টাওয়ার হ্যামলেটসের বাদশা

সাম্প্রতিক এক শুক্রবারে পূর্ব লন্ডনের মসজিদে জুমার নামাজ আদায়কারীদের এতটাই ভিড় ছিল যে, হোয়াইট চ্যাপেল রোডের ফুটপাথে পর্যন্ত তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। এদের বেশির ভাগই বাংলাদেশী সম্প্রদায়ের, যারা লন্ডনের এ এলাকাতে বসতি গড়েছে। কংক্রিটের ওপর সংবাদপত্র বিছিয়ে নামাজ সম্পন্ন করে তারা। পথচারীরা এর মধ্য দিয়েই দ্রুত পার হয়ে যায়। হাঁটার ছন্দ ভঙ্গ হওয়াতে পূর্ব লন্ডনের পথচারীদের চোখে মুখে আটকে রাখা হতবাক হওয়ার অনুভুতি বা অস্বস্তি লক্ষ্য করা যায়। এ দৃশ্যটি লন্ডনের বহুজাতিক সংস্কৃতির পূর্ব এলাকায় নানা সম্প্রদায়ের শিষ্টাচারী কিন্তু স্পষ্ট মেরুকরণ সম্পর্কে অনেক কিছু বলে দেয়। নামাজের পর স্বভাবতই মুসলিমরা স্থানীয় টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিল ঘিরে একটি রাজনৈতিক স্ক্যান্ডাল নিয়ে আলোচনা শুরু করে। টাওয়ার হ্যামলেটসের মেয়র লুতফর রহমানের বিরুদ্ধে জিহাদি গ্রুপগুলোর সঙ্গে যোগসূত্র এবং জাতিগত বিভক্তির এক শাসনব্যবস্থা পরিচালনা, নির্বাচনী জালিয়াতি এবং অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার অভিযোগ উঠেছে। এ অঞ্চলের এক তৃতীয়াংশ জনসাধারণ বাংলাদেশী যাদের জোরালো সমর্থনে মে মাসে মেয়র হিসেবে পুনর্নিবাচিত হন লুতফর রহমান। স্থানীয় সরকারের কনজারভেটিভ দলের মন্ত্রী এরিক পিকলস এপ্রিলে যে তদন্ত কর্মকর্তাদের পাঠিয়েছিলেন তারা ৪ঠা নভেম্বর রিপোর্ট ইস্যু করেছে। কাউন্সিলের কাছ থেকে অস্বীকৃতি এবং বিভ্রান্তি পেলেও তারা প্রমাণ পেয়েছে যে কাউন্সিল অনেক গ্রুপকে অর্থ দিয়েছে যেগুলো প্রধানত বাংলাদেশী বা সোমালীয়দের দ্বারা পরিচালিত। মি. পিকলস জানান, ৪ লাখ পাউন্ডের (৬ লাখ ৩১ হাজার ডলার) বেশি বিভিন্ন সংগঠনকে দেয়া হয়েছে যারা কোন কিছু পাওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। লুতফর রহমান এছাড়াও ঐতিহাসিক পপলার টাউন হলকে এমন একটি প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে দিয়েছেন যে প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট এক ব্যক্তি তাকে পুনর্নিবাচন জিততে সহায়তা করেছে। করদাতাদের অর্থ মেয়রের জন্য রাজনৈতিক প্রচারণায় ব্যয় করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলা ভাষার টিভি চ্যানেলগুলো যাদের সাংবাদিকরা তার গণমাধ্যম উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছে বলে বলা হচ্ছে। এসব অভিযোগ নিয়ে চাপ দেয়া হলে মেয়র যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তার সঙ্গে তথ্যপ্রমাণের কোন সঙ্গতি নেই। তার প্রশাসনে মৌলিক শাসন প্রক্রিয়া ভেঙে পড়েছে বলে উপসংহার টেনেছেন মি. পিকলস। আর এর দায়িত্ব কমিশনারদের হাতে তুলে দেয়ার পরিকল্পনা করছেন তিনি। এ হস্তক্ষেপে লুতফর রহমানের প্রথম আইনি চ্যালেঞ্জ হতাশাজনক বলে খারিজ করা হয়েছে। মেয়রের দাবি তিনি ভুল কিছু করেননি। এ পরিস্থিতি দুই ভাবে দুঃখজনক। ওয়েস্টমিনিস্টার বিকেন্দ্রীকরণের যে সরকার ব্যবস্থার জন্য চাপ দিচ্ছে সেক্ষেত্রে এটা নেতিবাচক। আর অন্য সমস্যাটা হলো, যে সময় ইসলাম নিয়ে ভয়ভীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমন একটি সময়ে বৃটিশ মুসলিমদের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য সহিংসতা। বৃটেনের সাড়ে চার লাখ বাংলাদেশীর অনেকে এটা নিয়ে বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন। বলতে গেলে আনুমানিক অর্ধেক সংখ্যক বাংলাদেশী লন্ডনে বাস করে। সবাই লুুতফর রহমানকে সমর্থন করেন তা নয়। তার পরও এটা বলতেই হয়, হোয়াইট চ্যাপেল রোডের নামাজ আদায়কারীদের কাছ থেকে তেমন ধারণা মেলেনি। যারাই চলনসই ইংরেজি বলতে পারেন তাদের প্রত্যেকেই মি. পিকলসের প্রচেষ্টার সমালোচনা করেন। তারা যুক্তি দেখান, মেয়র নিজে ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়েছেন এমন কোন প্রমাণ নেই। আর যদি তিনি তার কার্যালয় ব্যবহার করে তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের নিয়ন্ত্রণ করার কোন চেষ্টা করে থাকেন, সেটা রাজনীতি। আর মুসলিম হওয়ার কারণে তাকে আলাদা করে নিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। অনেকে বলছেন, তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বৃটেনের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর বিরুদ্ধে লড়ার সাহস দেখিয়েছেন বলে এমনটা করা হয়েছে। শুধুমাত্র একজন নামাজ আদায়কারী কানে কানে বললেন, লুতফর রহমানকে সম্ভবত আরও গুরুতর পরিস্থিতির উত্তর দিতে হতে পারে। এটা বলে তিনিই আবার বললেন, কিন্তু আমি হয়তো এমনটাই বলব, কেননা আমার চাচা লেবার পার্টি সংশ্লিষ্ট আর আমার প্রতিবেশীদের বেশির ভাগ ইহুদি। শ্বেতাঙ্গ নয় এমন বৃটিশরা ঐতিহাসিকভাবে লেবারদের যে সমর্থন দিয়েছে তা বুঝতে সাহায্য করে কেন তারা নিজেদেরকে একত্র করে আমেরিকান ধাঁচের যে জাতিগত ব্লক লুতফর রহমান গড়ে তুলেছেন সেখানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। ৮০’র দশকে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান অধ্যুষিত ব্রিক্সটন সহ লন্ডনে লেবার পার্টিতে জাতিহত কমিটি অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করা হয়। দ্রুতই দলের কেন্দ্রে ঢুকে পড়ে এ রীতি। দলের কতিপয় কৃষ্ণাঙ্গ এমপিদের বেশির ভাগেরই উত্থান হয় সফল পেশাদার হিসেবে, সফল কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে নয়। লেবারের ভোট যখন কমার পথে তখন আরও বিকেন্দ্রীকরণের প্রতিশ্রুতিতে উদ্বেগ বাড়ছে যে টাওয়ার হ্যামলেটসের জাতিগত রাজনীতির ব্রান্ড অন্যত্রও ছড়াতে পারে। তবে এটা হবে অতিরঞ্জিত ধারণা। কেননা বৃটেনের জাতিগত সম্প্রদায়গুলো প্রধানত নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কাজেই এটা সম্ভব নয়। মি. পিকলস যেভাবে শক্ত হাতে লুতফর রহমান প্রসঙ্গটি মোকাবিলা করেছেন, তা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রশংসা কুড়িয়েছে। এছাড়া এতে এ প্রতিশ্রুতিও মেলে যে, কেন্দ্রীয় সরকারকে যেভাবেই দেখা হোক না কেন তারা ক্ষমতার অপব্যবহার সহ্য করবে না। তার পরও সব থেকে বড় আস্থায় জায়গা বৃটিশ বাংলাদেশীরা নিজেরাই। দরিদ্রতা এবং সুশিক্ষার অভাবের কারণে যদি অনেকে মি. রহমানের রাজনীতি নিয়ে সন্দিহানও হন, তার পরও তাদের সন্তানেরা কিন্তু তা হবে না। উন্নত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং চরম আত্মবিশ্বাসের কারণে তাদের শিক্ষাগত নৈপুণ্য অনেক ওপরে ওঠার নজির দেখা গেছে। পরীক্ষায় পাশের হারের ভিত্তিতে ১৬ বছরের বাংলাদেশীরা দরিদ্র শেতাঙ্গ বৃটিশদের তুলনায় দ্বিগুণ ভাল করে থাকে। এমন উন্নতির সঙ্গে উচ্চাকাঙ্ক্ষা জন্মে। আর আত্মপরিচয়ের সংকীর্ণ রাজনীতিতে বৃদ্ধি পায় অসহনশীলতা। পূর্ব লন্ডনের ওই মসজিদের বাইরে উপস্থিত বাংলাদেশী অভিভাবকরাও তা স্বীকার করলেন। তাদের একজন বললেন, ‘আমাদের সন্তানেরা বাংলাদেশী রাজনীতিবিদদের নিয়ে আগ্রহী নয়। তারা বৃটিশ।’ এতে দুঃখজনক এক গল্পের আনন্দঘন সমাপ্তির প্রতিশ্রুতি মেলে। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি পূর্ব লন্ডনে এনে লুতফর রহমান স্রোতের বিপরীতে হাটছেন। লন্ডন আর তার নবীন, উৎসাহী নানা রঙয়ের নাগরিকেরা বৃটেনের ভবিষ্যৎ; তিনি ও তার সমর্থকরা অতীত।
সূত্র: ইকোনোমিস্ট থেকে নেয়া

লুতফুরের ওপেন চ্যালেঞ্জ
লন্ডন প্রতিনিধি জানান, বৃটিশ কমিউনিটিজ সেক্রেটারি এরিক পিকলসের প্রতি ওপেন চ্যালেঞ্জ দিয়ে টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের মেয়র লুতফুর রহমান বলেছেন, সাহস থাকলে পিকলস যেন পার্লামেন্টের বাইরে এসে বলেন, লুতফুর রহমান একজন মধ্যযুগীয় সম্রাট। তিনি পার্লামেন্টে দেয়া এরিক পিকলসের বক্তব্যকে মিথ্যা দাবি করে বলেন, পার্লামেন্টের ভেতরে বিশেষ সুবিধার সুযোগ নিয়ে এরিক পিকলস অডিট নিয়ে মিথ্যা বক্তব্য দিয়েছেন। বুধবার টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে এরিক পিকলসের হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে আয়োজিত ‘টাওয়ার হ্যামলেটসের গণতন্ত্র রক্ষা করো’ শীর্ষক এক সভায় মেয়র এসব কথা বলেন। পার্লামেন্টে বৃটিশ কমিউনিটিজ সেক্রেটারি এরিক পিকলসের টাওয়ার হ্যামলেটসকে পঁচা বারা ও মেয়র লুতফুর রহমানকে একজন মধ্যযুগীয় সম্রাট বলে মন্তব্য করেছেন।
মেয়র লুতফুর রহমান বলেন, ৫ মাস আগে টাওয়ার হ্যামলেটস মানুষ তাকে দ্বিতীয় মেয়াদে বারার নির্বাহী মেয়র হিসেবে নির্বাচিত করেছে। তিনিই একমাত্র এসব মানুষদের প্রতি জবাবদিহি হবেন; অন্য কারও কাছে নয়। তিনি  বলেন, বিশ্বের অন্যতম একটি শহর হলো লন্ডন। আর এই লন্ডনের প্রাণকেন্দ্রে তিনি একজন স্বতন্ত্র এবং মুসলিম মেয়র হিসেবে সফলভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। এটিই মূলধারার রাজনীতিক দলগুলোর জন্য সবচেয়ে বেশি বিব্রত হওয়ার কারণ হয়েছে। মেয়র বলেন, অডিট পরিচালনা করে তারা চেয়েছিল মেয়রকে সরিয়ে দিতে; কিন্তু তাদের সে আশা পূর্ণ হয়নি। তারা কোন দুর্নীতি খুঁজে পায়নি। পূর্ব লন্ডনের ওয়াটারলিলি হলে আয়োজিত সভায় লন্ডনের সাবেক মেয়র কেন লিভিংস্টোন, জর্জ গ্যালওয়ে এমপি, লেবার পার্টির ন্যাশনাল এক্সিকিউটিভ মেম্বার ক্রিসটিন শক্রফটসহ ২০ জন বক্তা বক্তব্য দেন।
সাবেক লন্ডন মেয়র কেন লিভিংস্টোন টাওয়ার হ্যামলেটসের নোংরা রাজনীতির জন্য তার নিজের দল লেবার পার্টিকে দায়ী করে বলেন, যখনই বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কেউ রাজনীতিতে উঠে আসতে যায়, তখনই লেবার পার্টি তাকে নানা ছলচাতুরির মাধ্যমে রাজনীতি থেকে বের করে দিয়েছে। একজন মুসলিম এবং অশ্বেতাঙ্গ মেয়র হওয়ার কারণে লুতফুর রহমান লেবার এবং টোরি পার্টির অশুভ ঐক্যের বর্ণবাদের শিকার হচ্ছেন বলে তিনি মন্তব্য করেন। তিনি পিকলসের কমিশনার নিয়োগের সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেন। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আইনি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে তিনি লুতফুর রহমানকে পরামর্শ দেন। এছাড়া যারা কমিশনার হয়ে টাওয়ার হ্যামলেটসে আসবে এবং যারা এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত তাদের বাড়ির ঠিকানা নিয়ে বাড়ির সামনে বিক্ষোভ করার পরামর্শ দেন লেবার দলীয় এ নেতা।
কেন লিভিংস্টোন এরিক পিকলসের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, কত সাহস তিন টাওয়ার হ্যামলেটসের নির্বাচিত মেয়রকে সরিয়ে কাউন্সিলের দায়িত্ব নিতে চান। দায়িত্ব নিতে চাইলে সাহস করে টাওয়ার হ্যামলেটসে এসে নির্বাচন করার জন্য পিকলসের প্রতি আহবান জানান তিনি।
জর্জ গ্যালওয়ে এমপি বলেন, টাওয়ার হ্যামলেটস হল একমাত্র বারা যেখানে সরকারি বাজেট কাটের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। শিক্ষার মান, ফ্রি স্কুল মিল চালু, হাউজিং ব্যবস্থা সহ প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। তিনি বলেন, লেবার পার্টি কখনও বাংলাদেশীদের রাজনীতিতে উঠতে দিতে চায়নি। ২০০৫ সালে তিনি টাওয়ার হ্যামলেটস এলাকার আসনে নির্বাচন করে এমপি হওয়ার পর লেবার পার্টি একজন বাংলাদেশীকে এমপি হিসেবে মনোনয়ন দিতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু টাওয়ার হ্যামলেটসের মানুষ ভুল এমপি পেয়েছে বলে মন্তব্য করেন গ্যালওয়ে। তিনি  লেবার দলকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলেন, আগামী পার্লামেন্ট নির্বাচনে টাওয়ার হ্যামলেটস ফার্স্ট অর্থাৎ লুতফুর রহমান যদি এমপি হিসেবে কোন প্রার্থী মনোনয়ন না দেন তাহলে তিনি রেসপেক্ট পার্টি থেকে প্রার্থী মনোনয়ন দেবেন।

No comments

Powered by Blogger.