মায়েরা যে ভুল করেছেন সেটি আমরা করবো না by সালমান ফরিদ

বিপ্লব ঘটছে শিশুপুষ্টি ধারণায়। কয়েক দশক আগে জন্মের পর নবজাতকের মুখে দেয়া হতো পানি কিংবা মধু। এখন তাকে প্রথমেই খাওয়ানো হচ্ছে মায়ের বুকের শালদুধ। শুধু তাই নয়, জন্মের পর ৬ মাস পর্যন্ত বুকের দুধ ছাড়া অন্য কিছুই যে খাওয়ানো যাবে না- এটি এখন জানেন শহরের অভিজাতপাড়া থেকে গ্রামের কৃষকের অক্ষরজ্ঞানহীন গিন্নিও। সর্বত্র এই ধারণার বিপ্লব ঘটাতে সরকারের পাশাপাশি ভূমিকা রাখছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও। তবে এ অর্জনের পাশাপাশি শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো নিয়ে এখনও যথেষ্ট অসেচতনতা রয়ে গেছে শহর ও গ্রামে। কেউ জেনে, কেউ বা না বুঝে এড়িয়ে যাচ্ছেন বিষয়টিকে। এর প্রমাণও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর ব্যাপারে অপরের চেয়ে মায়েদেরই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। নিজের সন্তানের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত রাখতে বুকের দুধের বিকল্প ভাবনা থেকে সরে আসতে হবে তাদের। অবশ্য এটি যে একেবারেই জানেন না গ্রামের সহজ সরল মায়েরা, তা কিন্তু নয়। সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার মজলিশপুরের এক মাস বয়সী তানিশার মা রীনা বেগম (২৫) এখন জানেন জন্মের প্রথম ৬ মাস শিশুর মুখে পানি পর্যন্তও দিতে হয় না। মায়ের বুকের দুধই যথেষ্ট। যদিও তারই মা জরিফুল বেগম রীনার জন্মের পরপর তার মুখে দিয়েছিলেন মধু। অথচ সেই জরিফুল নাতনির জন্মের পর তার মুখে দিয়েছিলেন শালদুধ। ‘আমি জানি, যা আগে জানতাম না। জন্মের পর নবজাতককে শালদুধ দিতে হয়’- বললেন তিনি। জরিফুল বলেন, আমি মনে করতাম শিশুদের বুঝি খালি বুকের দুধে পেট ভরবে না। তাই আমার সন্তানদের জন্মের পর বুকের দুধের পাশাপাশি অন্য খাবারও খাইয়েছি। এখন বুঝতে পেরেছি, এই ধারণা ছিল ভুল। রীনা বলেন, আমাদের মায়েরা যে ভুল করেছেন আমরা সেটি করবো না। একই গ্রামের সুমী বেগমও তার ৩ সন্তানকে ৬ মাস বুকের দুধ ছাড়া আর কিছুই খাওয়াননি। এখন তার ৪ মাসের সন্তান আমিনা ইসলাম মনিকেও তাই করছেন। তিনি এই ধারণা অর্জনের জন্য বেসরকারি সংস্থার কৃতিত্ব দেন। বলেন, পড়াশোনা না শিখলেও ব্র্যাকের স্বাস্থ্যকর্মীরা সব জানিয়ে দিয়েছেন। তাদের কাছ থেকেই শিখেছি, কিভাবে শিশুর মুখে নিপল ধরতে হয়, কিভাবে দুধ খাওয়াতে হয়, এমনকি দুধ বাড়াতে কি খেতে হয়; তাও। সেই স্বাস্থ্যকর্মীদের পরামর্শে গর্ভবতী মা রুবিনা বেগমও (২২) সে রকম প্রস্তুতি নিয়েছেন। স্বাস্থ্যসেবিকার কথামতো প্রথম সন্তানকে লালন-পালনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছেন। এ অঞ্চলে ব্র্যাক শিশুপুষ্টি ও মাতৃদুগ্ধ নিয়ে কর্মসূচি পালন করছে। এ জন্য মায়েরা আরও বেশি সচেতন হচ্ছেন। ব্র্যাকের স্বাস্থ্যপুষ্টি ও জনসংখ্যা কর্মসূচির প্রোগ্রাম হেড রাইসুল হক বলেন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে আমাদের স্বাস্থ্যকর্মী ও স্বাস্থ্য সহকারীরা সচেতন করছেন। জন্মের ১ ঘণ্টার মধ্যে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো এবং ৬ মাস পর্যন্ত বুকের দুধ ছাড়া আর কিছু না খাওয়াতে নিরুৎসাহিত করি। এছাড়া কখন-কিভাবে শিশুকে খাওয়াবেন তার একটি দিকনির্দেশনাসহ পুষ্টি বাটিও দেয়া হয় তাদের। জানার পরিধি বাড়াতে এবং অন্যকে সচেতন করতে স্টিকার, লিফলেট, পোস্টার দেয়া হচ্ছে। গর্ভবতী মা ও শিশুর বাড়িতে নম্বর দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই কিশোর ফোরাম গঠন করে বৈঠক করা হয় নিয়মিত।
তবে এর মাঝেও কেউ কেউ নবজাতককে বুকের দুধ না খাইয়ে খাওয়াচ্ছেন অন্য খাবার। একই উপজেলার গোয়ালা বাজারের দত্তগ্রামের দিনমজুর ঝর্না বেগম ৮ মাসের সন্তান ফাতেমা বেগমকে ৪ মাস বয়স থেকে বুকের দুধের পাশাপাশি খাইয়েছেন পানি, সুজি, চালের গুড়া, খিচুড়ি কলা। ‘কাজের কারণে বাইরে থাকতাম বলে সব সময় বুকের দুধ খাওয়ানো সম্ভব হতো না। আর গরিব বলে ভাল খেতে পারতাম না। বুকে দুধও হতো না। তাই ঘরে থাকা শিশুকে অন্য খাবার খাওয়াতে হতো’- জানালেন তিনি। বলেন, চিকিৎসকও ‘উপায় না থাকলে’ বিকল্প খাবারের পরামর্শ দিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সচেতনতা বাড়ছে। তবে মাতৃদুগ্ধের বিষয়ে এখনও পুরোপুরি সফলতা আসেনি। তারা এ জন্য বিকল্প মাতৃদুগ্ধের নামে শিশুখাদ্য নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। এ জন্য ‘মাতৃদুগ্ধ বিকল্প, শিশুখাদ্য, বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুতকৃত শিশুর বাড়তি খাদ্য ও উহা ব্যবহারের সরঞ্জামাদি (বিপণন নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০১৩’কে বাস্তবায়ন করতে নীতিমালা দ্রুত প্রণয়নের পরামর্শ দেন। শিশুপুষ্টি বিশেষজ্ঞ ও বিধিমালা প্রণয়ন কমিটির সদস্য ডা. এসকে রায় বলেন, বিধিমালাটি আশা করা হচ্ছে ডিসেম্বরের মধ্যে হয়ে যাবে। তারপর থেকে একটা ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে।

No comments

Powered by Blogger.