বর্ষা ও নোভার নিঃসঙ্গতা by আহমেদ মুনির

২০ থেকে ২৫ ফুট লম্বা একটা খাঁচা। তার ভেতরে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে বর্ষা ও নোভা। তাদের ক্রুদ্ধ গর্জনে কান পাতাই দায়। লোহার বেষ্টনীতে মাঝেমধ্যে ধাক্কাও দিচ্ছে তারা। আবার ক্ষণে ক্ষণে পরস্পরকে আক্রমণ করছে। খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার জন্য নয়, সঙ্গীর জন্য এমন আর্তি নোভা ও বর্ষার।
বর্ষা ও নোভা চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় জন্ম নেওয়া দুটি সিংহী। বয়স এরই মধ্যে নয় পেরিয়ে গেছে এই দুই বোনের। এখনো পুরুষ সঙ্গীর দেখা পায়নি তারা। প্রকৃতির স্বাভাবিক চাহিদা ও মাতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে প্রতি ২১ থেকে ২৩ দিন পর পর সিংহী দুটির আচরণে পরিবর্তন আসে। এ সময় খাবারও মুখে তোলে না তারা। একটানা ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত তাদের এই রূপ থাকে।
২০০৫ সালের ১৬ জুন জন্ম বর্ষা ও নোভার। জন্মের কিছুদিন পর তাদের মা লক্ষ্মী এবং ২০০৮ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাবা রাজ মারা যায়। এর পর থেকে চিড়িয়াখানাটিতে সিংহ বলতে নোভা ও বর্ষাই। প্রাণিবিদদের মতে, চার বছর বয়সেই একটি সিংহ বয়ঃপ্রাপ্ত হয়। সে হিসাবে পাঁচ বছর ধরে সঙ্গীর অভাব বোধ করছে নোভা ও বর্ষা।
চিড়িয়াখানা সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৯ সালে যাত্রা করা ৪ দশমিক ৯৭ একর জায়গার চিড়িয়াখানাটি জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। ব্যয় মেটানো হয় প্রধানত দর্শনার্থীদের কাছ থেকে পাওয়া অর্থে। কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন ১৯ জন। নানা ব্যক্তির অনুদানে গড়ে উঠেছে বলে প্রাণীদের জন্য খাঁচাগুলো তৈরি হয়েছে অবৈজ্ঞানিকভাবে। পশুগুলোও এসেছে ব্যক্তিবিশেষের অনুদান থেকে। তাই নোভা ও বর্ষার বসবাসের খাঁচাটাও আঁটসাঁট।
চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার প্রাণী চিকিৎসক শাহাদাত হোসাইনের কণ্ঠে প্রকাশ পেল সেই হতাশাই। তিনি বলেন, ‘সর্বশেষ গত ২০ সেপ্টেম্বর পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছে পুরুষ সিংহসহ বেশ কিছু প্রাণী চেয়ে। চিড়িয়াখানার ভালুকটিও নিঃসঙ্গ। তার জন্যও সঙ্গী চেয়েছি। কিন্তু চিঠির উত্তর মেলেনি।’
আক্ষেপ করে শাহাদাত হোসাইন বলেন, সিংহী দুটির এই যন্ত্রণা আর সহ্য হয় না। একেবারে দিতে না পারলে সরকার অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও ডুলাহাজারা সাফারি পার্ক বা অন্য কোথাও থেকে সিংহ পাঠাতে পারে। তাতে নোভা ও বর্ষার অন্তত মাতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা পূরণ হবে।
৫ নভেম্বর দুপুরে চট্টগ্রামের ফয়’স লেক এলাকায় অবস্থিত চিড়িয়াখানাটিতে গিয়ে দেখা যায়, নোভা ও বর্ষাকে খাবার দিচ্ছেন পরিচর্যাকারী মো. ইদ্রিস। তিনি জানালেন, টানা কয়েক দিন চিৎকার-চেঁচামেচি করে তারা। পশু দুটির এমন কষ্ট তিনি তো বটেই, চিড়িয়াখানার কোনো কর্মীই সহ্য করতে পারেন না।
এদিকে প্রাণীদের এভাবে অন্তরীণ রেখে সঙ্গী থেকে বঞ্চিত করা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী বলে মত দিয়েছেন প্রাণী বিশেষজ্ঞরা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মো. আল আমীন জানালেন, বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারের বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন ১৯৭৪-এর পরিপন্থী। তিনি আরও বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে সঙ্গীহীন অবস্থায় থাকায় বর্ষা ও নোভার আচরণগত পরিবর্তন হতে পারে। তারা এখন যন্ত্রণাকাতর অবস্থা পার করছে। যত দ্রুত সম্ভব এর অবসান হওয়া উচিত।

No comments

Powered by Blogger.