মহানগর বিএনপি পুনর্গঠনে বেকায়দায় মির্জা আব্বাস

কমিটি পুনর্গঠন নিয়ে চরম বেকায়দায় ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মির্জা আব্বাস। বেঁধে দেয়া দিনক্ষণের দ্বিগুণ সময় পেরিয়ে গেলেও এখনও অর্ধেক কাজও শেষ করতে পারেনি আব্বাস নেতৃত্বাধীন আহ্বায়ক কমিটি। ৪ মাসের বেশি সময়ে এ পর্যন্ত ৫৬টি ওয়ার্ড ও একটি থানা কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি গঠনে ধীরে চলো নীতি অনুসরণ করায় নেতাকর্মীদের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে চাপা ক্ষোভ ও হতাশা। কমিটি নিয়ে ধীরে চলো নীতি এবং পকেট কমিটি বানানোর বিষয়ে খালেদা জিয়ার কাছে নানা মাধ্যমে অভিযোগ আসে। এ ব্যাপারে সম্প্রতি স্থায়ী কমিটির বৈঠকে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও আব্বাসের ওপর চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আহ্বায়ক হয়েও কমিটি গঠনে এখন পর্যন্ত কোনো থানা বা ওয়ার্ডে যাননি মির্জা আব্বাস। এমনকি শ্যামপুর থানার দায়িত্ব খোদ আব্বাসের হলেও ৪ মাসে কোনো কর্মিসভা করেননি তিনি। দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা কিভাবে কমিটি করছেন সেদিকেও কোনো নজর নেই তার। কোনো তদারকি না থাকায় নানা সুবিধা পেয়ে দায়িত্বপ্রাপ্তরা পকেট কমিটি বানাচ্ছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। ইতিমধ্যে যেসব কমিটি গঠন করা হয়েছে তার একটিও কাউন্সিলের মাধ্যমে হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে আব্বাসের প্রতি মহানগর নেতাকর্মীদের আস্থা দিন দিন কমে যাচ্ছে। মহানগরের অনেক নেতা প্রকাশ্যেই আব্বাসের কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করছেন। মির্জা আব্বাসকে আহ্বায়ক ও হাবিব-উন-নবী খান সোহেলকে সদস্য সচিব করে ১৮ জুলাই ঢাকা মহানগর বিএনপির নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। তাদের ১ মাসের মধ্যে সব ওয়ার্ড ও থানা কমিটি এবং ২ মাসের মধ্যে মহানগরীর পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল যুগান্তরকে বলেন, কমিটি পুনর্গঠনে ধীরগতি এটা বলা যাবে না। নানা সংকটের মধ্যেও তারা কাজ করে যাচ্ছেন। কাজের অগ্রগতি চেয়ারপারসনকে নিয়মিত অবহিত করা হচ্ছে। চেয়ারপারসনও দ্রুত কমিটি শেষ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আগামী মাসের মধ্যে পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শেষ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর ৪৯টি থানা ও ১০০টি ওয়ার্ড এবং বেশ কয়েকটি ইউনিয়ন পুনর্গঠনের লক্ষ্যে ১৫টি টিম গঠন করা হয়। গত ঈদুল আজহার আগে সব ওয়ার্ড কমিটি শেষ করার নির্দেশনা দেয়া হয়। কিন্তু ১ মাসের বেশি সময় ঈদ পেরিয়ে গেলেও তা শেষ করতে পারেনি। সূত্র জানায়, কমিটি গঠনের পর সদস্য সচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেলকে নিয়ে চরম দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন মির্জা আব্বাস।
সাদেক হোসেন খোকা অনুসারীরা সোহেলকে সামনে রেখে আব্বাসের বিরুদ্ধে একটি বলয় গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। কিন্তু সোহেল এই মুহূর্তে কোনো পক্ষের হয়ে কাজ না করার সিদ্ধান্ত নেন। ফলে কৌশল পরিবর্তন করেন খোকা অনুসারীরা। যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন খোকার পরামর্শে সোহেলকে বাদ দিয়ে যারা আছেন তাদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার নির্র্দেশ দেন। যে কোনো ভাবে মহানগরের বিভিন্ন ওয়ার্ড ও থানা কমিটিতে নিজস্ব লোকদের আনার নির্দেশ দেন খোকা। তার নির্দেশে কাজ শুরু করেন খোকা সমর্থকরা। ইতিমধ্যে যেসব কমিটি গঠন করা হয়েছে এর বেশির ভাগেই খোকা অনুসারীরা স্থান পেয়েছেন বলে জানা গেছে।
সূত্র জানায়, কমিটি ঘোষণার পর আব্বাসের একক নিয়ন্ত্রণ থাকলেও তা এখন নেই। সবকিছুই নেতাকর্মীদের ওপর চাপিয়ে দিতে পারছেন না। প্রথমে তার বক্তব্যে কেউ প্রতিবাদ না করলেও দিন যত যাচ্ছে তার নেতৃত্ব ততটা দুর্বল হয়ে পড়ছে। সম্প্রতি তার শাহজাহানপুরের বাড়িতে অনুষ্ঠিত মোহাম্মদপুর-আদাবর থানা নেতাদের কর্মিসভায় তার উপস্থিতিতেই হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে। আমি যেভাবে চাইব সেভাবেই কমিটি হবে- ওই সভায় মির্জা আব্বাসের এমন বক্তব্য দেয়ার সময় প্রতিবাদ করেন খোকা অনুসারী কয়েকজন নেতা। তারা বলেন, বিগত সময়ে যারা মাঠে ছিলেন তাদের দিয়ে আন্দোলনমুখী কমিটি করতে হবে। আব্বাসের বক্তব্যের প্রতিবাদ করায় যুবদলের দুই নেতাকে বহিষ্কার করা হয়। এ নিয়ে খোকা অনুসারীদের মাঝে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। সূত্র জানায়, কমিটি গঠনের পর টিমগুলো ঢিলেতালে শুরু করে তাদের কার্যক্রম। যেসব ওয়ার্ডে কোন্দল কম সেখানকার নেতাকর্মীদের নিয়ে কমিটি পুনর্গঠন করা হয়। যেসব থানায় কোন্দল জটিল সেখানে যেতেই সাহস পাচ্ছেন না অনেকে। বিশেষ করে সাবেক আহ্বায়ক সাদেক হোসেন খোকার এলাকা হিসেবে পরিচিত পুরনো ঢাকায় এখনও কোনো প্রস্তুতি সভা হয়নি।
সূত্র জানায়, যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন খোকা তার সমর্থকদের মাধ্যমে জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি দেশে না ফেরা পর্যন্ত যেন তার এলাকায় কোনো কমিটি গঠন করা না হয়। তার এমন নির্দেশে ওইসব এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা সেখানে যেতে সাহস পাচ্ছেন না। একই অবস্থা সাবেক সংসদ সদস্য নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টুর এলাকায়ও। জেলখানা থেকে সম্প্রতি আব্বাসের উদ্দেশে তিনি সংক্ষিপ্ত এক চিঠি লিখেছেন। সেখানে বলা হয়েছে আব্বাস ভাই, সালাম নিবেন, আমার এলাকায় আমার লোকজনের দিকে একটু খেয়াল রাইখেন। পিন্টুর এমন চিঠিকে হুমকি হিসেবেই নিয়েছেন মহানগর নেতারা। লালবাগ, হাজারীবাগসহ পিন্টুর এলাকায় তার নিজস্ব লোকের বাইরে কমিটি করা আদৌ সম্ভব হবে না। এ নিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্তরা পড়েছেন বিপাকে। এছাড়া বংশাল, যাত্রাবাড়ী, শ্যামপুরসহ আরও কয়েকটি থানায় এখন পর্যন্ত কোনো কর্মিসভা করা হয়নি। এমন বাস্তবতায় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেন খালেদা জিয়া। ১৫ নভেম্বর মহানগর নেতাদের নিয়ে খালেদা জিয়ার কাছে যান মির্জা আব্বাস। মহানগর পুনর্গঠনের সার্বিক চিত্র তাদের দিয়ে খালেদা জিয়াকে অবহিত করেন। ইতিমধ্যে ৫৬টি ওয়ার্ড কমিটি গঠন শেষ হয়েছে জানানো হলেও তিনি বলেন এগুলো কেন ঘোষণা করা হচ্ছে না। আব্বাস এ সময় বলেন, সব ওয়ার্ড একসঙ্গে করে ঘোষণা করা হবে। যাতে বিদ্রোহ হলে একসঙ্গে সামাল দেয়া যায়। খালেদা জিয়া বলেন, যদি প্রতিটি ওয়ার্ডে ৫ জন করে বিদ্রোহ করে তবে ১০০ ওয়ার্ডে সে সংখ্যা দাঁড়াবে ৫০০ জন। এত লোক একসঙ্গে বিদ্রোহ করলে কিভাবে সামাল দেবে। তার চেয়ে বরং যেসব কমিটি পুনর্গঠন হয়েছে সেগুলো ঘোষণা করে দেয়াই ঠিক হবে। খালেদা জিয়ার এমন পরামর্শের পর পুনর্গঠিত ওয়ার্ড কমিটিগুলো ঘোষণার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে এসব কমিটি ঘোষণা করা হতে পারে বলে মহানগরের কয়েকজন নেতা জানান। এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে শিগগিরই মহানগরের জরুরি সভা ডাকা হতে পারে।
এই বিষয়ে মহানগরের সদস্য আতিকুল ইসলাম মতিন যুগান্তরকে বলেন, ম্যাডাম এলাকায় গিয়ে কমিটি করার নির্দেশ দিলেও অনেকেই তা মানছেন না। তাদের কার্যক্রমে মনে হচ্ছে তারা পকেট কমিটি বানাতে চাচ্ছেন। তিনি বলেন, তার এলাকার নেতাকর্মীদের নিয়ে মহানগর আহ্বায়ক মির্জা আব্বাসের বাসায় বৈঠক হলেও সেখানেও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। আহ্বায়কের সামনে এমন ঘটনা খুবই দুঃখজনক। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত না করে উল্টো তার দুই নেতাকে বহিষ্কার করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.