জ্ঞানী যেখানে পা রাখতে ভয় পায় অর্বাচীন সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ে by মাহবুব কামাল

প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন- ৫ জানুয়ারির নির্বাচন যারা মেনে নেয় না, তারা অর্বাচীন। তার কথার প্রত্যুত্তরে বিএনপির মির্জা ফখরুল বলেছেন- অর্বাচীন শব্দের অর্থ কী আমি জানি না, তবে প্রধানমন্ত্রীর কথা যদি সত্য ধরি, তাহলে পৃথিবীর সবাই কি অর্বাচীন?
ফখরুল সাহেবকে অর্বাচীন শব্দের অর্থটাই বোঝানো যাক আগে। অভিধানে এই শব্দের অর্থ দেয়া আছে- অপরিপক্ববুদ্ধি। বাংলা ভাষায় যাদের দক্ষতা কম, তারা ভাবতে পারেন, উদ্দিষ্ট ব্যক্তিটি কোথায়? অর্থটা তো হওয়া উচিত- অপরিপক্ব বুদ্ধি যার। না, অপরিপক্ব ও বুদ্ধি শব্দ দুটিকে সংযুক্ত করায় ব্যক্তিটিকে নির্দেশ করার প্রয়োজন হয় না। হতবুদ্ধি মানে যেমন কিংকর্তব্যবিমূঢ় অর্থাৎ কী করতে হবে বুঝে উঠতে পারেন না যিনি, তেমনি অপরিপক্ববুদ্ধি মানে যার বুদ্ধি অপরিপক্ব অর্থাৎ অর্বাচীন (এই অযাচিত জ্ঞানদানের জন্য দুঃখিত)। তো মানুষই যে কেবল অর্বাচীন হয় তা নয়, জীবজন্তুও হতে পারে। ছাগল যেমন। আবার মানুষের মধ্যে যারা সাধ্যের অতীত কিছু করতে চায়, তারাও অর্বাচীন। পাকিস্তান আমলে আমার এলাকার পার্শ্ববর্তী আরামবাগের এক যুবক উর্দু সালতানাত ছবিটি দেখার পর নায়িকা নিলোকে বিয়ে করার জন্য উন্মাদ হয়ে গিয়েছিল। সে পশ্চিম পাকিস্তানে ছুটে যেতে পারে ভয়ে তার অভিভাবকরা শেষ পর্যন্ত তাকে শেকলে বেঁধে রেখেছিল। অর্বাচীন আর কাকে বলে! সম্ভাবনা নষ্ট করেন যিনি, তিনিও এক ধরনের অর্বাচীন। কখনও আবার জন্মসূত্রে প্রখর বুদ্ধি থাকলেও অভিজ্ঞতার অভাবে অথবা কোনো বিষয়ে মোহগ্রস্ত হলে অর্বাচীন হয়ে পড়েন অনেকে। আমি একবার ফার্মাসিতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট এক ধীমানকে নিষেধ করেছিলাম তার পছন্দের মেয়েটিকে বিয়ে করতে। শোনেনি। মেয়েটির প্রতি এতটাই মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল সে যে, আমার চামড়ায় পৃথিবীর আলো-বাতাস তার চেয়ে যে বেশি লেগেছে, তা চিন্তা করারও ফুরসত পায়নি। যা হওয়ার তা-ই হয়েছে, আট মাসের মাথায় সেপারেশন। রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের বাইরের অর্বাচীন নিয়ে আরেকটু বলি। কখনও কখনও পরস্পর বিতর্কে লিপ্ত দুই অর্বাচীন বুদ্ধিমান সাজার চেষ্টা করেন। আস্তিক-নাস্তিকের ঝগড়া-বিবাদ শুনলেই তা বোঝা যায়। বিষয়টা বিশ্বাসের অথচ যুক্তি দেখানোর চেষ্টা চলে। এ প্রসঙ্গে বলতেই হয়, জ্ঞানী যেখানে পা রাখতে ভয় পায়, অর্বাচীন সেখানে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অর্বাচীন রাজনীতিক এই পদদ্বৈতটি ব্যবহার করি না আমি। এখানে কোনো রাজনীতিককে অর্বাচীন বললে মনে হতে পারে, রাজনীতিক ও অর্বাচীনতা বুঝি দুটি আলাদা বিষয়। অথবা রাজনীতিকের সর্বাচীনতা বলতেও আছে কিছু। সম্ভাবনা নষ্টকারীকে অর্বাচীন বলা চলে বলে এ দেশের ক্ষমতায় চড়েছেন এমন সব রাজনীতিকই কমবেশি অর্বাচীন (ক্ষমতায় বসেননি যিনি বা যারা, তারা বেঁচে গেলেন! যার রান্না খাইনি, সে বড় রাঁধুনি)। এমনকি বঙ্গবন্ধুও মুক্তিযুদ্ধের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসা এক বড় ইতিবাচক শক্তির সম্ভাবনা নষ্ট করেছেন। রাজনীতিক সম্প্রদায়ের কারও কারও সদিচ্ছা থাকলেও বুদ্ধিটা কম বলে অর্বাচীন অভিধা থেকে তাদের রেহাই নেই। গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সৎ উদ্দেশ্য থাকার পরও বামপন্থী দলগুলো অর্বাচীনের মতো আচরণ করেছিল। অবশ্য বর্তমানে ৫-৬টি বড় রাজনৈতিক দলের অতিরিক্ত যে শখানেক নিউক্লিয়াস ধরনের ক্ষুদ্রাকৃতির দল আছে, সেগুলোর নেতৃত্বকে অর্বাচীন বলা যাবে না। তারা আসলে বুদ্ধিমানের বুদ্ধিমান। একটা লেটার হেড ও একটা রাবার স্ট্যাম্প দিয়ে যোগ্যতার অধিক কিছু অর্জন করে চলেছেন তারা। দেশের সম্ভাবনা বিনষ্টকারী রাজনীতিকদের যে অর্বাচীন বলছি, সেখানেও একটু ফাঁক আছে। ভোগ-বিলাস চরিতার্থ করতে পারছেন বলে এক দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের অর্বাচীন বলা যাবে না, যদিও চূড়ান্ত অর্থে তারা অর্বাচীনই। একজন মানুষের জীবনে জনপ্রিয়তাই শেষ আকাক্সক্ষা হওয়া উচিত। ভোগ-বিলাসে রসনা-বাসনা তৃপ্ত হয়, জনপ্রিয় হওয়া যায় না। দেশ ও মানবজাতির কল্যাণ করলে সমষ্টির কল্যাণটাই হয় না শুধু, নিজেও জনপ্রিয় হওয়া যায়। একইসঙ্গে এই দুই লাভ চায় না যে, সে অর্বাচীন নয় তো কী? ছাতির চেয়ে বুক-পকেট বড় হয়ে যাচ্ছে। প্রসঙ্গে ফিরে আসি।
দুই.
কোনো বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হতে হলে কী দরকার হয়? সংবিধান নিয়ে অনানুষ্ঠানিক যত লেখাপড়াই করুন না কেউ, হাইকোর্ট-সুপ্রিমকোর্টে প্র্যাকটিস না করলে তাকে সংবিধান-বিশেষজ্ঞ ধরা হয় না। যাকগে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সাংবিধানিকভাবে বৈধ কী অবৈধ, সেটা সংবিধান-বিশেষজ্ঞরাই করুন, নির্বাচন যে গ্রহণযোগ্য হয়নি, তা আমরা চর্মচক্ষুতেই দেখেছি, এজন্য বিদেশী পর্যবেক্ষকের সনদের দরকার নেই। আমরা একটা ফ্রেশ নির্বাচনও চাই, তবে সেই চাওয়া একজন অর্বাচীনের নয়, বুদ্ধিমানের। ফ্রেশ নির্বাচনের দাবিটা ন্যায়সঙ্গতও; কিন্তু বিএনপি নেতৃত্ব কি কখনও ভেবে দেখেছেন, এই দাবির পক্ষে তাদের ডাকে রাস্তায় নামছে না কেন লোক? তারা হয়তো বলবেন, পুলিশ ঠ্যাঙ্গালে নামবে কীভাবে? এটা মুখ রক্ষার যুক্তি। দাবিটা প্রাণের হলে সেই প্রাণই বলবে- তুমি রাস্তায় নামো, ঝরলে আমিই ঝরবো। শুনুন তাহলে। দেশের অধিকাংশ মানুষই মনে করেন, ফ্রেশ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে আপনারাই জিতবেন। কিন্তু? সাধারণ মানুষের এই কিন্তুটা একটু সাজিয়ে বলি। ২০০১
সালের বিজয়ের পর আপনারা যে ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন, এবার জিতলে সেই ব্যাধি মহামারীর
আকার ধারণ করবে। ব্যাধিই মহামারী হয়, স্বাস্থ্য নয়, অর্থাৎ আপনাদের দু-একজনের স্বাস্থ্য ছড়াবে না, ব্যাধিটা ছড়াবে। কেউ কেউ এমনও মনে করেন, অবস্থাটা এবার গৃহযুদ্ধের পর্যায়ে চলে যাবে। কারণ, ক্ষমতাসীন হিসেবে রাষ্ট্রযন্ত্রের সুবিধা ভোগ করবেন বলে শক্তির ভারসাম্যে আপনারা এগিয়ে থাকবেন ঠিকই, আওয়ামী লীগও গ্রাসরুটের দল হিসেবে কম যাবে না। এই গৃহযুদ্ধ অথবা গৃহযুদ্ধাবস্থার ক্যাজুয়ালটি কে হতে চায় বলুন। মির্জা ফখরুলকে প্রশ্ন করি, বিদেশীদের যারা ৫ জানুয়ারির নির্বাচন মানতে পারেননি, তারা অর্বাচীন নয় বুঝলাম; কিন্তু কে সেই অর্বাচীন হিন্দু, যে আবারও তার বোন অথবা স্ত্রী ধর্ষিত হবে এই আশংকা মাথায় নিয়ে পুলিশের বেষ্টনী ভেদ করে হাজির হবেন নয়াপল্টনে? হিন্দু কেন, মুসলমানের কথাই বলি। তিনি মুসলমান এবং যুদ্ধাপরাধের মামলার সাক্ষী- কেন নামবেন রাস্তায়? অথবা নিজে রাজনীতি করেন না; কিন্তু শ্বশুর আওয়ামী লীগ নেতা, প্রিয় শ্যালক ছাত্রলীগের নেতা, তিনি? কিংবা আওয়ামী সরকারের ব্যর্থতায় বিমুখ হয়ে বিএনপিকে ভোট দিলেও প্রতি ১৫ আগস্টে ৩২ নম্বরে যান বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানাতে,
তিনিই বা কেন শরিক হবেন ওই বাড়িটি ভাঙার আন্দোলনে? হ্যাঁ, তিনি মনে করছেন, শেখ হাসিনা যেহেতু খালেদা
জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের বাড়িটি ভেঙে ফেলেছেন, তাই ক্ষমতায় এলে আপনারা ৩২ নম্বরের বাড়িটি ভেঙে ফেলতে পারেন। সমাজে রাজনীতির যত ধরনের স্টেকহোল্ডার আছে, সেগুলোর খোঁজ রাখতে হবে মির্জা ফখরুলদের এবং হিসাব মেলানোর জন্য কী করা দরকার, এ নিবন্ধের শেষে তা খুঁজে পাওয়া যাবে।
ঘটনাচক্রে আমার বন্ধুদের মধ্যে বিএনপিমনার সংখ্যাই বেশি। জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে বলে তারা মহাচিন্তিত। পারলে আগামীকালই নির্বাচন করতে হবে (আসলে খালেদা জিয়াকে ক্ষমতায় বসাতে হবে)। দেশে গণতন্ত্র নেই, এ কী যা তা কথা! এদের যদি বলি, গণতন্ত্র যে নেই সেটা তো আমিও দেখতে পাচ্ছি, চলুন গণতন্ত্র যাতে চিরস্থায়ী হতে পারে সেজন্য ত্রুটিপূর্ণ সিস্টেমগুলো নিয়ে আন্দোলন করি- প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমাই, যে ক্ষমতাবলে তিনি একক সিদ্ধান্তে যা খুশি তাই করতে পারছেন- তারা রাজি হন না। তাদের সাফ কথা- নির্বাচনটা আগে হতে হবে। বোঝাই যায়, তারা সিস্টেমগুলো নিয়ে যে বিচলিত নন, তার কারণ এগুলো অবিকল না থাকলে ক্ষমতায় গিয়ে আওয়ামী লীগকে ঠ্যাঙ্গানো যাবে না। এই বন্ধুরা মুখে যাই বলুন, তারা সম্ভবত খুশি এই ভেবে যে, শেখ হাসিনা বিচারপতিদের অভিশংসনের একটা ব্যবস্থা করে রেখেছেন। মিউজিক্যাল চেয়ার খেলায় ক্ষমতার সঙ্গে আইনের বালিশটাও তো একসময় না একসময় আমাদের হাতে এসে ঠেকবেই। তখন সংক্ষুব্ধদের রিট নাকচ করবেন না যে বিচারপতি, তার দেখভাল পার্লামেন্টই করবে। আর পুলিশ? রেশনের একটা ইউনিট বাড়িয়ে অথবা একটা ইনক্রিমেন্টের মাধ্যমে তাদের দিয়ে কী না করানো যায়। প্রসঙ্গত বলি, বর্তমান সরকার নতুন পে-স্কেল দিলে এই পুলিশ হয়তো আর ডিএমপি কমিশনারের ব্রিফ শোনার অপেক্ষায় থাকবে না, নিজেরাই ব্রিফ তৈরি করে উষ্টা (আছাড়) খেতে খেতে দৌড়াবে বিএনপির জনসভার দিকে।
আমরা এ দেশেই বেড়ে উঠেছি, এদেশেই বাস করি। আমাদের কেউ উল্টাপাল্টা বোঝাতে পারবেন না, হাসিনা-খালেদাও না। আমরা কী দেখছি? অশিক্ষিত তিনটি শ্রেণী- গ্রামীণ কৃষক, শহুরে বস্ত্র-বালিকা আর দেশের বাইরের ওয়েজ আর্নার- এরা প্রতিনিয়তই সম্ভাবনা তৈরি করছেন আর শিক্ষিত রাজনীতিক শ্রেণী কাঁচি হাতে সম্ভাবনার চুল ছেঁটে চলেছেন, বাকি শুধু ক্ষুর হাতে নেয়ার। সম্ভাবনার মাথা ন্যাড়া করবেনই- এই তাদের ব্রত। এখন আমরা আর বিশ্বাস করি না, নতুন নির্বাচন হলেই নতুন জীবন শুরু হয়, নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়। পৃথিবীর কোন্ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কোন্ বইতে লিখেছেন, প্রতিশোধ ছাড়া গণতন্ত্র হয় না? মির্জা ফখরুলকে তাই বলি, প্রধানমন্ত্রীর কথার জবাব না দিয়ে নিজেদের অর্বাচীন অপবাদ থেকে মুক্ত রাখুন। দুই নম্বর কথা, অন্তত তিনটি বিষয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হোন এবং নির্বাচনে জয়লাভ করলে তা যে রক্ষা করবেন, জাতির সামনে বিশ্বাসযোগ্যভাবে তা উপস্থাপন করুন।
এক. বঙ্গবন্ধুর ছবি অফিস-আদালত থেকে নামাবেন না। তার সমালোচনা যদি করতেই হয়, ভারতীয়রা যেভাবে গান্ধীর সমালোচনা করে থাকেন, সেভাবে সম্মানের সঙ্গেই করবেন। দুই. যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া অব্যাহত রাখবেন। তিন. প্রতিশোধের নেশায় মত্ত হবেন না। ক্ষমতাসীনরা যদি বুঝতে পারেন, বিরোধী দলে গেলে তারা মর্যাদার আসনেই থাকবেন, তাহলে স্বচ্ছ নির্বাচন ও শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয় দুটো সহজ হয়ে যায়। উন্নত দেশ কেন, পার্শ্ববর্তী ভারতের দিকে তাকালেই বুঝবেন এটা। প্রধানমন্ত্রীকে জানান এ প্রতিজ্ঞার কথা, তাহলে তনি রিথিংক করার সুযোগ পাবেন। তিনি তো মধ্যবর্তী নির্বাচন নিয়ে ভাবছেনই না। না ভাবলে ভাবান্তর হবে কীভাবে? তাকে ভাবার সুযোগ দিন আর তার যদি ভাবান্তর না হয়; কথা দিলাম, আমরা মাঠে নামবো।
পুনশ্চঃ-১. অর্বাচীন নিয়ে অনেক কথাই হয়েছে, আরেকটু বলি প্লিজ! কখনও কখনও অতি বুদ্ধিমান অপেক্ষাকৃত কম বুদ্ধির কাউকে অর্বাচীন বানিয়ে ফেলতে পারেন। একটা উদাহরণ দিই। জুলোজিস্টের চোখ দিয়ে মোরগ পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে, এটি শুধু নির্বিচার যৌনাচারীই নয়, চালাক-চতুর প্রাণীও বটে। সে কী করবে, সবখানেই তো মানুষের পদচারণা, জবাই হওয়ার আশংকা মাথায় নিয়েই সন্ধ্যার পর খোপে ফেরে তাই।
তো গৃহকর্ত্রী দেখছেন, দিনের বেলায় হঠাৎ করে মেহমান এলে মোরগ আর ধরা যায় না। তিনি তাই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলেন, হাতের তালুতে ধান রেখে কাছে টানার প্রশিক্ষণ। এই প্রশিক্ষণ পেয়ে মোরগের মাথা কন্ডিশন্ড হয়ে পড়লো। যেদিন সে টেবিল-চিকেন হবে, সেদিনও অর্বাচীনের মতো ধরা দিল গৃহকর্ত্রীর হাতে।
জুলোজিস্ট মোরগকে অর্বাচীন প্রমাণ করলেন, তিনি নিজে কীভাবে অর্বাচীনে পরিণত হচ্ছেন, দেখুন। এক জুলোজিস্ট ফড়িং নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি ফড়িংয়ের একটি পাখা ছিঁড়ে ওড়ো দেখি বলে সেটিকে ছেড়ে দিলেন। ফড়িং কোনো রকমে উড়লো। এবার তিনি দুটি পাখাই ছিঁড়ে বললেন, এবার ওড়ো দেখি। ফড়িংটি ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেল। জুলোজিস্ট সিদ্ধান্ত টানলেন- ফড়িংয়ের দুটি পাখাই ছিঁড়ে ফেললে সে কানে শোনে না।
পুনশ্চঃ-২. এই লেখায় ছাগলের উদাহরণ টেনেছি। লাইনটি লেখার সময় একটি বিশেষ ছাগলের কথা মনে পড়েছিল। অরিজিনাল ছাগলটি দেখার ভাগ্য হয়নি, লন্ডনে রেপ্লিকা (প্রতিমূর্তি) দেখেছিলাম। কাঠ খোদাই করে পিকাসো নির্মাণ করেছেন একটি ছাগলের তাৎপর্যপূর্ণ ভাস্কর্য। ছাগলটি কুৎসিত। গর্ভবতী বলে তার পেট বেঢপ, লোমগুলো ময়লাযুক্ত, খসখসে; মাথার দিকটা উটের গ্রীবার মতো শরীরের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। তবে মানুষের স্বার্থ যেখানে, সেই দুধের বাঁট সুন্দর, চকচকে। ছাগলটির বয়স যা, তাতে এতোদিনে মাটন চপ হয়ে ডাইনিং টেবিলে থাকার কথা, তার পূর্বসূরিরা গত হয়েছে যেভাবে। এ ছাগলটি বেঁচে আছে তার প্রজনন ক্ষমতার জোরে। পেটে বাচ্চা, স্বার্থটা এখানে দুধের চেয়ে বেশি।
বাংলাদেশটাকেও পিকাসোর এই ছাগলটির সঙ্গে তুলনা করা যায়। পুরো দেশটিকে কদর্য করে রেখেছি আমরা, শুধু স্বার্থ যেখানে, সেই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সচিবালয়, বিদেশী ডোনারদের প্রবেশদ্বার এয়ারপোর্ট ও তাদের থাকার হোটেল, বড় বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির অফিস, অভিজাততন্ত্রের আবাসভূমি ইত্যাদি ঝকঝকে-তকতকে করেই রাখিনি শুধু, সেগুলোর সুরক্ষাও দিয়েছি। রাষ্ট্রটিকে হয়তো এতোদিনে ধ্বংসই করে ফেলতাম। হ্যাঁ, এই রাষ্ট্রও বেঁচে আছে প্রজনন ক্ষমতার জোরেই। কৃষক ছাগলের বাচ্চা বিয়ানোর মতো প্রতি বছর ফসল ফলায়, শ্রমিক প্রতিদিন উৎপাদন করে, প্রবাসীরা প্রতিদিন টাকা পাঠায়- রাষ্ট্রের এই প্রজনন ক্ষমতা আছে বলেই তো লুট করে সুখে আছি।
মাহবুব কামাল : সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.