তুচ্ছ কারণে খুন

‘স্ত্রীর সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করায় আমি অধ্যাপক শফিউলের সঙ্গে দেখা করতে যাই। কিন্তু তিনি আমার কথা না শুনে দুর দুর করে তাড়িয়ে দেন। এই অপমান আমি কোনোভাবেই মানতে পারিনি। তাই চিন্তা করলাম শফিউলকে ‘সাইজ’ করতে হবে। এ জন্য আমি উজ্জ্বল ও মানিকের সঙ্গে কথা বলে তাদের সাহায্য চাই। তারা আমার কথামতো কাজ করেছে।’ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এ কে এম শফিউল ইসলাম লিলনকে খুনের মূল পরিকল্পনাকারী আবদুস সামাদ ওরফে পিন্টু (৩৪) র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য দিয়েছে। গতকাল পিন্টুসহ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে মোট ৬ জনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এরপর ঢাকায় র‌্যাব সদর দফতরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের পুরো বিষয়টি খোলাসা করেন র‌্যাব কর্মকর্তারা।
গ্রেফতারকৃত অন্যরা হল- আরিফুল ইসলাম মানিক (৩৩), সবুজ শেখ (১৮), সিরাজুল ইসলাম ওরফে কালু (২২), আল মামুন (৩১) ও ইব্রাহিম খলিল ওরফে টোকাই বাবু (২১)। এরা সবাই রাজশাহী যুবদল ও ছাত্রদলের নেতাকর্মী।
র‌্যাব জানায়, এই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী আবদুস সামাদ পিন্টু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিকাদার ছিলেন। তার স্ত্রী নাসরিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব বিভাগে সেকশন অফিসার হিসেবে কর্মরত। দাফতরিক বিষয়ে পিন্টুর স্ত্রীর সঙ্গে অধ্যাপক শফিউল দুর্ব্যবহার করেন। স্ত্রীর কাছে ঘটনার শোনার পর দুর্ব্যবহারের কারণ জানতে শফিউলের কার্যালয়ে গেলে পিন্টুর সঙ্গে ‘খারাপ ব্যবহার’ করেন অধ্যাপক। এতে পিন্টু চরম অপমানিত বোধ করেন। অপমানের বদলা নেয়ার জন্য প্রথমে অধ্যাপককে ভয় দেখানোর পরিকল্পনা হয়। এর অংশ হিসেবে তার পায়ের দিকে ছুরিকাঘাত করার সিদ্ধান্তও হয়। কিন্তু ১৫ নভেম্বর চৌদ্দপায়া এলাকায় ফল গবেষণা কেন্দ্রের দক্ষিণের সড়কে দুষ্কৃতকারীরা অধ্যাপক শফিউলের ঘাড়ে কোপ দেয়ার পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। এ সময় এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত এবং চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে নিশ্চিত মৃত ভেবে পালিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। এরপর অধ্যাপককে ম–মূর্ষু অবস্থায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর তিনি মারা যান। ঘটনার পর থেকে র‌্যাব ও পুলিশ ঘাতকদের গ্রেফতারে মাঠে নামে।
সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান জানান, অধ্যাপক শফিউল খুনের ঘটনায় ১১ জন জড়িত ছিল। এদের মধ্যে ৬ জনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছে তিনজন। বাকি ২ জন পলাতক রয়েছে। র‌্যাব তাদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রেখেছে।
ওদিকে অধ্যাপক খুনের ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৩৪ জনকে গ্রেফতার করেছে রাজশাহী মহানগর পুলিশ। রোববার র‌্যাব সদর দফতরে আয়োজিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে সংস্থার আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান জানান, রাবির এই শিক্ষক খুনের পর র‌্যাব-৫ এর গোয়েন্দা দল অনুসন্ধানে নামে। তারা খবর পায় হত্যাকাণ্ডের অন্যতম পরিকল্পনাকারী আবদুস সামাদ ওরফে পিন্টু মতিহার থানার বিনোদপুরে দাশমারিতে নিজ বাড়িতে অবস্থান করছে। ওই তথ্যর ভিত্তিতে শনিবার পিন্টুকে গ্রেফতার করা হয়।
পিন্টুকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তার সঙ্গে কিলিং মিশনে অংশগ্রহণকারী আরও তিনজন ছিলেন। তারা একই থানাধীন কাপাসিয়ায় অবস্থান করছে। সে অনুযায়ী র‌্যাব রোববার দিবাগত রাতে কাপাসিয়া পালপাড়া ঢালের আমবাগান থেকে মানিক, সবুজ ও কালুকে গ্রেফতার করে। এই তিনজনকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যানুযায়ী রোববার ভোরে গাজীপুরের টঙ্গী স্টেশন রোড এলাকা থেকে আল মামুন ও টোকাই বাবুকে গ্রেফতার করা হয়।
অপমানের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য রাজশাহী জেলা যুবদলের আহ্বায়ক আনোয়ার হোসেন উজ্জ্বলের কাছে পিন্টু ক্ষোভের কথা জানায় এবং তার সঙ্গে পরামর্শ করে। পরে উজ্জ্বল বিষয়টি নিয়ে ওই শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলেন। অধ্যাপকের সঙ্গে যুবদল নেতা উজ্জ্বলেরও কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায় উজ্জ্বল নিজেও অপমানিত বোধ করেন। এ ঘটনার পর পরিকল্পনা অনুযায়ী শফিউলকে ‘ভয়’ দেখানো জন্য উজ্জ্বল ও পিন্টু তাদের পরিচিত মানিককে দায়িত্ব দেয়। মানিক তাদের পরামর্শে অধ্যাপক শফিউলের ওপর হামলা চালান। গ্রেফতারকৃতরা দাবি করেন, তাদের হত্যা পরিকল্পনা ছিল না। তাদের পরিকল্পনা ছিল অধ্যাপক শফিউলকে দু-একটি কোপ দিয়ে আহত করা।
মানিক জানায়, পিন্টু তাকে বারবার ফোন করে অধ্যাপক শফিউলের ওপর হামলা করতে বলে। কিন্তু সে শফিউলকে না চেনায় তিনদিন হামলা চালাতে গিয়েও ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। এক পর্যায়ে পিন্টু তাকে ফোন করে বলেন, ‘কোনো অসুবিধা নেই সে অধ্যাপক শফিউলকে চিনিয়ে দেবে।’ কথা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪/৫টি স্থানে অবস্থান নেয় খুনিরা। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে বাসার দিকে যাওয়ার সময় পিন্টু অধ্যাপক শফিউলকে চিনিয়ে দেন। এরপর মানিকসহ অন্যরা শফিউলের ওপর হামলা চালান। মানিক র‌্যাবকে জানিয়েছে, ১৫ নভেম্বর দুপুর আড়াইটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের হাউজিং সোসাইটি (বিহাস) সংলগ্ন চৌদ্দপায়া এলাকায় পৌঁছার পর পিন্টু শিক্ষকের গাড়ি দেখিয়ে দেয়। আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী মানিক প্রথমে শিক্ষককে কোপায়। এতে তিনি আহত হলে সবুজ শিক্ষকের মাথায় চাপাতি দিয়ে কোপ দেয়। সবুজের চাপাতির কোপে শিক্ষক মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। তারপর মামুন, আরিফ, বাবু ও কালুসহ সবাই চাপাতি, হাঁসুয়া ও চাকু দিয়ে তাকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। মৃত্য নিশ্চিত করে ঘটনাস্থল থেকে সবাই পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থলে পিন্টু এবং উজ্জ্বল দু’জনই উপস্থিত ছিল।

No comments

Powered by Blogger.