সংঘর্ষের নেতৃত্বে শাবি ছাত্রলীগের ৪ নেতা by ওয়েছ খছরু

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষে নেতৃত্বে ছিল বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগে ৪ নেতা। ঘটনার দিন অস্ত্র হাতে সম্মুখ সংঘর্ষে তাদের নেতৃত্ব দিতে দেখা গেছে। আর তাদের চারপাশে মারমুখো অবস্থানের ছিল বিশ্ববিদ্যালয় ও বহিরাগত ছাত্রলীগ নেতারা। ঘটনার শুরুতে যখন পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে তখন ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে অবিরাম গুলিবিনিময়ের ঘটনা ঘটে। আর এতেই প্রাণ গেছে ছাত্রলীগ নেতা সুমন দাসের। ঘটনাটি নিয়ে ছাত্রলীগ সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগের বক্তব্য নিয়ে তোলপাড় চলছে সিলেটে। সোহাগ ঘটনার পরদিন সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছিলেন, শাবির ঘটনায় ছাত্রলীগ জড়িত নয়। তবে, সিলেট জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের নেতারা বলেছেন, সংঘর্ষের সঙ্গে ছাত্রলীগের কোন নেতার সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে দলীয় সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। শাহজালাল  বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের বিবদমান গ্রুপিং এতটাই তুঙ্গে ছিল যে বিভিন্ন সময় সংঘর্ষে আহত হয়েছেন অনেকেই। সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শামসুজ্জামান আহত হওয়ার ঘটনায় ছাত্রলীগ নেতা উত্তমকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। এরপর হামলায় আহত হয়েছিল ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইমরানও। সূত্র জানিয়েছে, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ছাত্রলীগের দু’টি গ্রুপ। এর মধ্যে এক গ্রুপের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি সঞ্জীবন চক্রবর্তী পার্থ। তার সঙ্গে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের বেশির ভাগ নেতা-কর্মী। এর মধ্যে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইমরান, সহসভাপতি আবু সাইদ ও যুগ্ম সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সবুজ। অপরপক্ষে রয়েছে ছাত্রলীগের সহসভাপতি অঞ্জন দাস। তার সঙ্গে সম্পৃক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা ও মহানগর ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক উত্তম কুমার। এজন্য অঞ্জন ও উত্তম সিলেটি হওয়ায় ক্যাম্পাসের বাইরের বলয়ে তাদের শক্তিশালী অবস্থান ছিল। আর পার্থ, সাইদ ও সবুজ ক্যাম্পাসের ভেতরেই শক্তিশালী অবস্থানে থাকায় কখনও ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তার করতে পারেনি উত্তম ও অঞ্জন অংশের নেতারা। প্রায় দেড় বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের কমিটি গঠনকালে ক্যাম্পাস দখল নিয়ে বিরোধ তুঙ্গে হয়ে উঠেছিল। সেই থেকে দু’টি পক্ষ আলাদা হয়ে যায়। উত্তম ও অঞ্জন ক্যাম্পাসের বাইরের শক্তি নিয়ে রাজনীতি করতো। তারা দু’জন সিলেট ছাত্রলীগের কাশ্মীর গ্রুপের শীর্ষ নেতা বলে পরিচিত। বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া সিলেট নগরীতে কাশ্মীর গ্রুপের শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, সংঘর্ষের দিন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি অঞ্জনের নেতৃত্বে দেড় শতাধিক বহিরাগত সশস্ত্র অবস্থায় ক্যাম্পাসে অবস্থান নেয়। তারা আখালিয়া নতুন বাজার এলাকা দিয়ে প্রবেশ করে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ ও ককটেল বিস্ফোরণ  ঘটায়। এ সময় হল সহ বিভিন্ন ভবনে ছিল পার্থ গ্রুপের নেতারা। অঞ্জন গ্রুপের ২০ মিনিটের শোডাউনের পর তাদের মুখোমুখি হয় পার্থ গ্রুপের নেতারা। আর এ অংশে নেতৃত্বে ছিল ছাত্রলীগ সভাপতি পার্থ, সহসভাপতি সাইদ ও যুগ্ম সম্পাদক সবুজ। ঘটনার দিন ছাত্রলীগ সভাপতি পার্থের হাতে রামদা দেখা যায়। তার আশপাশ এলাকায় যে সব ছাত্রলীগ কর্মী ছিল তাদের হাতেও ছিল দেশী অস্ত্র। পেছনে ছিল তার গ্রুপের অস্ত্রধারীদের অবস্থান। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ ৭ সদস্য বিশিষ্ট। এর মধ্যে পার্থের পক্ষে তিনজনই সংঘর্ষের সময় মূল নেতৃত্বে ছিল। অপরদিকের নেতৃত্বে ছিল সহসভাপতি অঞ্জন দাস। সংঘর্ষ ছাত্রলীগ নেতা খুনের ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পুলিশের পক্ষ থেকেও ওই চার নেতার নাম মিডিয়ার কাছে জানানো হয়েছিল। এমনকি সংঘর্ষের সময় সাজেদুল ইসলাম সবুজ ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের কাছে বলেছিল, অঞ্জন গ্রুপের নেতারা বহিরাগতদের নিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে হামলা চালায়। তারা তাদের প্রতিহত করেছে। শাবির ঘটনার পর ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সভাপতির বক্তব্যে ক্ষোভ জানিয়েছে অনেক নেতা। এমনকি সংবাদমাধ্যমে পাঠানো খোলা চিঠির মাধ্যমে উত্তম ছাত্রলীগ সভাপতির বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করেছে। ছাত্রলীগ নেতা অঞ্জন সাংবাদিকদের জানিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সভাপতি সঞ্জীবন চক্রবর্তী পার্থ, সহসভাপতি আবু সাঈদ ও যুগ্ম সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সবুজের নেতৃত্বে অস্ত্রধারীরা গুলি করে সুমনকে খুন করেছে। ওই তিন নেতার সঙ্গে তাদের পুরনো দ্বন্দ্ব রয়েছে বলে স্বীকার করেছে অঞ্জন। ওদিকে, ঘটনার পর পুলিশও জানিয়েছিল  বিশ্ববিদ্যালয়ের আধিপত্য নিয়ে ছাত্রলীগের দু’টি গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। জালালাবাদ থানার ওসি জানিয়েছেন, ঘটনার পর অভিযান চালিয়ে ছাত্রলীগ কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের রিমান্ডও চাওয়া হয়েছে। আর অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে ছাত্রলীগ নেতা শিপলুর বাসা থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর হিমাদ্রি শেখর সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষ ও সুমন খুনের ঘটনার দায় ছাত্রলীগের। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কর্মকর্তারা সেদিন জীবনবাজি রেখে সংঘর্ষ থামিয়েছেন। এ কারণে তিনি নিজেও গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। তবে, সিলেট মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি রাহাত তরফদার জানিয়েছেন, সিলেটের ঘটনা সম্পর্কে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি ওয়াকিবহাল রয়েছে। যদি এ ঘটনায় কেউ জড়িত থাকে তবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এদিকে, সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের গ্রুপের সংঘর্ষের পর তিন দিন অতিবাহিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার সংঘর্ষের পরই বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় সাবেক রেজিস্টার ও গণিত বিভাগের অধ্যাপক ইলিয়াছুর রহমান বিশ্বাসকে প্রধান করে ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে দেয়া হয়েছিল। তিন দিনেও ওই কমিটি তাদের কাজ শুরু করতে পারেনি। কবে নাগাদ কমিটি কাজ শুরু করতে পারবে তা-ও বলতে পারছেন না তদন্ত কমিটির প্রধান অধ্যাপক ইলিয়াছুর রহমান। অধ্যাপক ড. ইলিয়াস উদ্দিন বিশ্বাস বলেন, সরকারি ছুটি থাকার কারণে তদন্ত কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি। ওদিকে, সুমন ছাত্রলীগের কেউ নয়- ছাত্রলীগ সভাপতির এমন বক্তব্যে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে ফেসবুকে। নিহত সুমনের ফেস আইডিতে ছাত্রলীগের কর্মকা-ে  সুমনের উপস্থিতি সংবলিত ছবি প্রকাশ করেছে তার সহকর্মীরা। সুমন খুন হওয়ার দুই দিন আগে যুক্তরাজ্য থেকে সিলেটে ফেরেন সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুজ জহির চৌধুরী সুফিয়ান। সুমন ওই দিন রাতে তার গ্রুপের নেতা-কর্মীদের নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানায়। এ ছাড়া শিবিরের হরতাল বিরোধী ছাত্রলীগের মিছিলের অগ্রভাগে দেখা গেছে সুমনকে। সিলেট নগরীর ৯নং ওয়ার্ড ও এসআইইউ’র ব্যানারে ওই মিছিলের নেতৃত্বে ছিল সুমন নিজেই। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজের সঙ্গেও রয়েছে সুমনের ছবি।

No comments

Powered by Blogger.