সরকারের দেনা চার লাখ কোটি টাকা

সরকার চার লাখ কোটি টাকার পুঞ্জীভূত ঋণভারে জর্জরিত। রাজনৈতিক কারণে উচ্চাভিলাষী বাজেট বাস্তবায়ন করতে গিয়ে দেশ ও বিদেশ থেকে এই পরিমাণ অর্থ ঋণ করতে হয়েছে সরকারগুলোকে। যথাযথ খাতে ব্যয় না হওয়ায় ঋণের টাকার অপচয় হচ্ছে। এর সঙ্গে সুদ যোগ হওয়ায় ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই অর্থ পরিশোধ করতে গিয়ে জনগণের ওপর চাপ বাড়ছে। আবার বাড়তি ঋণের কারণে বেড়ে যাচ্ছে মূল্যস্ফীতির হার- যা মানুষের আয় খেয়ে ফেলছে। ঋণের কারণে দু’দিক থেকেই মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সঠিক ব্যবহার না হওয়ায় ঋণ মানুষের উপকারে আসছে না।
সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান উন্নয়ন অন্বেষণের ‘বাংলাদেশ অর্থনৈতিক পর্যালোচনা’ ২০১৪-এর অক্টোবর সংখ্যায় প্রকাশ করা তথ্য মতে, স্বাধীনতার পর থেকে গত জুন পর্যন্ত সরকারগুলোর দেশে-বিদেশে ঋণের পরিমাণ প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা। স্বাধীনতার পর থেকে গত জুন পর্যন্ত সময়ের মধ্যে দশ বছরের ঋণ তথ্য বিশ্লেষণ করে এ পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে দেশীয় বিভিন্ন উৎস থেকে নেয়া হয়েছে প্রায় ২ লাখ ২ হাজার কোটি টাকা। বাকি ১ লাখ ৮৬ হাজার কোটি টাকা নেয়া হয়েছে বৈদেশিক উৎস থেকে। ঋণের বিপরীতে প্রতি বছর গড়ে ২৫ থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে। ঋণের অংক বাড়ার সঙ্গে সুদ পরিশোধের পরিমাণও বাড়ছে। এর মধ্যে বৈদেশিক ঋণের ৭৫ শতাংশ চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। অথচ ঋণের পুরোটাই থাকছে দেশের মানুষের ওপর।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রতি বছর সরকার যে ঋণ করছে তার প্রায় সবটাই কোনো না কোনোভাবে দেশের সাধারণ জনগণের ওপর পড়ছে। এ বিষয়ে উন্নয়ন অন্বেষণের ওই গবেষণা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সরকারের ঋণের বোঝা যত বাড়ছে, জনগণের মাথাপিছু দেনার পরিমাণও ততোধিক হারে বাড়ছে। এর ফলে চলতি অর্থবছর শেষে দেশের মানুষের মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ২৮ হাজার ৫৬ টাকা। এর মধ্যে দেশীয় ঋণ ১৫ হাজার ৯৬৯ এবং বৈদেশিক ঋণ ১২ হাজার ৮৭ টাকা।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ যুগান্তরকে বলেন, আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় সরকারকে ঘাটতি বাজেট করতে হচ্ছে। ঘাটতি মেটাতে সরকার দেশী-বিদেশী উৎস থেকে ঋণ নিচ্ছে। তিনি ঋণনির্ভরতা কমাতে রাজস্ব আয় বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি কর ফাঁকির প্রবণতা বন্ধের ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করেছেন। তার মতে, কর ফাঁকি বন্ধ হলে রাজস্ব আয় এমনিতেই বেড়ে যাবে।
সাম্প্রতিক সময়ে সরকার বৈদেশিক ঋণ নেয়ার বিষয়ে বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করছে। ফলে ওই খাতে বিদেশী ঋণের পরিমাণ বেড়ে প্রায় ৪০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এছাড়া সরকারও কঠিন শর্তে বৈদেশিক ঋণ নিচ্ছে। যার পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫০ কোটি ডলার। এসব ঋণ পরিশোধের সময়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ পড়বে। সে হিসাবে এসব ঋণের কারণে দেশের অর্থনীতি ঝুঁকির দিকে যাচ্ছে। দেশে বিনিয়োগে স্থবিরতা থাকায় গত অর্থবছরে সরকারের ঋণের অংক কমে গিয়েছিল। চলতি অর্থবছরে ব্যাংক ঋণের পরিমাণ কমলেও বাড়ছে ব্যাংকবহির্ভূত ঋণের পরিমাণ। ফলে সার্বিকভাবে সরকারের ঋণের অংক বাড়ছে- যা সুদের পরিমাণও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বাজেট ব্যয় পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা ব্যয়ের বাজেট করা হয়েছে। এর মধ্যে সার্বিক ঘাটতি রাখা হয়েছে ৬৭ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ শতাংশ। এই ঘাটতি বিভিন্ন খাত থেকে ঋণ নিয়ে পূরণ করা হবে। এর মধ্যে বৈদেশিক উৎস থেকে ২৪ হাজার ২৭৫ কোটি এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ৪৩ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ উৎসের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৩১ হাজার ২২১ কোটি টাকা এবং সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে ১২ হাজার ৫৬ কোটি টাকা নেয়া হবে।
স্বাধীনতার পর থেকে গত ফেরুয়ারি পর্যন্ত সরকারের মোট ঋণের স্থিতির মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি, ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক খাত থেকে ২১১ কোটি এবং সঞ্চয়পত্র থেকে ৭১ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে আমানতের সুদের হার কমে যাওয়ায় সঞ্চয়কারীরা এখন সরকারি সঞ্চয়পত্রে ব্যাপক হারে বিনিয়োগ করছে। ফলে এই খাত থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার পরিমাণ বছর শেষে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসেই লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৭৫ শতাংশ সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, দেশীয় প্রেক্ষাপটে এখনও বৈদেশিক ঋণ উদ্বেগের পর্যায়ে যায়নি। কারণ বাংলাদেশের নেয়া বৈদেশিক ঋণের প্রায় বেশির ভাগই দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমাত্রা সুদের।
তবে উদ্বেগের ক্ষেত্রটি হচ্ছে, দেশীয় উৎস থেকে সরকারের ঋণ নেয়ার প্রবণতা বেড়ে যাওয়া। কারণ এ ঋণে গড়ে সরকারকে ১০ শতাংশ হারে সুদ দিতে হচ্ছে। আর তা মোট ঋণের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশই ব্যয় হচ্ছে এ খাতে। তিনি মনে করেন, ঋণ যেহেতু করতেই হচ্ছে সেক্ষেত্রে দেশের চেয়ে বিদেশী উৎসের ঋণই সাশ্রয়ী। তাই অভ্যন্তরীণ থেকে ঋণ নিয়ে চাপে না ফেলে এ মুহূর্তে পাইপলাইনে আটকে থাকা বিদেশী ঋণগুলো গ্রহণের পরামর্শ দেন তিনি। জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর যুগান্তরকে বলেন, আয় বুঝে ব্যয় নির্ধারণ না করে অযৌক্তিকভাবে বাজেট ঘাটতি বৃদ্ধিই পাহাড়সম এই দেনার মুখ্য কারণ। ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করছে। এ কারণে সরকারের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষী বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) কখনোই শতভাগ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয়ের বরাদ্দ তুলনামূলক বেশি হওয়ায় অগ্রাধিকারভিত্তিক ব্যয়ের খাতেও বরাদ্দ সংকুচিত হয়ে পড়ছে- যা পরোক্ষভাবে বাড়াচ্ছে সরকারের দেনার বোঝা। যে কারণে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারকে ‘কুল রাখি না শ্যাম রাখি’ পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে।
তিনি এর থেকে উত্তরণে বাজেট ঘাটতি ও ঋণের প্রতিকূল প্রভাব মোকাবেলায় মুদ্রা ও রাজস্বনীতির মধ্যে সমন্বয়ের পরামর্শ দিয়েছেন। জাতিসংঘের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলসংক্রান্ত অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশনের (এসকাপ) এক প্রতিবেদনে এ বিষয়ে বলা হয়েছে, সরকার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের প্রতি অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়ায় আর্থিক, মুদ্রা এবং বিনিময় হারসংক্রান্ত সামষ্টিক অর্থনীতির নীতিগুলো স্বাধীনভাবে প্রণয়ন করতে পারছে না। ফলে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্যবিমোচন ও সামাজিক উন্নয়ন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.