‘ধর্মপুত্র’ পলাশের অবিশ্বাস্য উত্থান by নুরুজ্জামান লাবু

অবিশ্বাস্য উত্থান। এক সময় যে ছিল বিমানবন্দরের ছোটখাটো দালাল, সেই এখন বিমানবন্দরের অঘোষিত নিয়ন্ত্রক। তার  অজান্তে বিমানবন্দর দিয়ে কোন চোরাচালান পার হয় না। চোরাচালানের সিন্ডিকেট রয়েছে নিজেরও। এক সময় নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা ছিল যার সেই এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। ঢাকায় নিজের আট তলা বাড়ি। চড়ে বেড়ায় বিলাসবহুল গাড়িতে। টেনেটুনে এসএসসি পাস করলেও পাইলট হিসেবে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে বিয়েও করেছে সুন্দরী বিমানবালাকে। সে হলো বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের চেয়ারম্যান এয়ার মার্শাল (অব.) জামাল উদ্দিনের কথিত ‘ধর্মপুত্র’। তার নাম মাহমুদুল হক পলাশ। গতকাল সে স্বর্ণ চোরাচালানের চার সহযোগীর সঙ্গে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। জবানবন্দিতে জানিয়েছে বিমানের শীর্ষ আরও কয়েক কর্মকর্তা স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। অন্যদের জবানবন্দিতেও এসেছে এই কর্মকর্তাদের নাম।
গোয়েন্দা ও অন্যান্য সূত্রে জানা গেছে, চাঁদপুরের হাজীগঞ্জের এ কে এম ফজলুল হকের বড় ছেলে মাহমুদুল হক পলাশ। পিতা একসময় কেন্দ্রীয় যুবলীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন। সবুজবাগের বাসাবো এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন। ১৯৯০ সালের গোড়ার দিকে পলাশ সিদ্ধেশ্বরী কলেজ থেকে এসএসসি পাস করে। ‘উড়নচ-ী’ হওয়ায় আর পড়াশোনা করতে পারেনি। ২০০০ সালের পর থেকে বিমানবন্দর এলাকায় ‘দালালি’ শুরু করে। দালালি করতে গিয়েই ‘আলাদিনের চেরাগ’ হাতে পায় সে। শুরু করে চোরাচালানির কাজ। প্রথম দিকে নানারকম বিদেশী পণ্য, কসমেটিক্স সামগ্রী চোরাচালান করতো। ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়ে স্বর্ণ চোরাচালানে। গড়ে তোলে নিজের সিন্ডিকেট। সূত্র জানায়, বিমানবন্দর দিয়ে নির্বিঘ্নে চোরাচালান পার করতে সে নিয়মিত যাতায়াত করতে থাকে বিমানবন্দর, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কার্যালয় ও সিভিল এভিয়েশন অফিসে। পরিচয় হয় বিভিন্ন পাইলট ও কেবিন ক্রুদের সঙ্গে। ২০০৯ সালে বিমানের চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেন এয়ার মার্শাল (অব.) জামাল উদ্দিন। কৌশলে সে চেয়ারম্যানের ছেলে জোবায়েরের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। সেই সুবাদে যাতায়াত শুরু করে চেয়ারম্যানের বনানীর বাসায়। সেই সুবাদে নিজের পরিচয় দেয়া শুরু করে বিমান চেয়ারম্যানের ‘ধর্মপুত্র’ হিসেবে। প্রভাব বিস্তার করতে থাকে বিমান অফিসে। চোরাচালানের পাশাপাশি ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণে নেয় কেবিন ক্রুদের নিয়োগ বাণিজ্য। চলতে থাকে নানা রকম তদবিরের কাজ। বিমানের কর্মীরা বিশ্বাস করতে থাকে পলাশকে ধরলেই সব অসম্ভব সম্ভব হয়ে যায়। কাবো’র উড়োজাহাজ ভাড়া নেয়া নিয়ে মধ্যস্থতা করে পলাশ। মধ্যস্থতা করে নাইজেরিয়া থেকে নিম্নমানের উড়োজাহান ভাড়া নেয়ার কাজেও। এক কথায় বিমানের এমন কোন শাখা নেই যেখানে পলাশের উপস্থিতি ছিল না।
সূত্র জানায়, ধীরে ধীরে পলাশ তার প্রভাব এতটাই বিস্তার করে যে বিমানের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধন্তেও তার ‘আন-অফিসিয়াল’ অংশগ্রহণ থাকতো। বিমানের সকল স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী তাকে সমীহ করে চলতো। অনেকেই নিজেদের পদোন্নতির জন্য ধরনা দিতো পলাশের কাছে। এ সব সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিমানে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে সে। বিমানের কেনাকাটা থেকে শুরু করে পদোন্নতি, নিয়োগ-বদলি, শাস্তি- সবখানেই তার হাত থাকতো। সূত্র জানায়, বাংলাদেশ প্রধানত দুবাই থেকে স্বর্ণের চোরাচালান আসে। কখনও তা সরাসরি, আবার কখনও সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়া হয়ে অল্প সময়েই। এ কারণে চোরাচালান চক্রের সঙ্গে জড়িত কেবিন ক্রু যেন এ সব দেশের ফ্লাইটে দায়িত্বে থাকে, তা নিশ্চিত করতো পলাশ। বিমানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিজের বশে এনে স্বর্ণ চোরাচালানের নিজের সিন্ডিকেট আরও শক্তিশালী করে। মাসে তার আয় ছিল কোটি টাকা। বাসাবো এলাকায় আট তলা বাড়ি করেছে। হয়েছে বিলাসবহুল গাড়ির মালিক। উত্তরায় ৪০ হাজার টাকা ভাড়ায় বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে থাকে। গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে ‘হক টাওয়ার’ নামে ১২তলা ভবনের নির্মাণকাজ চলছে। এটি দেখাশোনা করেন পলাশের পিতা ফজলুল হক। এছাড়া শেয়ার বাজারে রয়েছে কোটি টাকার বিনিয়োগ। নামে-বেনামে রয়েছে ফ্ল্যাট আর ব্যাংক ব্যালান্স। সূত্র জানায়, ভুয়া পরিচয় দিয়ে পলাশ নূরজাহান নামে এক বিমানবালাকে বিয়ে করে। পাইলট প্রশিক্ষণ না থাকলেও প্রভাব খাটিয়ে ফ্লাইং ক্লাবের মেম্বার হয় সে। সেই মেম্বারশিপ দেখিয়ে বিয়ে করে। স্বামীর প্রভাবে স্ত্রী নূরজাহানও বিমানে দাপট নিয়ে চলাফেরা করতো। সমীহ করতো সহকর্মী বিমানবালারাও। কথিত রয়েছে, চোরাচালানের কাজে স্ত্রীকেও ব্যবহার করতো পলাশ।
পলাশসহ পাঁচ জনের স্বীকারোক্তি: স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত পলাশসহ ডিজিএম এমদাদ হোসেন, ম্যানেজার (শিডিউলিং) তোজাম্মেল, চিফ প্ল্যানিং অ্যান্ড শিডিউলিংয়ের ক্যাপ্টেন আসলাম শহীদ ও মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ী হারুন-অর-রশীদ আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে রাজি হলে গতকাল এ পাঁচ জনকে রিমান্ড শেষ হওয়ার একদিন আগেই আদালতে হাজির করা হয়। গতকাল দুপুরে পৃথক পাঁচ জন ম্যাজিস্ট্রেটের খাস কামরায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। সূত্র জানিয়েছে, পলাশসহ পাঁচ জনই তাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে নিজেদের জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। একই সঙ্গে বিমানের আর কারা কারা স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত তাদের নামও বলেছে। সূত্র জানায়, এর আগে কেবিন ক্রু মাজহারুল ইসলাম রাসেল তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে যাদের নাম বলেছিল এ পাঁচ জনও তাদের নামই বলেছে। এর মধ্যে কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রয়েছে। এদের মধ্যে জিএম (সিকিউরিটি) মোমিনুল ইসলাম, আতিক সোবহান ও শামীম নজরুলের নাম এসেছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, এই পাঁচ জনের দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে যাদের নাম এসেছে তাদের বিষয়ে খোঁজ করা হচ্ছে। প্রয়োজনে তাদেরও গ্রেপ্তার করা হবে।
উল্লেখ্য, গত ১২ই নভেম্বর বাংলাদেশ বিমানের বিজি ০৪৬ ফ্লাইটের স্টুয়ার্ট মাজহারুল ইসলাম রাসেল ২ কেজি স্বর্ণসহ কাস্টমস কর্তৃপক্ষের কাছে হাতেনাতে ধরা পড়ে। গত সোমবার রাসেল আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। ওই জবানবন্দির তথ্য অনুযায়ী মঙ্গলবার রাতে প্রথমে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট সার্ভিসের উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) এমদাদ হোসেনকে উত্তরার বাসা থেকে আটক করা হয়। পরে তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী বিমান বাংলাদেশের চিফ অব প্ল্যানিং অ্যান্ড শিডিউলিংয়ের ক্যাপ্টেন আবু মো. আসলাম শহীদ, ম্যানেজার (শিডিউলিং) তোজাম্মেল হোসেন, ঠিকাদার মাহমুদুল হক পলাশ এবং উত্তরার ‘ফারহান মানি এক্সচেঞ্জ’-এর মালিক হারুন অর রশীদকে গ্রেপ্তার করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.