সমুদ্র সৈকতে ভেজাল আচার by রাসেল চৌধুরী

কক্সবাজার শহরে ভেজাল আচার ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট এখন সক্রিয়। সমুদ্র সৈকতসহ শহরের বিভিন্ন মার্কেটে দেদার বিক্রি হচ্ছে ভেজাল আচার। এসব আচারের স্থায়িত্ব রক্ষার জন্য ব্যবহার হচ্ছে ক্ষতিকর ফরমালিন। শহরের বিভিন্ন বাসাবাড়িতে ভ্রাম্যমাণ কারখানা খুলে আচারের এ রমরমা বাণিজ্য চলছে। এ বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনের নজরে গেলেও কোন কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না। শহরের বার্মিজ মার্কেট, সৈকতের লাবণী, সুগন্ধা পয়েন্ট ও হোটেল-মোটেল জোন পরিদর্শন করে দেখা গেছে, অর্ধশতাধিক দোকানে ভেজাল আচার বিক্রি হচ্ছে। পর্যটকরা এসব আচার কিনে নিচ্ছেন। আকর্ষণীয় ও রঙিন মোড়কে আচারের প্যাকেটে মিয়ানমারের (বার্মিজ) ভাষা ও নায়ক-নায়িকার ছবি থাকায় অনেকে আগ্রহ নিয়ে আচার কিনছেন। কিন্তু প্যাকেট খুলে আচারের গুণমান নিয়ে হতাশ হন পর্যটকরা। এদিকে পর্যটন মওসুমকে কেন্দ্র করে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নেমেছে ভেজাল ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। সিন্ডিকেটের প্রধান ও ভেজাল আচার ব্যবসার কারিগর হিসেবে পরিচিত খাইরুল আমিনের নেতৃত্বে ব্যবসায়ীরা ইতিমধ্যে কয়েক দফা বৈঠক করেছেন। বৈঠকের সিদ্ধান্ত মতে, পর্যটন মওসুমে পুলিশি ঝামেলা এড়াতে থানা ও পুলিশ ম্যানেজ করা হয়েছে। এর সূত্র ধরে ভেজাল আচার ব্যবসার অন্যতম হোতা খাইরুল আমিনকে কয়েক দিন ধরে কক্সবাজার থানা ও ডিবি পুলিশ কার্যালয়ে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেছে। নির্ভরযোগ্য সূত্র জানা যায়, পর্যটকদের আগমনকে পুঁজি করে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী শহরের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে তুলেছে একডজন ভেজাল আচার তৈরির কারখানা। এসব কারখানায় খাওয়ার অযোগ্য পচা বরই, মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর কেমিক্যাল, গুড়, চিনি, রংসহ বিভিন্ন উপকরণ দিয়ে আচার তৈরি করা হয়ে থাকে। তাও তৈরি করা হচ্ছে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। সম্পূর্ণ অবৈধ কারখানাগুলোতে তৈরি ভেজাল আচার প্যাকেটজাত করা হয় স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত মিয়ানমার ভাষায় ছাপানো নকল প্যাকেটে। প্যাকেটে লাগানো হয় উৎপাদনের মেয়াদসংবলিত ভুয়া টিকিটও। এ ছাড়া লাগানো হয় মিয়ানমারের নকল লেবেল। সব প্রক্রিয়া শেষ করেই প্রতিদিন শহরের একডজন অবৈধ আচার তৈরির কারখানা থেকে বাজারজাত করা হচ্ছে লাখ লাখ প্যাকেট ভেজাল আচার। এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কক্সবাজার শহরের বাজারঘাটার জমজম মার্কেটে মন্নান, রাজু দাশ, বিডিআর ক্যাম্প এলাকায় মনু, বউ করিম, এনাম, ডিককুল এলাকায় আলী হোসেন, নেজাম, বাহারছড়া এলাকায় খাইরুল আমিন, জাহাঙ্গীর, চরপাড়ার ফদনার ডেইল এলাকায় জসিম, বায়তুশ শরফ রোডের শরীফ, লাইট হাউসপাড়ায় মো. মহিব উল্লাহ, খুরুশকুল কুলিয়াপাড়ায় ছুরত আলম, লারপাড়া এলাকায় রহিম, ফরহাদ, ইউনুছ, আজিম, পেশকারপাড়ায় জালাল, কবরস্থানপাড়ায় হাফেজ, বাংলাবাজার এলাকায় নবী, রামু উপজেলার ফকিরা বাজারে সালাউদ্দিন, সজীতসহ একডজনের বেশি কারখানায় তৈরি হচ্ছে ভেজাল আচার। আর ভেজাল আচার বাজারজাত ও গুদামজাত করছে দুটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এর মধ্যে একটি সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন শহরের বাজারঘাটা এলাকার আচার ব্যবসায়ী মাহবুব, শহিদ, আল কালাম, জালাল, ছুরত আলম, সালাহ উদ্দিন, ফরহাদ, ইউনুছ ও আমিন। অপর সিন্ডিকেটটি নিয়ন্ত্রণ করেন বাজারঘাটার মসজিদ রোডের আচার ব্যবসায়ী সজীব, উজ্জ্বল, এনাম, আলী, নেজাম, আনোয়ার, হাফেজ, আজিম ও ছুরত আলম। উভয় সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রক হিসেবে রয়েছেন ভেজাল আচার ব্যবসার কারিগর খাইরুল আমিন। প্রশাসন ম্যানেজের দায়িত্বও তার। এ জন্য তিনি প্রতি মাসে ১০ লাখ টাকা পেয়ে থাকেন। এ টাকার তিন ভাগের এক ভাগ ম্যানেজ প্রক্রিয়ায় খরচ হলেও বাকি টাকা তার পকেটস্থ হয়। এ ছাড়া বাড়তি সুবিধা হিসেবে তিনি জনপ্রতি ভেজাল আচার ব্যবসায়ী থেকে পরিমাণমতো আচার পেয়ে থাকেন। এ আচার তিনি ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করে থাকেন। আবার কোন আচার ব্যবসায়ী চাহিদামতো বা সময়মতো আচার সরবরাহ দিতে না পারলে তাদের ওপর নেমে আসে ভয়াবহ দুর্যোগ। পুলিশ পাঠিয়ে তাদের ধরিয়ে দেয়ার মতো ঘটনাও করে থাকেন তিনি। অভিযোগ রয়েছে, এসব আচার তৈরি, বাজারজাতকারী সিন্ডিকেটের কাছ থেকে মাসিক মাসোয়ারা পাচ্ছে, এক শ্রেণীর সংবাদকর্মী, কক্সবাজার সদর মডেল থানা, ডিবি, ডিএসবি, শহর ফাঁড়ি, ট্যুরিস্ট পুলিশ, পরিবেশ অধিদপ্তর, সেনেটারি ইন্সপেক্টরসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু অসাধু সদস্য। নেপথ্যে থেকে তারা এসব ভেজাল কারখানা চালু রাখতে সহায়তা করছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। শহরের বার্মিজ মার্কেট এলাকার এক আচার ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, দীর্ঘ দুই যুগ ধরে আচারের ব্যবসা করে এলেও এখন আচার কিনে গ্রাহকরা স্বস্তি পাচ্ছেন না। সর্বত্র ভেজাল ছাড়া আর কিছুই নেই। দেশ-বিদেশ থেকে আগত পর্যটকরা ভেজাল আচার কিনে প্রতারিত হচ্ছেন। সমুদ্র সৈকতের এক আচার ব্যবসায়ী জানান, নাজিম নামের এক ব্যবসায়ী আচার উৎপাদনের অনুমোদন নিয়ে একাধিক ভেজাল আচার তৈরির কারখানা করে। তাদের উৎপাদিত ভেজাল আচার বার্মিজ আচারের নাম দিয়ে নাজিমের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানে বিক্রি হচ্ছে। এতে বাজারজাতকরণের দায়িত্ব পালন করে চলেছে খাইরুল আমিন। বিগত সময়ে ভেজাল আচারসহ গ্রেপ্তার হলেও এখন ভেজাল আচার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছে সেই খাইরুল আমিন। খাইরুল আমিন সাংবাদিকদের বলেন, তিনি ভেজাল ব্যবসায়ী নন। তিনি পর্যটনের উন্নয়নে কাজ করছেন। বলেন, তিনি মূলত নাজিম ফুড প্রোডাক্টের আচার বিক্রি করেন। তবে এ আচার কোথায় এবং কিভাবে তৈরি হয় তার জানা নেই। কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তোফাইল আহম্মদ বলেন, কক্সবাজারে কোন অবস্থায়ই ভেজাল আচারসহ ভেজাল খাদ্য বিক্রি ও তৈরি করতে দেয়া হবে না। এ বিষয়ে পুলিশ সবস ময় সতর্ক রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.