ঋণ অবলোপনের মোড়কে জালিয়াতি ঢাকার হিড়িক

ব্যাংকিং খাতে জালিয়াতির ঘটনা আড়াল করতে মন্দ ঋণ অবলোপনের হিড়িক পড়েছে। এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলো যেমন বাড়তি খেলাপি ঋণের দুর্নাম ঘুচাচ্ছে, তেমনি জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদেরও আড়াল করছে। একই সঙ্গে ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানগুলোর জালিয়াতির ঘটনাও পড়ে যাচ্ছে ধামাচাপা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়মিত বা খেলাপি হয়ে যাওয়া ঋণগুলোই সাধারণত তদন্ত করে। অবলোপন করা ঋণের ব্যাপারে তদন্ত করা হয় না। ফলে খুব সহজেই অবলোপনের কারণে জালিয়াতির ঘটনা আড়াল হয়ে যাচ্ছে। অনেকটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইঙ্গিতেই ব্যাংকগুলো মাত্রাতিরিক্ত হারে ঋণ অবলোপন করছে। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালায় ব্যাপক ছাড় দেয়া হয়েছে। সূত্র জানায়, গত কয়েক বছরে জালিয়াতির মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণের একটি বড় অংশই ব্যাংকগুলো ইতিমধ্যে অবলোপন করেছে। নিয়ম মেনেই অবলোপন করা হলেও এ কারণে ব্যাংকগুলোর ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। কেননা ব্যাংক এখন নিয়মিত ঋণই আদায় করতে পারে না। তার মধ্যে আবার অবলোপন করা ঋণ কিভাবে আদায় করবে- এমন প্রশ্নও উঠেছে। ব্যাংকগুলোর মাত্রাতিরিক্তি ঋণ অবলোপনের বিষয়টি এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদন্ত করে দেখছে। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী প্রথমে ৫ বছরের পুরনো ঋণ অবলোপনের নীতিমালা করা হয়। পরে তা শিথিল করে দুই বছরে নামিয়ে আনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকগুলো এখন খেলাপি ঋণের বোঝা কমাতে এক বছরের খেলাপি ঋণও অবলোপন করে ফেলছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন তদন্তে দেখা গেছে, সোনালী ব্যাংক ৪২২ কোটি, অগ্রণী ব্যাংক ১ হাজার ৩১৩ কোটি, জনতা ব্যাংক ২৪৭ কোটি, রূপালী ব্যাংক ১৩২ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংক ৬৭৭ কোটি এবং ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ৫৪ কোটি টাকার মন্দ ঋণ অবলোপন করেছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় জড়িত এইচ আর গ্রুপ, নূরজাহান গ্রুপ, ইমাম গ্রুপ, ঢাকার প্যারাগন গ্রুপ, পলমল গ্রুপসহ অবলোপন করা হয়েছে চামড়া ও হিমায়িত খাতের অনেক মন্দ ঋণ। এর মধ্যে জনতা ব্যাংক এইচআর গ্রুপের নামে দেয়া ঋণ এক বছরের মধ্যে অবলোপন করেছে। অগ্রণী ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক নূরজাহান গ্র“পের নামে দেয়া ঋণ অবলোপন করেছে এক থেকে দুই বছরের মধ্যে।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কম দেখাতে বর্তমানে যে হারে মন্দ ঋণ অবলোপন করা হচ্ছে, এটি উদ্বেগজনক। এভাবে ঋণ অবলোপন হতে থাকলে এক সময় আদায় কমে যাবে। তখন ব্যাংকগুলো খেলাপি কম দেখাতে সব খেলাপি ঋণই অবলোপন করে ফেলবে। তিনি আরও বলেন, প্রলেপ দিয়ে ক্ষত ঢাকার চেয়ে ক্ষত সারানোর ব্যবস্থা করা উচিত। ব্যাংকগুলোকে দেখতে হবে ঋণ যাতে খেলাপি না হয়। বিধিবহির্ভূত বা ঝুঁকি বিবেচনা না করে ঋণ দিলেই তা খেলাপি হচ্ছে। ওই ঋণ একটি পর্যায়ে অবলোপন করা হচ্ছে। অবলোপনের কারণে ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে যায়। এর দায় পড়ে ভালো উদ্যোক্তা ও শেয়ারহোল্ডারদের ওপর। এজন্য গণহারে ঋণ অবলোপনের সুযোগ না দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত এগুলো আদায়ের ওপর চাপ দেয়া।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঋণ জালিয়াতি ও জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তাদের আড়াল করতে ব্যাংকগুলো সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাপক হারে ঋণ অবলোপন করছে। এমনকি এক বছর আগে দেয়া ঋণও অবলোপন করার নজির রয়েছে।
সরকারি খাতে অগ্রণী ব্যাংক গত বছর ৯ হাজার ৯০৫টি হিসাবের বিপরীতে ১ হাজার ৩১৩ কোটি টাকার মন্দ ঋণ অবলোপন করেছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের পাঁচটি শাখায় অবলোপন করা হয়েছে ১ হাজার ২২৩ কোটি টাকা, যা গত বছর মোট অবলোপন করা ঋণের ৯৩ শতাংশ।
চট্টগ্রামের লালদীঘি কর্পোরেট শাখার নূরজাহান সুপার অয়েলের ৬৫ কোটি, খালেক অ্যান্ড সন্সের ২০৬ কোটি, মুহিব স্টিল অ্যান্ড সাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজের ৯২ কোটি, চিটাগাং ইস্পাতের ৭৪ কোটি, ইমাম মোর্টসের দেড় কোটি, রুবাইয়াত ভেজিটেবল অয়েলের ৭৪ কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। এসব ঋণ বিতরণে বড় ধরনের অনিয়ম পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
আগ্রাবাদ শাখা থেকে মাররীন ভেজিটেবল অয়েলের ৩০৬ কোটি, এমএম ভেজিটেবল অয়েলের ৫০ কোটি, শিরিন এন্টারপ্রাইজের ৫২ লাখ টাকা, আসাদগঞ্জ শাখা থেকে জাসমীর ভেজিটেবলের ৮৬ কোটি, মিজান ট্রেডার্সের ৫৯ কোটি টাকা, নিউমার্কেট শাখা থেকে তাসমিন ফ্লাওয়ারের ২৮ কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। নূরজাহান গ্রুপের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের ৬৯১ কোটি টাকা অবলোপন করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে অগ্রণী ব্যাংকের এমডি সৈয়দ আবদুল হামিদ যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম মেনেই ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। অবলোপন করা ঋণের বিপরীতে শতভাগ প্রভিশন রাখা আছে। এছাড়া এসব ঋণ আদায়ে ব্যাংকে আলাদা একটি সেল খোলা হয়েছে। কিছু ঋণ আদায়ও হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্যে দেখা যায়, জনতা ব্যাংকের সাধারণ বীমা ভবন শাখায় এইচআর গ্রুপের ঋণের স্থিতি ৭৫ কোটি টাকা। জামানত ছাড়াই ঋণ দেয়া হয়েছে। প্রথমে গ্র“পকে বৈদেশিক এলসি খুলে পণ্য আমদানির জন্য ঋণ দেয়। পণ্য বিক্রি করে দেনা শোধ না করায় ব্যাংক ফোর্সলোন সৃষ্টি করে বিদেশী ব্যাংকের দায় শোধ করে। ওই টাকা শোধ না করায় তা খেলাপিতে পরিণত হয়। যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য আমদানি করা হয়েছে ওইসব প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই। খেলাপি ঋণের দুর্নাম ঘুচাতে ঋণটি খেলাপি হওয়ার এক বছরের মধ্যেই অবলোপন করা হয়েছে। এ অঞ্চলের আরও অনেক ঋণ অবলোপন করা হয়েছে।
ন্যাশনাল ব্যাংকে ১৮টি হিসাবের বিপরীতে ৬৭৭ কোটি টাকা অবলোপন করা হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ ও আগ্রাবাদ শাখায় ৬টি প্রতিষ্ঠানের ৬৬৩ কোটি টাকা এবং অন্যান্য শাখায় ১৪ কোটি টাকার ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। এসব ঋণ বিতরণে বড় ধরনের জালিয়াতি করা হয়েছিল। ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) থেকে বেনামে পরিচালকদের দেয়া ঋণের মধ্যে ১৭৫ কোটি টাকা অবলোপন করা হয়েছে।
সোনালী ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির একটি বড় অংশই অবলোপন করেছে। ব্যাংকের আগ্রাবাদ শাখায় ৮টি প্রতিষ্ঠানের ৩৪৮ কোটি টাকা, স্থানীয় কার্যালয়ের ২২ কোটি, অন্যান্য শাখার আরও ৫২ কোটি টাকার মন্দ ঋণ অবলোপন করা হয়েছে। এই ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে বড় ধরনের জালিয়াতি করা হয়েছিল। এর মধ্যে এইচআর গ্র“পের জাসমির ভেজিটেবল অয়েলের ১০০ কোটি, ইমাম গ্র“পের ইমাম ট্রেডার্সের ৮২ কোটি, মহিউদ্দিন কর্পোরেশনের ৪০ কোটি, একে এন্টারপ্রাইজের ৪৩ কোটি, কামাল এন্টারপ্রাইজের ৩২ কোটি টাকা অবলোপন করা হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.