মৃত্যুর আগে মাহজাবিনের আকুতি- ‘আব্বু আমাকে নিয়ে যাও’ by রুদ্র মিজান

‘আব্বু তুমি আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও। নইলে ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।’ মৃত্যুর আগের দিন সকাল ১১টায় পিতা পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক প্রকৌশলী নুরুল ইসলামকে ফোনে কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন শামারুখ মাহজাবিন সুমি। নুরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘মাগো, তুমি কিছুদিন কষ্ট করে থাকো। তোমার এফসিপিএস ভর্তি পরীক্ষাটা হয়ে যাক, এরপর আমি একটা কিছু করবো। দ্রুত ঢাকা এসে তোমার শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে আলোচনা করবো। কিন্তু সেই সুযোগ আর পাননি তিনি। তার আগেই তার একমাত্র কন্যা লাশ হয়ে ফিরেছেন তাদের কাছে। নুরুল ইসলাম জানান, মাহজাবিনকে হত্যা করে আত্মহত্যা বলে প্রচার করা হচ্ছে। মাহজাবিনের শ্বশুর যশোর মনিরামপুরের সাবেক এমপি খান টিপু সুলতান। প্রভাব খাটিয়ে তিনি হত্যাকাণ্ডকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছেন বলে অভিযোগ করেন নুরুল ইসলাম।

গতকাল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মাহজাবিনের লাশের ময়নাতদন্ত করা হয়। ময়নাতদন্ত শেষে নিহতের লাশ তার পিতা নুরুল ইসলাম ও মামা শহিদুর রহমানের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। রাতে লাশ নিয়ে যশোরে পৌঁছেন তারা। মাহজাবিনকে হত্যা করা হয়েছে নাকি আত্মহত্যা করেছেন এ বিষয়ে পুলিশ নিশ্চিত হতে পারেনি। আত্মহত্যা করে থাকলে তা কেন করলেন এ বিষয়েও তদন্ত করছে পুলিশ। স্বামী সুলতান সাদাবের অভিযোগ অনুসারে মাহজাবিনের সঙ্গে কারও  প্রেমের সম্পর্ক ছিল কি-না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, খান টিপু সুলতানের ওই বাসার মাহজাবিনের ঘুমানোর কক্ষ থেকে একটি ডায়রি উদ্ধার করা হয়েছে। এতে মাহজাবিন তার পিতা ও এক বান্ধবীর কাছে চিঠি লিখেছেন। পিতার কাছে শ্বশুর বাড়ির নানা কষ্টের বর্ণনা দিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন মাহজাবিন। বারবার পিতার কাছে তার অসীম ভালবাসা প্রকাশ করে লিখেছেন, পৃথিবীতে তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ বাবা। বাবার ভালবাসায় তিনি বেঁচেছিলেন। কিন্তু এভাবে আর সহ্য হচ্ছে না। বলে বাবার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন তিনি। অন্যদিকে তার বইগুলো বান্ধবীকে নিয়ে যেতে লিখেছেন মাহজাবিন। তবে ডায়েরির এই লেখাগুলোকে সাজানো বলে দাবি করেছেন নিহতের পিতা নুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, আত্মহত্যা প্রমাণ করার জন্য এগুলো সাজানো হচ্ছে। আমার মেয়ে যদি আত্মহত্যাই করবে তাহলে আমাকে ঘটনার আগের দিন ফোনে বলতো না যে ‘আব্বু আমাকে নিয়ে যাও।’ তিনি আরও জানান, খান টিপু সুলতানের কথার মধ্যেই অসংলগ্নতা রয়েছে। ঘটনার দিন ১৩ই নভেম্বর বেলা ২টা ৪০ মিনিটে টিপু সুলতান তাকে ফোনে বলেছেন, বিয়াই দ্রুত ঢাকায় আসেন। একটু সমস্যা হয়েছে। আপনার মেয়ে ঘুমের ওষুধ খেয়ে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। নুরুল ইসলাম তখন বিস্তারিত জানতে চান। কিন্তু লাইন কেটে দেন খান টিপু সুলতান। বিকাল ৪টায় আবার তার মোবাইলফোনে কল দিয়ে টিপু সুলতান জানতে চান, খারাপ কিছু হলে করণীয় কি হবে। মাহজাবিনের পিতা নুরুল ইসলাম বলেন, আমার মেয়ে যদি বাথরুমের গ্রিলের সঙ্গে ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে থাকে তাহলে তখন ঘুমের ওষুধ সেবনের কথা বলা হলো কেন?
এ বিষয়ে ধানমন্ডি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু বকর সিদ্দিক বলেন,  মাহজাবিনকে হত্যা করা হয়েছে নাকি তিনি আত্মহত্যা করেছেন তা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন না পেলে নিশ্চিত হওয়া যাবে না। মাহজাবিনের লাশের ময়নাতদন্ত করেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ। তিনি জানান, মাহজাবিনের গলায় ওড়না প্যাঁচানোর দাগ পাওয়া গেছে। তবে তা খুব গাঢ় না। সামনের চেয়ে পেছনের দিকটা হালকা। নিহতের বাম হাতের কব্জিতে কাটা দাগ পাওয়া গেছে। এছাড়া তার শরীরের কোথাও আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি বলে তিনি জানান। তবে হত্যা নাকি আত্মহত্যা তা ময়নাতদন্তের পূর্ণাঙ্গ ফলাফল না পাওয়া পর্যন্ত বলা যাবে না।
সূত্রে জানা গেছে, খান টিপু সুলতানের পুত্র সুলতান সাদাবের সঙ্গে বিয়ের পর থেকেই নানা অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে মাহজাবিনকে। বিবাহত্তোর বৌভাত অনুষ্ঠানে খান টিপু সুলতানের স্ত্রী ডা. জেসমিন আরা বেগমের সঙ্গে উপহার সামগ্রী নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয়। এ সময় জেসমিন আরা বেগম নানা আপত্তিকর মন্তব্য করেন। এমনকি নুরুল ইসলামকে হুমকি দেন। পরবর্তীতে মেয়ের সুখের জন্য স্বর্ণালঙ্কারসহ ১০ লাখ টাকার মালামাল দেন নুরুল ইসলাম। বিয়ের আগে ২০১১ সালে মাহজাবিন এমবিবিএস পাস করেন। বিয়ের পর তাকে এফসিপিএস পরীক্ষা দেয়ানো হবে বলে কথা দিলেও এতে বাধা দেন মাহজাবিনের শ্বশুর, শাশুড়ি ও স্বামী। এসব বিষয় মাহজাবিন তার পিতার সঙ্গে প্রায়ই আলাপ করতেন। প্রায়ই ফোনে এসব কথা বলতে বলতে কান্নাকাটি করতেন মাহজাবিন। মাহজাবিন তার পিতাকে জানিয়েছিলেন, তার শাশুড়ি তাকে দিয়ে বাসার গৃহপরিচারিকার কাজ করান। পড়ার সুযোগ দেন না। তার স্বামীর পরিবারের লোকজন চাইতেন না তিনি লেখাপড়া করেন। মাহজাবিন ৩৫তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এতেও পরিবারের লোকজন ঘোর আপত্তি জানান। তার শাশুড়ি ডা. জেসমিন আরা বেগম বলেছেন, বিসিএস দিয়ে চাকরি করলে এই পরিবারে তোমার জায়গা হবে না। এ বিষয়ে কথা বললে নুরুল ইসলামের সঙ্গেও বিরূপ আচরণ করেন জেসমিন আরা বেগম।
মাহজাবিনের সঙ্গে হলিফ্যামিলি রেডক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ  থেকে ২০১৩ সালে একসঙ্গে এমবিবিএস পাস করেছেন ডালিয়া। মাহজাবিনের এই বান্ধবী জানান, মাহজাবিন ইন্টার্নি শেষ করে যখন এফসিপিএস ও বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুুতি নিচ্ছিল তখন বিপত্তি বাধায় শ্বশুরবাড়ির লোকজন। মাহজাবিন এর আগে কয়েকবার আমাকে জানিয়েছিল তার শাশুড়ি ও শ্বশুর চান না সে বিসিএস পরীক্ষা দিক ও এফসিপিএস করুক।
এ বিষয়ে মাহজাবিনের শ্বশুর সাবেক এমপি খান টিপু সুলতান, শাশুড়ি জেসমিন আরা বেগম ও স্বামী সুলতান সাদাবকে আসামি করে ধানমন্ডি থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলার বাদী হয়েছেন নিহতের পিতা নুরুল ইসলাম। মামলা দায়েরের পর সুলতান সাদাবকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গতকাল আদালত তাকে জেল হাজতে প্রেরণ করেছেন। তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশের উপ-পরিদর্শক কাজী শরিফুল জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তার রিমান্ড আবেদন করেছেন। আবেদনের প্রেক্ষিতে রোববার রিমান্ড আবেদনের শুনানি অনুষ্ঠিত হবে বলে জানা গেছে। ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলেই দাবি করছেন খান টিপু সুলতান। রাজধানীর ধানমন্ডির ৬ নম্বর সড়কের ১৪ নম্বর প্লটের কেয়ারী তাজ অ্যাপার্টমেন্টের তিন তলার ডি-২ ফ্ল্যাটে স্বামী ও শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে থাকতেন মাহজাবিন। খান টিপু সুলতান জানান, মাহজাবিনকে তিনি তার মেয়ের মতোই স্নেহ করতেন। ঘটনার দিন দুপুরে খাবারের জন্য ডাকাডাকি করে সাড়া না পেয়ে বাথরুমের দরজা ভেঙে মাহজাবিনকে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। দ্রুত মাহজাবিনকে সেন্ট্রাল হাসপাতালে নিয়ে গেলে জরুরি বিভাগের চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তবে কেন মাহজাবিন আত্মহত্যা করলেন এ বিষয়ে তেমন কোন তথ্য জানাতে পারেননি খান টিপু সুলতান। এদিকে, মাহজাবিনের সঙ্গে কারও পরকীয়া প্রেমের সম্পর্ক ছিল কি-না তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ। ইতিমধ্যে মাহজাবিনের কললিস্ট অনুসারে তদন্ত শুরু করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত সুলতান সাদাবের বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, ঘটনার দিন সকালে সুলতান সাদাব ও মাহজাবিন একসঙ্গে বাসা থেকে বের হন। প্রাইভেট কারে থাকাবস্থায় মাহজাবিনের মোবাইলফোনে একটি কল আসে। তা রিসিভ না করায় কে কল করেছে জানতে চেয়েছিলেন সাদাব। এ সময় মাহজাবিন তার এক বান্ধবীর কথা জানান। সাদাবের সন্দেহ হলে তিনি নিজে  ফোনটি নিয়ে কল ব্যাক করে  দেখেন একটি ছেলে তা রিসিভ করেছে। এ নিয়ে তাদের মধ্যে কথাকাটাকাটি ও মনোমালিন্য হয়। পরে মাহজাবিনকে পাবলিক লাইব্রেরির সামনে নামিয়ে দিয়ে সাদাব জজ কোর্টে চলে যান। দুপুরে সাদাব বাসায় ফিরলে মাহজাবিন তার কাছে ক্ষমা চান। এর কিছুক্ষণ পর তিনি বাথরুমে গিয়ে দীর্ঘ সময় ভেতর  থেকে ছিটকিনি আটকিয়ে রাখেন। পরে পরিবারের লোকজনের সন্দেহ হলে প্রথমে ডাকাডাকি ও পরে দরজা ভেঙে ঝুলন্ত অবস্থায় তাকে পাওয়া যায়। পরকীয়া প্রেমের বিষয়ে মাহজাবিনের বান্ধবীরা জানিয়েছেন, এসব অপপ্রচার ছাড়া আর কিছু না। তার ঘনিষ্ঠ কোন ছেলে বন্ধুই নেই। ২০১৩ সালের ২৬শে এপ্রিল যশোরের মনিরামপুর উপজেলার দুর্গাপুরের বাসিন্দা ও ওই সংসদীয় আসনের সাবেক এমপি খান টিপু সুলতানের পুত্র সুলতান সাদাবের সঙ্গে বিয়ে হয় মাহজাবিনের। সুলতান সাদাব ঢাকা জেলা জজ কোর্টের একজন আইনজীবী। মাহজাবিনের বাড়ি একই জেলা সদরের বিমানবন্দর সড়ক এলাকায়। নিহত মাহজাবিনের পিতা পানি উন্নয়ন বোর্ডের অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী নুরুল ইসলাম। তার মা ডা. কাজী শাহানা পারভীন প্রায় দুই বছর আগে মারা যান। দুই ভাইবোনের মধ্যে মাহজাবিন ছোট।

No comments

Powered by Blogger.