বরিশালে ছাত্রলীগ নেতাদের অনেকেই হঠাৎ বড় লোক

কি পরিমাণ অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছেন বরিশালের ছাত্রলীগ নেতারা? এই প্রশ্ন এখন সাধারণ মানুষের। তাদের কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আর বিপুল বিত্তবৈভব দেখেই এমন প্রশ্ন। আর তার পেছনে যথেষ্ট কারণও রয়েছে। পদ-পদবির লড়াই আর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে মুখোমুখি নেতাদের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডই জন্ম দিয়েছে এসব প্রশ্ন। পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলনসহ নানাভাবে তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে আনছেন টেন্ডার এবং চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মের অভিযোগ। এর মাধ্যমে এসব নেতা বনে গেছেন কোটি কোটি টাকার মালিক। এই বড়লোক নেতাদের বিরুদ্ধে তদন্ত হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা।
সাবেক মেয়র মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি শওকত হোসেন হিরনের মৃত্যুর পরেই মূলত ছন্দপতন ঘটে এখানকার ছাত্রলীগের রাজনীতিতে। জেলার নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি সংসদ সদস্য হাসানাত আবদুল্লাহর হাতে চলে গেলেও মহানগর ছাত্রলীগ নিয়ে সৃষ্টি হয় জটিলতা। নগর সভাপতি জসিমউদ্দিনের বিরুদ্ধে উঠে পক্ষত্যাগ করে হাসানাত আবদুল্লাহর দিকে চলে যাওয়ার অভিযোগ। যদিও এই অভিযোগ তিনি কখনোই স্বীকার করেননি। বরং তাকে নিয়মিত দেখা যায় বর্তমান সংসদ সদস্য হিরনপত্নী জেবুন্নেসা আফরোজ ও শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুর পাশে।
বিরোধী পক্ষের মতে, এসব আসলে লোক দেখানো। মহানগর সম্পাদক অসীম দেওয়ানের মতো তিনিও এখন হাসানাতের পক্ষে। প্রকাশ্যে এমপি জেবুন্নেসার সঙ্গে থেকে দুদিক থেকেই চলছে তার সুবিধা নেয়ার চেষ্টা। কথিত এই পক্ষত্যাগ নিয়ে হিরনপন্থী ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে জসিমের চলছে মারাত্মক দ্বন্দ্ব। কয়েক দফা সংঘর্ষও হয়ে গেছে। এরই মধ্যে সপ্তাহখানেক আগে হঠাৎ করে নগরীর দুটি সরকারি কলেজের কমিটি ভেঙে দেয় মহানগর ছাত্রলীগ। এ নিয়ে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে চলে আসে। অভিযোগ উঠে টেন্ডার এবং চাঁদাবাজির। মাত্র কবছরে কিছু শীর্ষ নেতা কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়ার কাহিনী ফাঁস হয়ে যেতে থাকে।
কমিটি ভাঙার পরপরই গত সপ্তাহে মহানগর ছাত্রলীগের বর্তমান নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন করেন সরকারি সৈয়দ হাতেম আলী কলেজ এবং সরকারি বরিশাল কলেজের নেতারা। টানা ৩ বছর ধরে দুই নেতার কমিটি এবং মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার পরও মহানগর কমিটি বহাল রাখার প্রতিবাদ জানায় তারা। সংবাদ সম্মেলনে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয় জসিম উদ্দিন এবং অসীম দেওয়ানকে।
বিলুপ্ত ঘোষিত সরকারি হাতেম আলী কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউল ইসলাম বাপ্পি এবং সরকারি বরিশাল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক চঞ্চল দাস পাপ্পা অভিযোগ করেন, কোনো কমিটি ভাঙার নৈতিক অধিকার তাদের নেই। কেননা মহানগর কমিটিই বর্তমানে মেয়াদোত্তীর্ণ। গত ৩ বছরে তারা তাদের নিজেদের পূর্ণাঙ্গ কমিটি পর্যন্ত করতে পারেনি। মহানগর সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে রয়েছে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ। টেন্ডার ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে কমপক্ষে ৫০ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন এ দুজন।
কত টাকার মালিক হলে বরিশাল নগরীর ব্যস্ততম এলাকায় ১৫ কোটি টাকা মূল্যের জমি কেনার জন্য বায়না চুক্তি করা যায় প্রশ্ন করে পাপ্পা বলেন, এরা ছাত্রলীগকে ধ্বংস করছে। এদের নেতৃত্ব আমরা মানি না। এই সংবাদ সম্মেলনের একদিন পর পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করে জসিম-অসীম সর্মথক ওই দুই কলেজের ছাত্রলীগের অপর পক্ষ। সেখানে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়ার অভিযোগ আনা হয় প্রতিপক্ষের নেতাদের বিরুদ্ধে। ওই সংবাদ সম্মেলন শেষে দুই পক্ষের মধ্যে হামলা ও মারামারির ঘটনা ঘটে।
মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক অসীম দেওয়ান যুগান্তরকে বলেন, ১০ বছরের পুরনো দুটি কমিটি ভেঙে দিয়েছি। হাতেম আলী কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সুমন সেরনিয়াবাত বর্তমানে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি। বরিশাল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি মোর্শেদ আলম মিরাজ ১৬নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় চালাতে গিয়ে আমরা কিছু জটিলতার মুখোমুখি হচ্ছি। আমাদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হচ্ছে, তা সত্য নয়। খুব শিগগিরই মহানগর ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি হবে। আর নতুন কমিটি না হওয়া পর্যন্ত আমরা দায়িত্বে থাকব। তাছাড়া আমাদের কমিটি থাকবে কি থাকবে না সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে কেন্দ্র। এখানে কলেজ পর্যায়ের নেতাদের কিছু বলার কোনো অধিকার নেই।
হাতেম আলী কলেজের বিলুপ্ত ঘোষিত কমিটির সাধারণ সম্পাদক জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি সুমন সেরনিয়াবাত বলেন, কমিটি ভেঙে দেয়ার অধিকার তাদের আছে। তবে তা করার আগে আমার সঙ্গে আলাপ করতে পারতেন। বিষয়টি আমার কাছে অসাংগঠনিক মনে হয়েছে। পাল্টাপাল্টি এসব সংবাদ সম্মেলনের আগেও দুপক্ষের বিরোধে বহুবার এসেছে নেতাদের বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক হওয়ার অভিযোগ। কোটি কোটি টাকার টেন্ডার দখল, গুচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সঠিক পদ্ধতিতে টেন্ডার হতে না দেয়া, লটারিতে বাধা দেয়া, জমি দখল, সাধারণ ঠিকাদারদের মারধর এবং ভর্তি বাণিজ্যসহ কলেজ ক্যাম্পাসে নেতাদের কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে খবর ছাপা হয়েছে জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকায়।
বরিশাল নাগরিক সমাজের সাধারণ সম্পাদক ডা. মিজানুর রহমান বলেন, এমনিতেই বর্তমানে ছাত্রলীগের নানা কর্মকাণ্ডে বিব্রত সরকার। ছাত্রলীগকে বলা হচ্ছে আওয়ামী লীগের বিষফোঁড়া। এ অবস্থায় বরিশালে যেখানে খোদ ছাত্রলীগ নেতারাই নিজেদের বিরুদ্ধে আনছেন দুর্নীতির অভিযোগ সেখানে তা তদন্ত হওয়া দরকার।
বিএম কলেজ কর্মপরিষদের সহ-সভাপতি ছাত্রলীগ নেতা মঈন তুষার বলেন, রাজনৈতিক দলের নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির কথা বলা এখন একটি ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। হুট করে যে কেউ বলে দেন যে, আমরা দুর্নীতিবাজ। আমি চাই, এসব অভিযোগের তদন্ত হোক। কেউ দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে থাকলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হোক। আর যদি অভিযোগ প্রমাণিত না হয় তাহলে যারা এসব মিথ্যা অভিযোগ তুলে ছাত্রলীগের চরিত্র হনন করছে তাদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেয়া হবে তাও ঠিক করতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.