দশম সংসদ নির্বাচন নিয়ে ব্যাপক লেখালেখি ও গবেষণা হওয়া উচিত by মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার

গণতান্ত্রিক দেশে সংসদ নিবাচনকে ঘিরে রাজনীতি আবর্তিত হয়। কারণ, এমন নির্বাচনে যে দল জয়লাভ করে, সে দলই সরকার গঠন করে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পায়। স্থানীয় সরকারসহ অন্য যত রকম নির্বাচন আছে, ওই সব নির্বাচনে জয়লাভ করে একটি দল তার ভাবমূর্তির উন্নতি করতে পারলেও ক্ষমতায় যেতে পারে না। সে কারণে অন্যান্য নির্বাচনের চেয়ে গণতান্ত্রিক দেশে সংসদ নির্বাচন অধিক গুরুত্ব পায়। যেসব দেশে গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। সেখানে নির্দিষ্ট মেয়াদান্তে সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার দেশ সব দিক থেকে পিছিয়ে পড়ে।
কোনো দেশে যদি সংসদ নির্বাচনে দুর্নীতি-কারচুপি হয়, ভোটাররা স্বাধীনভাবে ভোট দিতে না পারেন, তাহলে ওই নির্বাচনকে সবারই নিন্দা করা উচিত। কারণ, দুর্নীতি-কারচুপিরগঠন সাধারণ রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। ওই দেশগুলোতে নির্বাচন স্বচ্ছভাবে অনুষ্ঠিত হয় এবং নির্বাচনে জনগণ যে রায় প্রদান করেন, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলো সে রায় মেনে নেয়। নির্বাচনের পর পরাজিত দল বিজয়ী দলকে অভিনন্দন জানিয়ে তাদের দেশ পরিচালনায় সহায়তা করার প্রতিশ্র“তি প্রদান করে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্বাচনের পূর্বাপর কোনো রকম রাজনৈতিক সহিংসতা হয় না। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলগুলো তাদের প্রার্থীর পক্ষে বাযদি নির্বাচনেধাহীনভাবে প্রচার-প্রচারণা করতে পারে এবং ভোটাররা স্বাধীনভাবে ভোট প্রদান করেন। কিন্তু যেসব দেশে গণতন্ত্র এখনও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি, ওই দেশগুলোতে অনেক ক্ষেত্রে সংসদ নির্বাচন সুচারুভাবে সম্পন্ন হয় না। শক্তিশালী দল বা ক্ষমতাসীন দল অনেক সময় দুর্নীতি-কারচুপি বা ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করে নির্বাচন জিততে চেষ্টা করে। এর ফলে অন্য দলগুলো ওই নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতে চায় না। ফলে দেশে সরকারবিরোধিতা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। এর ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। কাজেই একটি দেশে সংসদ নির্বাচন স্বচ্ছ এবং গ্রহণযোগ্য না হলে ওই নির্বাচনকে সমর্থন করলে এবং ওই রকম নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন হয়ে কোনো সরকার দেশ পরিচালনায় নিয়োজিত হলে ভবিষ্যতের নির্বাচনগুলোতে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলো আবারও দুর্নীতি-কারচুপি করতে উৎসাহিত হয়। এ জন্য নির্বাচন নিয়ে লেখক-গবেষকদের বেশি বেশি করে কাজ করা উচিত। প্রতিটি নির্বাচনের ত্র“টি-বিচ্যুতি ও ভালো-মন্দ ভোটারদের কাছে বস্তুনিষ্ঠভাবে তুলে ধরা উচিত। বাংলাদেশের মতো অনেক উন্নয়নশীল দেশে লেখক-গবেষকদের এ প্রচেষ্টা উল্লেখযোগ্যভাবে দুর্বল। এখানে লেখক-গবেষক-প্রকাশকদের মধ্যেও রাজনৈতিক বিভাজন লক্ষ্য করা যায়। ফলে নির্বাচন নিয়ে গবেষণা ও লেখালেখি তুলনামূলকভাবে কম হয়। এ ক্ষেত্রে যদিও কিছু কাজ হয়, সেগুলোয় অনেক ক্ষেত্রেই নিরপেক্ষতা ও বস্তুনিষ্ঠতার প্রতিফলন খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে অধিকাংশ নির্বাচনের ওপর সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রবন্ধ ও প্রতিবেদন এবং দেশী-বিদেশী নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের প্রকাশিত রিপোর্ট পাওয়া যায়। তবে এসব প্রতিবেদনের মধ্যে বস্তুনিষ্ঠতা এবং গভীর গবেষণার সুস্পষ্ট অভাব থাকে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে যেসব নির্বাচনে দুর্নীতি-কারচুপি যত বেশি হয়েছে, সে নির্বাচনগুলোর ওপর গবেষণা কাজ তত কম হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। যেমন, চতুর্থ ও ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে ব্যাপক দুর্নীতি-কারচুপি হলেও ওই দুটি নির্বাচনের ওপর খুব বেশি গবেষণাকাজ লক্ষ্য করা যায় নি, যদিও পঞ্চম ও সপ্তম সংসদ নির্বাচন মোটামুটি ভালো হলেও ওই দুটি নির্বাচনের ওপর বেশ কিছু গবেষণাকাজ চোখে পড়ে। আসলে হওয়া উচিত ঠিক এর বিপরীত। নির্বাচন নিয়ে যেসব লেখক-গবেষক কাজ করেন, তারা অস্বচ্ছ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের বিরাগভাজন হওয়ার কথা চিন্তা করে এ বিষয়ে কলম ধরতে নিরুৎসাহিত হন কিনা, সে বিষয়টি ভেবে দেখার মতো। সরকারের গুডবুকে থাকতে উৎসাহী অনেক লেখক-গবেষক অস্বচ্ছ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন সরকারের কাছ থেকে সুবিধা পাওয়ার লক্ষ্যে হয়তো ওই নির্বাচনের জারিজুরি উন্মোচন করতে চান না।
স্বচ্ছ, অবাধ, অংশগ্রহণমূলক এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ওপর বেশি বেশি কাজ না করে সমাজবিজ্ঞানীদের উচিত অস্বচ্ছ ও দুর্নীতি-কারচুপির নির্বাচনগুলোর ওপর বেশি করে গবেষণাকাজ করা। এ লক্ষ্যে দশম সংসদ নির্বাচনের ওপর কাজ হওয়া উচিত সবচেয়ে বেশি। কারণ, সংসদ নির্বাচনগুলোর মধ্যে এ নির্বাচনটিতে সবচেয়ে বেশি, দুর্নীতি-কারচুপি এবং নির্বাচনী ইঞ্জিনিয়ারিং লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু লেখালেখি ও প্রকাশনায় তা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সাধারণ পাঠকরা ভাবতে পারেন যে, দশম সংসদ নির্বাচনের ওপর লেখক-গবেষকরা লিখলে তো আর নির্বাচনটি ভালো হয়ে যাবে না। তাহলে ওই নির্বাচনের ওপর লেখক-গবেষকরা না লিখলে অসুবিধা কোথায়? অসুবিধা আছে। বিষয়টি খোলাসা করা দরকার।
সম্মানিত পাঠক, মনে করুন আজ থেকে ১৫-২০ বছর পর নির্বাচনকেন্দ্রিক সাধারণ আলোচনায় যদি কেউ বলেন, বাংলাদেশে এরশাদ আমলে তৃতীয় ও চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ভালো হয়নি; বিএনপি আমলে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যাপক সন্ত্রাস-দুর্নীতি-কারচুপি হয়েছে; মহাজোট আমলে দশম সংসদ নির্বাচনেও অনেক দুর্নীতি-কারচুপি-সন্ত্রাস হয়েছে এবং উল্লিখিত নির্বাচনগুলো একদম ভালো হয়নি; তাহলে সাধারণ মানুষ হয়তো সে বিশ্লেষণ মেনে নেবেন। কারণ, সাধারণ মানুষ নির্বাচনবিষয়ক খুঁটিনাটি কিছুই দীর্ঘদিন মনে রাখতে পারবেন না। আর দীর্ঘদিন পর দশম সংসদ নির্বাচনকে অন্য দুর্নীতি-কারচুপির নির্বাচনের সঙ্গে একই কাতারভুক্ত করে মূল্যায়ন যদি সাধারণ মানুষ গ্রহণ করেন, তাহলে তা হবে একটি নির্জলা একাডেমিক ভ্রষ্ট্রাচার। আর এমনটি হলে এর জন্য আজকের নিষ্ক্রিয় মুখ-চোখ বোজা সুবিধাবাদী একাডেমিক এবং লেখক-গবেষকরাই দায়ী থাকবেন। কারণ, দশম সংসদ নির্বাচনটিকে কিছুতেই অন্য পাঁচ-দশটি নির্বাচনের সঙ্গে একই কাতারভুক্ত করে মূল্যায়ন করা যথার্থ নয়। না বললেও চলে, ওই নির্বাচনটিতে দুর্নীতি-কারচুপি, সহিংসতা এবং নির্বাচনী ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কায়দাটি ছিল একেবারেই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। সে কারণে ওই নির্বাচনটিকে অন্য দুর্নীতির নির্বাচনের সঙ্গে মিলিয়ে আলোচনা করলে তা সঠিক হবে না। ভুলে না যাওয়া ভালো, দশম সংসদ নির্বাচনটি ছিল পৃথিবীর সংসদীয় নির্বাচনের ইতিহাসে বিরল বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। কারণ, সেবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রধান দলটি ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়ে সরকার গঠনের যোগ্যতা অর্জন করে। বাকি ১৫৭টি আসনের মধ্যে ৯০টি আসনে নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে রিটার্নিং অফিসার ও প্রিসাইডিং অফিসারদের প্রেরিত ভোটসংখ্যায় মিল ছিল না। বিরোধীদলীয় বর্জন এবং সহিংসতায় ভোট কেন্দ্রে গিয়েছিলেন অত্যন্ত নগণ্যসংখ্যক ভোটার।
বাংলাদেশের লেখক-গবেষক এবং সুশীল সমাজ সদস্যদের সবসময় সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলার ব্যাপারে সাহসী ভূমিকা পালন করতে দেখা যায় না। এদের অনেকের মধ্যেই সুবিধাবাদী মনোভাব কাজ করে এবং ক্ষমতাসীনদের কাছ থেকে সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে অনেক সময় এদের অনেকেই নীতিভ্রষ্ট্র হয়ে পড়েন। সত্য এবং সাহসী উচ্চারণ করার মতো লেখক-গবেষকের সংখ্যা কমতে থাকলে ভবিষ্যতে দশম সংসদ নির্বাচনের মতো বিরল বৈশিষ্ট্যের অস্বচ্ছ ও নেতিবাচক নির্বাচনকে আর দশ-পাঁচটি দুর্নীতি-কারচুপির নির্বাচনের সঙ্গে একই কাতারভুক্ত করে ফেলা অসম্ভব হবে না। দশম সংসদ নির্বাচনকে এর প্রাপ্য স্থানে অধিষ্ঠিত রাখতে হলে বর্তমান সময়ের লেখক-গবেষক ও সমাজবিজ্ঞানীদের এ নির্বাচনটিকে তাদের গবেষণার আগ্রহের বিষয়বস্তুতে পরিণত করতে হবে। এ নির্বাচনটির নেতিবাচকতা তুলে ধরে বেশি বেশি করে এর ওপর গবেষণামূলক প্রবন্ধ এবং বই-পুস্তক লিখতে হবে যাতে করে এ নির্বাচনের একটি অনুপুঙ্খ একাডেমিক রেকর্ড ভবিষ্যৎ নির্বাচন গবেষকদের জন্য সংরক্ষিত থাকে। এমন কাজ করতে পারলে ভবিষ্যতের সুবিধাবাদী নির্বাচনী গবেষকরা আর এ নির্বাচনটিকে অন্য নেতিবাচক নির্বাচনগুলোর সঙ্গে এক কাতারে ফেলে আলোচনা ও মূল্যায়ন করতে পারবেন না। আর বর্তমানের লেখক-গবেষকরা যদি সুবিধাবাদে প্রভাবিত হয়ে এ বিষয়ে কলম না ধরেন, তাহলে ভবিষ্যতে আলোচ্য নির্বাচনের বিকৃত মূল্যায়নের জন্য এ শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী ও লেখক গবেষকদেরই দায়ী করা হবে।
একটি দেশের সুশীল সমাজ এবং জ্ঞানী-গুণী-বুদ্ধিজীবী যদি কিছু ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্য মিথ্যাকে মিথ্যা এবং সত্যকে সত্য বলা থেকে বিরত থাকেন, তাহলে সে দেশে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা পিছিয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার জনসমর্থন না থাকলেও কিছু কিছু বিরোধী নেতা, সুবিধাবাদী সুশীল সমাজ এবং একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী ক্রয় করে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকতে প্রয়াস পায়। তবে এ প্রক্রিয়ায় দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয় এবং সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধির মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়ন পিছিয়ে পড়ে। রাজনৈতিক নেতৃত্বে সরকার অগণতান্ত্রিক উপায়ে টিকে থাকতে চাইলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভাজন ও অনৈক্য বৃদ্ধি পায় এবং গণতান্ত্রিক বিশ্বের সঙ্গে দেশের বন্ধুত্ব ও পারস্পরিক সম্পর্কে ফাটল ধরার মধ্য দিয়ে দেশ পিছিয়ে পড়ে। কাজেই লেখক-বুদ্ধিজীবীদের উচিত অগণতান্ত্রিক ও অস্বচ্ছ নির্বাচনের প্রতি উচ্চকণ্ঠে সমালোচনামুখর হয়ে ওই রকম নির্বাচনের বিরুদ্ধে শক্ত হাতে কলম ধরা। আর এভাবেই সরকারকে অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানে এবং সঠিক গণতান্ত্রিক পথে দেশ পরিচালনার জন্য চাপে রাখা যাবে। লেখক-বুদ্ধিজীবীরা এমন সাহসী ভূমিকা পালন করলে ভবিষ্যৎ নির্বাচনগুলোর স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে এবং দেশ স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবে।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.