ময়নাতদন্ত রিপোর্টে আত্মহত্যা, প্রত্যাখ্যান পরিবারের

ডা. শামারুখ মাহজাবীনের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পুলিশের কাছে দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে- শামারুখ আত্মহত্যা করেছেন। তবে শামারুখের বাবা, স্বজন ও সহপাঠীরা এ রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারা পুনরায় ময়নাতদন্তের জন্য আবেদন জানাবেন। তারা বলছেন, ময়নাতদন্তের পর থেকেই রিপোর্ট পাল্টে দেয়ার আশংকা তৈরি হয় তাদের। অবশেষে হয়েছেও তাই। যশোরের আওয়ামী লীগ দলীয় সাবেক সংসদ সদস্য খান টিপু সুলতান ও তার স্ত্রী হলি ফ্যামিলি রেডক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ডা. জেসমিন আরা প্রভাব খাটিয়ে নিজেদের মতো করে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট বানিয়ে নিয়েছেন। এতে মোটা অংকের টাকাও লেনদেন হয়েছে বলে অভিযোগ স্বজনদের।
শামারুখের বাবা প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম বলেন, এই মিথ্যা রিপোর্ট আমি বিশ্বাস করি না। প্রত্যাখ্যান করি। পুনরায় ময়নাতদন্তের জন্য আবেদন করব। আমি তো সাংবাদিকদের কাছে আগেই বলেছি, খান টিপু সুলতান প্রভাবশালী। তার স্ত্রী ডা. জেসমিন আরাও ক্ষমতাধর। তারা ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাল্টে ফেলবে। এমন কোনো কাজ নেই তাদের পক্ষে সম্ভব না। ক্ষমতা, টাকা সবই আছে তাদের। আমার মেয়েকে তারা গলা টিপে হত্যা করেছে। আমি সঠিক রিপোর্ট ও তাদের বিচার চাই।
ধানমণ্ডি থানার ওসি আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ময়নাতদন্ত রিপোর্টে শামারুখ ‘আত্মহত্যা’ করেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আত্মহত্যা করলেও মামলার তদন্ত শেষ হবে না। আত্মহত্যা করার নেপথ্যে অবশ্যই কোনো বড় কারণ আছে। কেউ এমনি এমনি আত্মহত্যা করে না। এই কারণ খুঁজতে তদন্ত করা হবে। কেউ তাকে আত্মহত্যার প্ররোচনা করে থাকলে তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হবে। সেক্ষেত্রে হত্যা মামলাটিতে ৩০২ ধারার পরিবর্তে ৩০৬ ধারায় চার্জশিট দেয়া হবে। গত ১৪ নভেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে ডা. শামারুখের লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়। এর ১০ দিনের মাথায় রোববার বিকাল সাড়ে ৩টায় ধানমণ্ডি থানা পুলিশের কাছে ফরেনসিক বিভাগ থেকে ওই রিপোর্ট দেয়া হয়। সেখান থেকে রিপোর্ট গ্রহণ করেন ধানমণ্ডি থানার স্পেশাল ম্যাসেঞ্জার কনস্টেবল হুমায়ুন। হুমায়ুন ওই রিপোর্ট ধানমণ্ডি থানার ওসি’র কাছে পৌঁছে দেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ বলেন, ডা. শামারুখ আত্মহত্যা করে মারা গেছেন। গলায় যে দাগ ছিল, সেটি আত্মহত্যার দাগ। গলা থেকে টিস্যু সংগ্রহ করে হিস্টোপ্যাথলজিতে পরীক্ষা করে এমন রিপোর্ট এসেছে। এছাড়া পরীক্ষার সব পয়েন্টেই আত্মহত্যার রিপোর্ট এসেছে। বাম হাতের তিনটি দাগের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রথমে হাতের কব্জি কেটে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। পরে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন।
এই রিপোর্ট মানেন না শামারুখের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলিফ্যামিলি রেডক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের সাবেক শিক্ষার্থীরা। তারা বলছেন, শামারুখের গলায় আঙুলের ছাপ ছিল। আত্মহত্যা হলে আঙুলের ছাপ কিভাবে আসবে। শামারুখের ময়নাতদন্তর পর থেকেই তারা আশংকা করছিল, রাজনৈতিক প্রভাব ও টাকা দিয়ে ময়নাতদন্ত রিপোর্টে আত্মহত্যার প্রমাণ করার চেষ্টা করবে খান টিপু সুলতান। এ কারণে ময়নাতদন্তের সঠিক রিপোর্ট ও মামলার সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে মেডিকেল কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও শামারুখের স্বজনরা মানববন্ধনের মাধ্যমে আন্দোলন করে আসছিল। মেডিকেল কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী ডা. বাসিরুল হক বলেন, শামারুখ আত্মহত্যা করার মেয়ে নয়। তার গলায় যে দাগ ছিল তাতে হত্যার স্পষ্টতা ফুটে ওঠে। আমরা শুরু থেকেই আশংকা করছিলাম ক্ষমতার বলে রিপোর্ট পাল্টে নেবে। অবশেষে তাই হল। আমরা এই রিপোর্ট বিশ্বাস করি না। প্রয়োজনে আমরা আবার আন্দোলনে নামব।
শামারুখের মামা কাজী ফিরোজুর রহমান বলেন, যদি শামারুখ আত্মহত্যা করে মারা যায়, তাহলে তার লাশ কেন সেন্ট্রাল হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল। শামারুখের শাশুড়ি একজন ডাক্তার। সে তো বাসায় দেখেছে শামারুখ মারা গেছে। তাহলে থানায় খবর না দিয়ে মৃত মানুষকে হাসপাতালে নেয়ার রহস্য কি। আত্মহত্যা করলে লাশ বাসায়ই রাখত। হাসপাতালে নেয়ার পর থানায় জানিয়েছে তারা। এটা সাজান নাটক। শামারুখকে হত্যা করে ক্ষমতার জোরে আত্মহত্যার রিপোর্ট করিয়েছে।
১৩ নভেম্বর দুপুরে শ্বশুরের ধানমণ্ডির বাসা থেকে অচেতন অবস্থায় ডা. শামারুখকে সেন্ট্রাল হাসপাতালে নিয়ে যায় শাশুড়ি ডা. জেসমিন ও স্বামী হুমায়ুন। কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এরপরেই স্ত্রী আত্মহত্যা করেছে বলে খবর দিতে ধানমণ্ডি থানায় যায় স্বামী হুমায়ুন। নিহতের বাবা নুরুল ইসলাম ওইদিনই শামারুখের শ্বশুর যশোর-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য খান টিপু সুলতান, শাশুড়ি ডা. জেসমিন আরা ও স্বামী হুমায়ুন সুলতানের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন। পুলিশ গ্রেফতার করে হুমায়ুনকে। হুমায়ুনকে তিন দিনের রিমান্ড নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। হুমায়ুন জেলহাজতে রয়েছে। টিপু সুলতান ও ডা. জেসমিন উচ্চ আদালত থেকে আগাম জামিন নিয়েছেন। ডা. শামারুখ ২০১৩ সালে হলি ফ্যামিলি মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। ইন্টার্নিও করেন সেখান থেকে।

No comments

Powered by Blogger.