পরিকল্পনা নিয়ে নিজেদের মতামত ও প্রস্তাবনা তুলে ধরেছেন। বিএনপি চেয়ারপারসন ও জোটের শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়াকে দেয়া হয়েছে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার দায়িত্ব ও ক্ষমতা। সূত্র জানায়, নতুন বছরের প্রথম মাসের মধ্যেই সরকারের পতন আন্দোলনকে তুঙ্গে নিতে চায় ২০ দল। এ জন্য টার্গেট ধরা হয়েছে আগামী ৫ই জানুয়ারি। কারণ ওই দিন একতরফা নির্বাচনের এক বছর পূর্ণ হবে। ওই দিনটি সামনে রেখে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহেই বড় ধরনের কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামতে চায় তারা। কর্মসূচি কি হবে তা এখনও চূড়ান্ত না হলেও বিরোধী জোটের নেতারা একমত হয়েছেন দীর্ঘমেয়াদি নয় হরতাল, অবরোধ ও ঘেরাওয়ের মতো কার্যকর কর্মসূচির সমন্বয়ে আন্দোলন কৌশল প্রণয়ন করতে হবে স্বল্পমেয়াদি এবং লাগাতার। আর এবারের আন্দোলন কর্মসূচির সূত্রপাত ঘটাতে চান জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে। সেক্ষেত্রে তেল-গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ইস্যুই হতে পারে আগামী আন্দোলনের সূত্রপাত। গ্যাস ও জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে শুরু করে আন্দোলনকে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ দেয়ার একটি নীতিগত সিদ্ধান্তও হয়েছে জোটের বৈঠকে। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পর এর নানা অসঙ্গতি তুলে ধরে হরতাল দেয়ারও ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ২৯শে নভেম্বর কুমিল্লায় ২০ দলীয় জোটের সমাবেশ শেষে দল ও জোটের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পর কর্মসূচি চূড়ান্ত করা হবে। তবে ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় দিবস ও পরীক্ষার সময় কর্মসূচি এড়িয়ে যাওয়ারও সিদ্ধান্ত হয়। সূত্র জানায়, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দলের ভাইস চেয়ারম্যান, যুগ্ম মহাসচিব, সাংগঠনিক সম্পাদক, উপদেষ্টা ও জোটের নেতাদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠকে জোর দেয়া হয়েছে আন্দোলনের প্রস্তুতিও ওপর। জোটের শীর্ষ নেতা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া প্রতিটি বৈঠকে কঠোর মনোভাব দেখিয়েছেন। সর্বশেষ স্থায়ী কমিটির বৈঠকের পর জোটের বৈঠকেও তিনি বলেছেন, কেউ না থাকলেও তিনি একাই রাজপথে নামবেন। এ সময় তিনি জোটের শরিক দলের নেতাদের কাছেও আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে রাজপথে থাকার অঙ্গীকার আদায় করেন। খালেদা জিয়া বলেন, এর আগে সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে ধারাবাহিক যে বৈঠক করেছি সেখানেও তাদের রাজপথে থাকার অঙ্গীকার করিয়েছি। আপনারা নামবেন কিনা? এসময় শরিক দলের নেতারা রাজপথে থাকার অঙ্গীকার করেন। এদিকে সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও আগামী আন্দোলনের প্রস্তুতি নিয়ে দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠকের পর জোটের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন ২০দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা খালেদা জিয়া। শনিবার রাতে দীর্ঘ দেড় ঘণ্টার বৈঠকে শরিকদের কাছ থেকে আন্দোলন কর্মসূচি সম্পর্কে মতামত জানতে চান তিনি। নেতারা বলেন, ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের পর সরকারবিরোধী আন্দোলন গুটিয়ে নেয়া সঠিক হয়নি। সরকারবিরোধী আন্দোলন ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে যাওয়াই উচিত ছিল। জোটের শীর্ষ নেতারা একমত হয়েছেন, ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা বর্তমান সরকারকে আরও সময় দিলে তারা জেঁকে বসবে। সরকার যত সময় পাবে, তত শক্ত হবে। তাই শিগগিরই কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমে এ সরকারের পতন ঘটাতে হবে। এ জন্য জনগণের স্বার্থবিরোধী বিভিন্ন কর্মকা-কে ইস্যু হিসেবে নিয়ে আন্দোলনের মাঠে নামতে হবে। তারা প্রায় সকলেই টানা আন্দোলনের পক্ষে মত দেন। জোটের নেতারা বলেন, টানা আন্দোলন কোনভাবেই দীর্ঘমেয়াদি নয়। কারণ লং টার্ম আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া কঠিন। শর্ট টার্মে সরকার পতনের আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে অবরোধের মতো কর্মসূচি দিলেই ভাল। কারণ আমরা অবরোধ ডাকলে সরকার নিজেই সারাদেশ অবরোধ করে ফেলে। আর ঢাকাকেই আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। নেতারা বলেন, ২০ দলের বাইরেও অনেক দল আছে। তারা জোটে আসুক না আসুক, কমপক্ষে তারা যাতে আমাদের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে আসে সে ব্যাপারে চিন্তা করা উচিত। জোটের নেতারা বলেন, দিনক্ষণ ঠিক করে আন্দোলন হয় না। একটি ঘটনাই স্ফুলিঙ্গের মতো আন্দোলন ছড়িয়ে দিতে পারে। সরকার আগামী জানুয়ারি মাসের শুরুতে গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জনসম্পর্কিত এ ইস্যুকে কেন্দ্র করে রাজপথে আন্দোলন গড়ে তোলা হলে জনগণও তাতে সমর্থন জানাবে। তবে বৈঠকে উপস্থিত জোট নেতারা সরকারবিরোধী চূড়ান্ত আন্দোলনের কৌশল নির্ধারণের বিষয়টি খালেদা জিয়ার উপরেই ছেড়ে দেন। তারা বলেন, আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়েই আপনি রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছিলেন। আপনার চেয়ে আন্দোলন আর কেউ ভাল বোঝে না। আন্দোলনের জন্য জনগণ তৈরি আছে। তারা এখন আপনার ডাকের অপেক্ষায় রয়েছে। তবে মানুষের অংশগ্রহণের আগে নিজেদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। জোট নেতাদের প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জানিয়ে খালেদা জিয়া বলেছেন, এ ইস্যুতে রাজপথে নেমে তা অব্যাহত রাখতে হবে। ধারাবাহিক কর্মসূচি মধ্য দিয়ে আন্দোলনকে সরকার পতনের এক দফায় রূপ দিতে হবে। সে জন্য সকলকে রাজপথে নামতে হবে। হাসিনাকে না সরানো পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। এ জন্য যে কোন ত্যাগ এমনকি জীবন দিতে সকলকে প্রস্তুত থাকতে হবে।
বৈঠকে জোটের এক শীর্ষ নেতা সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের নতুন যে তালিকা করতে যাচ্ছে সে বিষয়ে বলেন, এতে জাতীয়তাবাদী আদর্শে বিশ্বাসী অনেককেই বাদ দেয়া হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নিলেও দলীয় বিবেচনায় অনেককে মুক্তিযোদ্ধা বানানো হচ্ছে। এ সম্পর্কে জোটের পক্ষ থেকে জোরালো প্রতিবাদ জানানো উচিত। এসময় খালেদা জিয়া বলেন, চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পর এর নানা অসঙ্গতি তুলে ধরে কঠিন কর্মসূচি দেয়া হবে। আলোচনার এক পর্যায়ে বৈঠকে উপস্থিত জামায়াত নেতার উদ্দেশ্যে খালেদা জিয়া বলেন, আপনারা যেভাবে হাঁকডাক দিয়ে কর্মসূচি ঘোষণা করছেন সেভাবে আপনাদের রাজপথে দেখা যাচ্ছে না। গত কয়েকটি হরতালে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি ছিল অনেক কম। ভবিষ্যত আন্দোলনে যাতে নেতাকর্মীরা রাজপথে নামে সে প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দেন তিনি। বৈঠক সূত্র জানায়, বৈঠকে বেশির ভাগ নেতাই তাদের বক্তব্যে আগামী বিজয় দিবসকে জোটগতভাবে অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে পালনের পক্ষে মত দেন। তাদের মতের সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করে খালেদা জিয়াও। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ মহান স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসকে তাদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে মনে করে। তারা মনে করে তারাই মুক্তিযুদ্ধের ‘সোল এজেন্ট’। অথচ বিএনপিসহ বিশ দলীয় জোটের মধ্যেই বেশি সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধার অবস্থান। বিএনপি মুক্তিযোদ্ধার গড়া রাজনৈতিক দল। সে জন্য বিজয় দিবসকে ঘিরে বিএনপি ও জোটকে ব্যাপক কর্মসূচি পালনের প্রস্তুতি নিতে হবে। একই সঙ্গে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এ অনুষ্ঠান পালন করা হবে। সূত্র জানায়, বৈঠকে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমামের বক্তব্য নিয়ে আলোচনা হয়। এ প্রসঙ্গে খালেদা জিয়া জোট নেতাদের বলেন, বিষয়টি সাধারণ মানুষের মাঝে আরও বেশি করে প্রচার করতে হবে। যাতে ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন যে প্রশ্নবিদ্ধ ছিল তা মানুষের কাছে আরও স্পষ্ট হবে। বিদেশীরাও ওই নির্বাচন নিয়ে যে অভিযোগ করে আসছিল তা অব্যাহত রাখতে এবং সরকারকে সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন দিতে চাপ দিন। এছাড়া সজীব ওয়াজেদ জয়কে প্রধানমন্ত্রীর অবৈতনিক তথ্য ও প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা করে দু’দিন আগে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এর অনেক আগে থেকেই তো তিনি প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা। তাহলে এতদিন তিনি কিসের ভিত্তিতে উপদেষ্টা ছিলেন? এ প্রশ্নটি জনগণের কাছে ছড়িয়ে দিতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.