বাংলাদেশের মালালা শ্রীপুরের সাহিদা আক্তার স্বর্ণা

অভাবের সংসারে পুত্রের আশায় পর পর পাঁচ কন্যাসন্তান জন্ম নেয়। পুত্রসন্তান জন্ম দিতে ব্যর্থ হওয়ায় পাঁচ কন্যাসন্তানের মাকে ‘অপয়া’ আখ্যা দিয়ে বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। কন্যাদের পড়ালেখার খরচ দিতে পারবেন না বলে বড় মেয়েকে বাল্যবিয়ে দেন। এরপর দ্বিতীয় ও তৃতীয় কন্যাকেও বাল্যবিয়ে দিয়ে বাবা চতুর্থ শিশুকন্যারও বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করেন। কিন্তু বাধ সাদে চতুর্থ কন্যা সাহিদা আক্তার স্বর্ণা। বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান তিনি। দু’দফা নিজের বাল্যবিয়ে ভেঙে গ্রামে আলোচনায় চলে আসেন স্বর্ণা। শুধু নিজের নয়, গ্রামের যেখানেই বাল্যবিয়ে সেখানেই ঝাঁপিয়ে পড়েন সাহিদা আক্তার স্বর্ণা। কখনও কন্যাশিশুর মা-বাবাকে বুঝিয়ে আবার কখনও বা তিনি শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি অথবা প্রশাসনের সহযোগিতায় ভেঙে দেন বাল্যবিয়ে। ৮ থেকে ১০ গ্রামের শিশুদের মধ্যে স্বর্ণা এখন সম্ভাবনার প্রতীক।
সাহিদা আক্তার স্বর্ণা গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার মাওনা ইউনিয়নের সিংদীঘি গ্রামের দরিদ্র তোতা মিয়ার কন্যা। নিজের অদম্য ইচ্ছার কাছে চরম দারিদ্র্যকেও হার মানিয়েছেন স্বর্ণা। তিনি গাজীপুরের ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। স্বর্ণার স্বপ্ন, দেশের অবহেলিত শিশু ও নারীদের পাশে দাঁড়ানো।সাহিদা আক্তার স্বর্ণা বর্তমানে প্ল্যান বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল শিশু সুরক্ষা দলের সদস্য ও যুব নারী সংঘের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন। ৭ অক্টোবর তিন দিনব্যাপী নরওয়ের অসলোতে অনুষ্ঠিত শিশু ও নারীবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনেও স্বর্ণা অংশ নেন। সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী ইর্না সোলবার্গ। সম্মেলনে স্বর্ণা তার জীবনের দুঃখগাথা তুলে ধরেন। একই সঙ্গে তার মতোই নিপীড়িত শিশুদেরও সচেতন করে সংগ্রামী করার গল্প শুনে প্রধানমন্ত্রী ইর্না সোলবার্গ তাকে বাংলার মালালা ইউসুফজাই বলে আখ্যা দেন।শুক্রবার সকালে সাহিদা আক্তার স্বর্ণার বাড়ি গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। পরে তার দেখা মিলল পাশের গ্রামে শিশুদের নিয়ে পরিচালিত ‘উঠোন বৈঠক’-এ। সাহিদা আক্তার স্বর্ণা জানান, তার বাবা তোতা মিয়া সাক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ। মা শরিফুন নেছা পড়ালেখা করেননি। তার বাবা সব সময়ে একটি পুত্রসন্তান কামনা করেছেন। কন্যাসন্তান ছিল অনাকাক্সিক্ষত। পুত্র সন্তানের আশায় এক এক করে পাঁচ কন্যাসন্তানের জন্ম হয়। পুত্রসন্তান জন্ম দিতে ব্যর্থ হওয়ায় তার মাকে অবর্ণনীয় নির্যাতন করতেন বাবা তোতা মিয়া। বোনদের সঙ্গেও চরম দুর্ব্যবহার করতেন তিনি। পড়ালেখার খরচ দিতে পারবেন না বলে তাদের শিশু বয়সেই বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ২০১০ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে এসএসসি পাস করেন স্বর্ণা। এরপর আবানও তাকে বিয়ে দিতে ওঠেপড়ে লাগেন তার বাবা। পোশাক কারখানার এক শ্রমিকের সঙ্গে তার বিয়ের দিনক্ষণও ঠিক করা হয়। এবার তার বাবার সঙ্গে যোগ দেন তার বড় ভগ্নিপতি। রাজি না হওয়ায় তার বাবা তাকে মারধরও করেন। কিন্তু তার অমতে বিয়ে দিলে তিনি আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি দেন। এতে পিছু হটেন তার বাবা ও ভগ্নিপতি। সাহিদা আক্তার স্বর্ণা আরও জানান, দু’দফা তিনি নিজের বিয়ে পণ্ড করায় গ্রামে নানা কথা রটে। কেউ বলেন, মেয়ের অন্য কারও সঙ্গে গভীর প্রেম রয়েছে। কেউ বা বলেন, এ কেমন জাতের মেয়ে!এরই মধ্যে প্রতিবেশী এক শিশুর বাল্যবিয়ের খবর জেনে স্বর্ণা ছুটে গিয়ে অভিভাবকদের বিয়ে বন্ধ করার অহ্বান জানান। এতে ব্যর্থ হওয়ার পর শ্রীপুর উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তাকে ঘটনা জানান স্বর্ণা। পরে উপজেলা মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তা বিলকিস নাহার পুলিশসহ ঘটনাস্থলে গিয়ে বাল্যবিয়ে বন্ধ করে দেন। এ ভাবে গ্রামে অগ্নিকন্যার ভূমিকা পালন করেন স্বর্ণা। স্বর্ণা জানান, এভাবে গ্রামে একের পর এক বাল্যবিয়ে পণ্ড করে দেন স্বর্ণা। গ্রামে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য সিংদীঘি গ্রামে শিশুদের নিয়ে গড়ে তোলেন ‘সূর্যমুখী শিশু ক্লাব’। পাশাপাশি তিনি অন্তর্ভুক্ত হন প্ল্যান বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনালের শিশু সুরক্ষা প্রকল্পে। প্ল্যান বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনালের উদ্যোগে ২০১২ সালে মাওনা ইউনিয়ন শিশু ফোরামের সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি।স্বর্ণা দৃঢ় আশা প্রকাশ করে জানান, তিনি শুধু তার ইউনিয়নেই নয়, সারা দেশে ঘরে-ঘরে শিশুদের সচেতনতা বাড়াতে কাজ করতে চান। বাল্যবিয়েসহ নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সারা দেশে বিপ্লব ঘটাতে চান।

No comments

Powered by Blogger.