বাংলাদেশের ভাসমান খামার

পাবনার চরভাঙ্গুরা গ্রামে প্রায় ২৫০০ মানুষের বসবাস। প্রতিবছর বর্ষাকালে গুমানি নদী এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায় বিস্তীর্ণ এলাকা। জুলাই থেকে অক্টোবর মাসে প্রায় ১০ ফুট বেড়ে যায় পানির উচ্চতা। ফসলের মাঠ জুড়ে তখন কেবলই পানি। এ সময় বেকার হয়ে পড়েন গ্রামের কৃষকরা। এ অঞ্চলে সমপ্রতি চালু হয়েছে ভাসমান চাষপদ্ধতি। পানির উপরই ভাসমান অবস্থায় চাষ করা হয় বিভিন্ন সবজি, কিংবা ভাসমান খামারে পালন করা হয় হাঁস-মুরগি। বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় এ ধরনের চাষপদ্ধতি খুবই কার্যকর। পাবনা জেলার চরভাঙ্গুরা গ্রামের কৃষকদের এমন চাষপদ্ধতি নিয়ে লেখা হয়েছে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে। তাতে এ চাষপদ্ধতিকে নাম দেয়া হয়েছে ‘বাংলাদেশের ভাসমান খামার’। হাফিজা খাতুন (২৫) নামের একজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, বর্ষাকালে কেবল পানি আর পানি। হাফিজা খাতুনের ২ সন্তান রয়েছে। তাদের পারিবারিক উপার্জনের একমাত্র পথ বছরের প্রায় ৬ মাসই একেবারে বন্ধ থাকে। কেননা, জুলাই থেকে অক্টোবর মাসে তার চাষী স্বামীর কোন কাজ থাকে না। কিন্তু তিন বছর আগে শিধুলাই স্বনির্ভর সংস্থা নামের একটি এনজিও’র কাছ থেকে প্রশিক্ষণ লাভ করেন তিনি। খাদ্য ও আয়ের জন্য ভাসমান খামার নামে ব্যতিক্রমী এক ধরনের পদ্ধতির প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন। এ পদ্ধতিতে হাঁস-মুরগি পালন, মাছ চাষ, সবজি বাগান করা সম্ভব পানির ওপরই। ৫ থেকে ১০ জন নারী মিলে একটি ভাসমান খামার করতে পারেন। প্রতিবছর খরচ হয় প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। শিধুলাই স্বনির্ভর সংস্থা থেকে জোগান দেয়া হয় বীজ, মাছ, হাঁসের খাদ্য ও বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিস। এর জন্য খরচ পড়ে ১০ হাজার টাকা। এ অর্থই চরভাঙ্গুরার মতো গ্রাম্য জনপদে ভালো আয়ের পথ খুলে দেয়। হাফিজা খাতুন পড়ালেখা করতে পারেন নি। এছাড়া, অল্প বয়সে দু’ সন্তান নিয়ে শারীরিকভাবেও ছিলেন কিছুটা দুর্বল। তার প্রথম সন্তান হয়েছিল মাত্র ১৫ বছর বয়সে। এর আগে কখনই আয় বর্ধনমূলক কিছুই করেননি তিনি। বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চল জলবায়ু পরিবর্তনের বিরাট ঝুঁকিতে রয়েছে। এর ফলে বন্যার ভয়াবহতা ও স্থায়িত্বও এখন দীর্ঘ হয়। বন্যার সময় এ ধরনের ভাসমান খামার হয়ে উঠতে পারে বন্যা-উপদ্রুত অঞ্চলের মানুষের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। শিধুলাই স্বনির্ভর সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজওয়ান বলেন, জলবায়ু আক্রান্ত এলাকার জন্য এ ধরনের সমাধান খুব জরুরি। ওদিকে হাফিজা খাতুন ডিম, মাছ ও সবজি বিক্রির অতিরিক্ত অর্থ ব্যাংকে জমা রাখতে শুরু করেন। জমানো অর্থ দিয়ে নিজের পরিবারের জন্য কিনলেন খাট। প্রশিক্ষণের আগে কখনওই হাঁস বা মাছ চাষ করেননি তিনি। কিন্তু তার ভাষায়, ‘কোন কিছুই কঠিন ছিল না’। হিমালয়ের তুষার গলার কারণে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষিজমি প্রায়ই বন্যায় আক্রান্ত হয়। এছাড়া, মওসুমি বৃষ্টি তো রয়েছেই। তখন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ঘনবসতিপূর্ণ এ দেশটিতে হাজার হাজার মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে। অনেকেই শহরে পাড়ি জমায়। ১৯৯৮ সালে ভয়াবহ বন্যায় এ দেশে প্রায় ৭০০ মানুষ মারা যায়, ২ কোটি ১০ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। এ সময়েই স্থাপত্যে স্নাতক ২২ বছর বয়সী রেজওয়ান গড়ে তোলেন শিধুলাই স্বনির্ভর সংস্থা। প্রাথমিক পর্যায়ে রেজওয়ান নৌকায় স্কুল বানাতেন। বছরের অর্ধেক সময় পানিতে ডুবে থাকা রাস্তার কারণে এ অঞ্চলের হাজারো শিশু স্কুলে যেতে পারতো না। রেজওয়ানের তখনকার প্রচেষ্টা ছিল, এ শিশুরা যাতে লেখাপড়ায় পিছিয়ে না পড়ে, তা নিশ্চিত করা। তার অলাভজনক সংস্থা শিধুলাই এ পর্যন্ত ২২টি স্কুল, পাঁচটি স্বাস্থ্য ক্লিনিক, ১০টি পাঠাগার নির্মাণ ও অন্যান্য সেবা দিচ্ছে। এর দ্বারা মওসুমি বন্যায় আক্রান্ত বিভিন্ন গ্রামের প্রায় ৭০ হাজার শিশু উপকৃত হয়েছে। চার বছর আগে এ সংস্থা ভাসমান খামার নির্মাণে গ্রামবাসীদের সহায়তা দিতে থাকে। বন্যার সময় যাতে ভূমিহীন মানুষদের আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে না পড়ে, সে জন্য এ প্রচেষ্টা হাতে নেয় শিধুলাই। এখন পর্যন্ত ৩০০ গ্রামীণ মহিলার জন্য ৪০টি ভাসমান খামার নির্মিত হয়েছে শিধুলাইয়ের উদ্যোগে। রেজওয়ান চান, আগামী কয়েক বছরে ৪০০টি ভাসমান খামারের মাধ্যমে উপকৃত হবে ৩০০০ নারী ও তাদের পরিবার। তিনি বলেন, ভাসমান খামার ও স্কুলের ধারণার মাধ্যমে বন্যায় আক্রান্ত হওয়া অন্যান্য দেশের জন্যও অনুকরণীয় হতে পারে। শিধুলাইয়ের ‘স্কুল বোট’ বা ভাসমান নৌকায় স্কুলের ধারণা ফিলিপাইন, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, নাইজেরিয়া ও জাম্বিয়াতে প্রয়োগ করা হয়েছে। রেজওয়ান জানালেন, ভাসমান খামারের প্রাথমিক ধারণাটি তিনি পান দেশের দক্ষিণাঞ্চলে শত শত বছর ধরে চলে আসা ভাসমান বাগান পদ্ধতি দেখে। সেখানে বাঁশের কাঠামোর উপর কচুরিপানা রেখে এক ধরনের কৃত্রিম মাটির ছোটোখাটো দ্বীপের মতো বানানো হয়। এরপর সেখানেই চাষ করা হয় বিভিন্ন ফসল। তবে উত্তরাঞ্চলে এ পদ্ধতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। কেননা, এ অঞ্চলে কচুরিপানা খুব একটা পাওয়া যায় না। এছাড়া, অতিবৃষ্টির ফলে প্রায়শই ধ্বংস হয়ে যেত বাগান। ফলে কিছুটা আধুনিকায়ন করে একে উত্তরাঞ্চলের আবহাওয়া উপযোগী করে তৈরি করা হয়। আর এখন যে কেউ গোটা ভাসমান খামারের কাঠামো তৈরি করতে পারেন মাত্র ২০ হাজার টাকায়।

No comments

Powered by Blogger.