সরকারের ‘মাত্রাতিরিক্ত’ তৎপরতার কারণ খুঁজছে জামায়াত by আহমেদ জামাল

মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় হঠাৎ সরকারের ‘মাত্রাতিরিক্ত’ তৎপরতার কারণ খুঁজছে জামায়াতে ইসলামী। মাসের পর মাস অপেক্ষমাণ থাকা তিন শীর্ষ নেতার মামলার রায় ছয় দিনের মধ্যে ঘোষণা দেয়া তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। তারা বলেন, ২৪শে জুন থেকে অপেক্ষমাণ ছিল জামায়াতের আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর মামলার রায়। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের বাংলাদেশ সফরের দিন ওই রায় ঘোষণার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। অবশ্য এর আগেও বেশ ক’মাস অপেক্ষমাণ ছিল এই মামলার রায়। এছাড়া ৪ঠা জুন থেকে অপেক্ষমাণ থাকে জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের সদস্য মীর কাসেম আলীর রায়। ১৭ই সেপ্টেম্বর থেকে অপেক্ষমাণ থাকে সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামানের চূড়ান্ত রায়। কিন্তু ২৯শে অক্টোবর মতিউর রহমান নিজামীর রায়, ২রা নভেম্বর মীর কাসেম আলী এবং ৩রা নভেম্বর কামারুজ্জামানের চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করা হয়। ৪ঠা নভেম্বর কামারুজ্জামানের রায় কার্যকরের তৎপরতা শুরু হয়। যদিও পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ না হওয়ার কারণে শেষ পর্যন্ত সেটা স্থগিত হয়। তবে এক সপ্তাহের মধ্যে তিনটি রায় একটি কার্যকরের চেষ্টা ভাবিয়ে তুলছে জামায়াতকে। নবম সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবির পর একের পর এক সঙ্কট মোকাবিলা করছে জামায়াত। তবে এবারের সঙ্কট স্মরণকালের ইতিহাসে সবচেয়ে কঠিন এবং দুর্যোগময়। বিষয়টি স্বীকার করে দলের বিভিন্ন সারির নেতারা বলছেন, ২০ দলীয় জোটের সম্ভাব্য আন্দোলনকে আমলে নিয়ে সরকার হঠাৎ এমন আগ্রাসী ভূমিকা নিয়েছে। তাদের দাবি, আন্তর্জাতিক মহলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের আগে সরকার জাতীয়তাবাদী এই ইসলামী শক্তিকে নিস্তেজ করে দিতে চায়। এ জন্য দলটিকে নেতৃত্বশূন্য করার এই ষড়যন্ত্রে মেতেছে। নতুন ফাঁদ পেতেছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, ২৩শে অক্টোবর জামায়াতের সাবেক আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের প্রিজন সেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তিকাল করেন। মানবতাবিরোধী অপরাধে ৯০ বছর দণ্ডপ্রাপ্ত ৯২ বছরের এই নেতাকে জামায়াতের মাস্টার মাইন্ড এবং আধ্যাত্বিক গুরু হিসেবে গণ্য করা হতো। ২৫শে অক্টোবর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে গোলাম আযমের জানাজায় লাখো মানুষের উপস্থিতি জামায়াত-শিবিরের শোকাতুর নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করে। তবে ওই শোডাউন সরকারকে নতুন করে ভাবনায় ফেলেছে বলে দাবি করেন এক নেতা। তিনি বলেন, সরকার ভেবেছিল জামায়াত নিঃশেষ হয়ে গেছে। কিন্তু গোলাম আযমের জানাজা দেখে তারা নড়েচড়ে ওঠে। গোলাম আযমের মৃত্যুর রেশ না কাটতেই দলটির আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীর ফাঁসির রায় দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। তার একদিন পর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের মামলার চূড়ান্ত রায় দেয়। টানা তিনটি রায়ে যখন দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম জামায়াতের, ঠিক সেই মুহূর্তে কামারুজ্জামানের রায় কার্যকর করার উদ্যোগ নেয় সরকার। ঘটনার ধারাবাহিকতায় অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে জামায়াত। তিন দফায় পাঁচ দিন হরতাল কর্মসূচি দিয়ে এসব ঘটনার প্রতিবাদ করলেও তাতে সরকারের ওপর তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। এমন অবস্থায় দলটির অস্তিত্ব, নেতাকর্মীদের মনোবল, আত্মবিশ্বাস কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। তিন বছরের বেশি সময় ধরে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে শুরু করে সকল মহানগর এমনকি জেলা-উপজেলা পর্যায়ের কার্যালয়গুলো বন্ধ। অসংখ্য মামলার বোঝা নিয়ে আত্মগোপনে আছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত আমীর, ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেলসহ প্রায় সব নেতাকর্মী। জোটের শরিক হলেও কৌশলগত কারণে এ ক্ষেত্রে কোন ভূমিকা রাখতে পারছে না বিএনপি। তাছাড়া, বিভিন্ন কারণে এই রাজনৈতিক মিত্রের মধ্যে সাম্প্রতিককালে খানিকটা মান-অভিমান এমনকি কিছুটা সন্দেহ-অবিশ্বাস ভুল বোঝাবুঝির কথাও শোনা যায়। আপৎকালীন মুহূর্তে বিএনপির পক্ষ থেকে তেমন কোন সহানুভূতি বা আন্দোলনে সমর্থন না পাওয়া জামায়াতের তৃণমূল কর্মীদের হতাশ করছে। এ প্রেক্ষাপটে যে কোনভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করে রাজনৈতিক অঙ্গনে টিকে থাকার পক্ষে দলের নেতারা। সূত্র জানায়, শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির রায়ের প্রতিবাদে ৩০শে অক্টোবর থেকে তিন দফায় ৫ দিন হরতালসহ বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করলেও তা ছিল শুধুই নিয়ম রক্ষার। যথাসম্ভব সহিংসতা এড়িয়ে রক্ষণাত্মক কৌশলে এসব কর্মসূচি পালনের জন্য দয়িত্বশীলদের নির্দেশনা ছিল আগ থেকে। এ কারণে হরতাল-বিক্ষোভে আক্রমণাত্মক বা মারমুখো দেখা যায়নি নেতাকর্মীদের। এমনকি কামারুজ্জামানের ফাঁসি নিয়ে দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীরা উদ্বিগ্ন ও ক্ষুব্ধ থাকলেও তা কার্যকর হলে খুব বেশি প্রতিক্রিয়া না দেখানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন নীতিনির্ধারকরা। গতানুগতিক দু’-একদিন হরতাল বা বিক্ষোভের মধ্যেই কর্মসূচি সীমাবদ্ধ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। বিষয়টি স্বীকার করে দলের এক তরুণ সদস্য বলেন, বিচার বিভাগ কতটা রাজনৈতিক তা উপর্যুপরি তিনটি রায়ে প্রমাণ হয়েছে। ২১ লাখ পরীক্ষার্থীর শিক্ষা জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলতে সরকার এই ফাঁদ পেতেছে।
পর্যবেক্ষক মহলের মতে, গত বছর বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলনের সময় ব্যাপক সন্ত্রাস সহিংসতায় দেশে-বিদেশে চরমভাবে  সমালোচিত হয় জামায়াত। ওই আন্দোলনকে ঘিরে দেশ জুড়ে দলের ব্যাপক জনশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ প্রেক্ষাপটে আগামীতে সরকার পতনের মতো চূড়ান্ত আন্দোলন ছাড়া কঠোর কর্মসূচি দেবে না জামায়াত। তবে চলমান পরিস্থিতিতে দলের সব স্তরে ক্ষোভ ও হতাশা নেমে এসেছে। এ অবস্থায় দলের কেউ কেউ রাজপথে কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখানোর পক্ষে। তবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলের সমালোচনা ও বিতর্ক থেকে রক্ষা পেতে কৌশলী প্রতিবাদের সিদ্ধান্ত নেন দায়িত্বশীলরা। রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা এবং নেতাকর্মীদের মনোবল ধরে রাখতেই প্রতিবাদের সহজ মাধ্যম হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয় হরতাল কর্মসূচি। তবে তা শান্তিপূর্ণভাবে পালনের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত আমীর মকবুল আহমাদ ও ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমানের। এব্যাপারে ঢাকা মহানগর জামায়াতের এক নেতা বলেন, আমরা বরাবর নিয়মতান্ত্রিক এবং স্বাভাবিক আন্দোলন করি। কিন্তু সরকার চায় অস্বাভাবিক কিছু করি। যাতে আমাদের অগণতান্ত্রিক জঙ্গি ইত্যাদি নামে কলঙ্কিত করা যায়। তবে জামায়াত সরকারকে সেই সুযোগ দিতে রাজি নয়। এজন্য প্রতিবাদের ভাষায় প্রতিবাদ জানাচ্ছে জামায়াত দাবি করে তিনি বলেন, সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল কামারুজ্জামানের ফাঁসি পরবর্তী দলের নেতাকর্মীদের প্রতিক্রিয়া দেখানোর বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন কামারুজ্জামান নিজেই। বৃহস্পতিবার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আইনজীবীদের মাধ্যমে দলের সব স্তরের জনশক্তির উদ্দেশে তিনি বলেছেন, আমার শহীদি খুনের বদলা যেন তারা দ্বীন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নেয়। আমার ওপর যে জুলুম করা হয়েছে, তার কারণে কেউ যেন প্রতিহিংসার শিকার না হয়। দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদের শান্ত রাখতেই কামারুজ্জামানের ওই বক্তব্য ব্যাপকভাবে প্রচার করা হচ্ছে। ফলে চলমান প্রেক্ষাপটে আপাতত কঠোর কোন আন্দোলনের সম্ভাবনা  নেই বলে ধারণা করা হচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.