সমবায় খাতকে দুর্নীতিমুক্ত করুন by ধীরাজ কুমার নাথ

গণমাধ্যমে সমবায় সমিতিগুলোর দুর্নীতির খবর প্রায়ই প্রকাশিত হয়। এতে সুশীল সমাজের অনেকেই বিশেষভাবে উৎকণ্ঠিত। তাদের চিন্তিত হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে, সমবায় সমিতিগুলো এক একটি অর্থনৈতিক ইউনিট। এগুলো এমন ধরনের প্রতিষ্ঠান বা ইউনিট যেখানে আমানতকারীদের মালিকানা থাকে। অর্থাৎ যারা এখানে অর্থ বিনিয়োগ করবে, তারা শুধু বিনিয়োগকারী নয়, এর সঙ্গে তাদের মালিকানাও প্রতিষ্ঠিত হয়। তাদের লাভ-লোকসানের শেয়ার আছে। বিষয়টি সিডিউল ব্যাংকের মতো নয়। তফসিলি ব্যাংকে অনেকেই টাকা রাখেন; কিন্তু তারা মালিক নয়- সুদ পায় এবং ব্যাংক তাদের অর্থ বিনিয়োগের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। তাছাড়া তফসিলি ব্যাংকে টাকা আত্মসাৎ হলে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক বিনিয়োগকারীদের অর্থ ফেরত দেয়। তাই যখন সোনালী ব্যাংকের স্ট্রং-রুমের ভোল্ট ভেঙে ডাকাতরা টাকা লুট করে, আমানতকারীরা অতটা ভেঙে পড়ে না। তারা জানে, ব্যাংক তাদের অর্থ ফেরত দেবে। কিন্তু সমবায় সমিতির পরিস্থিতি ভিন্ন। সেখানে পরিচালক যদি টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়, তখন সমবায় অধিদফতর বা বাংলাদেশ ব্যাংকের সে অর্থ ফেরত দেয়ার প্রশ্নই আসে না। কারণ সমবায় সমিতির নিজস্ব গঠনতন্ত্র বা বিধিমালা আছে, যার মাধ্যমে তাদের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এখানে শেয়ার হোল্ডার বা অংশগ্রহণকারীরা ভোটের মাধ্যমে তাদের পরিচালনা পর্ষদ নির্বাচন করে। এ পর্ষদই হচ্ছে সদস্যদের বা অংশীদারদের পবিত্র আমানত রক্ষাকারী। ভিন্নভাবে বলা যায়, এ হচ্ছে এক ধরনের সামাজিক ও নৈতিক দায়িত্ব পালনের অংশ, যা সভ্য সমাজের প্রতিবিম্ব।
এই তো সেদিন, নভেম্বরের শুরুতে ঈশ্বরগঞ্জে ইসলামিক মাল্টিপারপাস কো- অপারেটিভ সোসাইটির একজন কর্মকর্তা প্রায় এক কোটি টাকার আমানত নিয়ে পালিয়ে গেছে (বণিক বার্তা, ১৫ নভেম্বর ২০১৪)। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাহমিনা আক্তার বলেন, ‘গ্রাহকদের টাকা নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি পালিয়েছে বলে খবর পেয়েছি।’ আরেকটি পত্রিকার খবর হচ্ছে, ‘কুমিল্লায় কো-অপারেটিভের ফাঁদে পড়ে প্রায় লক্ষাধিক পরিবার সর্বস্বান্ত।’ কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে অনেক সমিতি এখন লা-পাত্তা। সরকারি নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে কুমিল্লায় গজিয়ে ওঠা ভুঁইফোড় শ্রেণীর ১ হাজার ২২৯টি সমিতির কর্মকর্তারা পুরো জেলায় প্রায় লক্ষাধিক পরিবারকে পথে বসিয়েছে। এফআইসিএল, আইসিএল, পদ্মা সানফ্লাওয়ার, শাহজালাল, পিপলস, আরবান, সোনার বাংলা, গ্রীন লিফ ব্যবসায়ী সমিতি, লিবারেল কো-অপারেটিভ সোসাইটিসহ অসংখ্য সমিতির পরিচালনা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনেকে তালা ঝুলিয়ে রাতের অন্ধকারে পালিয়েছে। জেলা সমবায় অফিসার রিয়াজুল কবির বলেন, তিনি জেলা প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেছেন।
এসব ঘটনা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। এমন দুর্বৃত্তায়ন গ্রামীণ জনপদের অর্থনীতিতে প্রাণের সঞ্চারের পরিবর্তে অর্থবিত্ত হারানোর আশংকার জন্ম দিচ্ছে, যা জাতীয় প্রগতির পথে অশনি সংকেত। এসবের ফলে স্বল্প সঞ্চয়ের বিনিয়োগকারীরা মোটেই বিনিয়োগে ভরসা পাচ্ছে না এবং গ্রামের মানুষ গ্রাম থেকে শহরে আসার কথা ভাবছে অধিকহারে। এটি টেকসই অর্থনীতি গড়ে ওঠার পথে প্রতিবন্ধকতা বা প্রধান অন্তরায়। কসমেটিক অর্থনীতি বেশিদিন টেকে না। ভালো ভালো কথা অনেক শোনা যায়; কিন্তু মানুষের জীবনে স্থিতিশীল অর্থনীতির ভিত্তি রচিত হয় না। এসবের আরও কুফল আছে। এ সুযোগে বড় পুঁজিপতিদের অনেকে তাদের আর্থিক ক্ষমতা ও প্রভাবের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগকারীদের বিলীন করে দেয় এবং বিপুল মুনাফার স্বর্গ রচনা করে। ফলে আর্থিক বৈষম্য অধিকহারে বৃদ্ধি পায়, ধনী-গরিবের ব্যবধান বাড়তে থাকে, জনজীবনে চরম অসন্তোষ বিরাজ করে, যা পরে অনেক ক্ষেত্রে মানুষকে বিদ্রোহী হতে বাধ্য করে। ভারতের নকশালবাড়ি ও শ্রীকাকুলাম এলাকায় যে সহিংস বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিল, তার মূল কারণ নিহিত ছিল এখানেই। এমন সব বৈষ্যমের ক্ষেত্র থেকেই উদ্ভব হয় সন্ত্রাসের, যা অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে বিচলিত করে এবং একই সঙ্গে গণতন্ত্রের প্রতি মানুষের বিশ্বাসকে দুর্বল করে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটাতে অনুপ্রাণিত করে। তাই এমন সব প্রতারণা-প্রবঞ্চনার ঘটনাকে খাটো দেখার সুযোগ নেই।
গত ১২ নভেম্বর দেশের দ্য ফিনানসিয়েল এক্সপ্রেস পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় বদরুল আহসান খবর দিয়েছেন, “Graft allegations galore against cooperatives Culprits elude action for dilly dallying by regulators’, যার অর্থ হচ্ছে সমবায় সমিতিগুলোর বিরুদ্ধে আত্মসাতের প্রচুর অভিযোগ, কর্তৃপক্ষের ধীরগতি দুর্বৃত্তদের কৌশলে পালানোর সুযোগ করে দেয়। বহুমুখী সমবায় সমিতিগুলোর প্রতারণার কৌশলে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার লেনদেন অযথা বিলম্বিত হচ্ছে। সমবায়ের প্রতারকরা অর্থ আত্মসাতের পর আত্মগোপনে চলে যেতে সাহায্য করে এবং আইন প্রয়োগের দুর্বলতা তাদের সেই সুযোগ করে দেয়। প্রতারণার বহুমাত্রিক ব্যাপ্তিকে সংক্ষেপে তুলে ধরা হয়েছে এ প্রতিবেদনে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ১৫ এপ্রিল, ২০১৪ ‘সমবায় সমিতির ব্যবস্থাপনা : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক সমবায়ের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সমীক্ষা পরিচালনা করে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছে। এতে উল্লেখ করা হয়, ‘সমবায় খাতের ব্যর্থতার মূলে আছে নিয়ন্ত্রক ও তত্ত্বাবধানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত দুর্বলতা, অনিয়ম ও দুর্নীতি, যা সমবায় সমিতির নিবন্ধন, পর্যবেক্ষণ, তদারকি, পরিচর্যা, নিরীক্ষা, প্রণোদনা ও উৎসাহ প্রদানের ক্ষেত্রে নেতিবাচক ভূমিকা পালন করে।’ এছাড়াও বলা হয়েছে, ‘সমবায় সমিতি তদারকিতে সমবায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দক্ষতার অভাব আছে।’ এছাড়াও একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছে- গবেষণা ও প্রচারণার স্বল্পতার কারণে সমবায়ের আর্দশ, মূল্যবোধের ব্যাপারে সমবায়ীরা ভালোভাবে জানতে পারে না। লক্ষণীয়, প্রায় ৪৭ শতাংশ সমবায় সমিতি বর্তমানে কোনো ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নয় এবং তাদের অকার্যকর সমিতি হিসেবে তালিকাভুক্ত করা আছে।
বর্তমানে দেশে প্রায় ২৯ ধরনের নিবন্ধিত সমবায় সমিতি আছে, যাদের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৮৬ হাজার ১৯৯। এসব সমিতির মোট সদস্য সংখ্যা প্রায় ৯৩ লাখ ৫০ হাজার। দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) সমবায় সমিতির অবদান ১.৮৮ শতাংশ। বিষয়টি প্রণিধানযোগ্য।
সমবায়ের মতো এমন একটি প্রাচীন আর্থিক খাতকে অকার্যকর বা দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত হতে দেয়া সঠিক নয়। এমনটি চলতে পারে না। শুধু তৈরি পোশাক শিল্পের ওপর নির্ভরশীলতা বা বিদেশে শ্রমবাজারের উপার্জন কোনো দেশের দেশজ আয় বা টেকসই অর্থনীতি গড়ে ওঠার পক্ষে সহায়ক নয়। তাই অনেকের অভিমত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় বাজেটে সমবায় সেক্টরের জন্য বাস্তব চাহিদা নির্ণয় করে অর্থের সংস্থান করাই হবে অর্থবহ পদক্ষেপ এবং একই সঙ্গে অর্থের ব্যবহারের নিয়মিত মনিটরিং ও তদারকির ব্যবস্থা থাকতে হবে। ছেড়ে দিলে চলবে না, দড়ি ধরে টানতে হবে। কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংকগুলোকে পুনঃ তফসিলিকরণের মাধ্যমে সচল করতে হবে এবং ডিজিটাল পদ্ধতি প্রয়োগ করে নতুন মাত্রায় উত্তরণ ঘটাতে হবে। সমবায় আইন ও বিধিমালা সময়োপযোগী করে আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ বাধ্যতামূলক করতে হবে। এ বছর ১ নভেম্বর জাতীয় সমবায় দিবস পালন করা হয়েছে অত্যন্ত আড়ম্বর সহকারে। প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল, ‘আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তায় সমবায়’।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে সমবায়ীদের পুরস্কার দিয়েছেন এবং সমবায়ে উৎসাহিত করেছেন। সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দেয়া হয়েছে। সরকারপ্রধানের পক্ষে এমন অভিপ্রায় বা নীতিনির্ধারণী ঘোষণা দেয়াই স্বাভাবিক। প্রয়োগের পদ্ধতি বা পরিচালনায় শৃংখলা ও স্বচ্ছতা আনার দায়িত্ব আমলাতন্ত্রের, নীতিনির্ধারকদের নয়। তাই সমবায় খাতকে দুর্নীতিমুক্ত করার দায়দায়িত্ব পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ এবং সমবায় অধিদফতরকেই নিতে হবে।
ধীরাজ কুমার নাথ : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, সাবেক সচিব

No comments

Powered by Blogger.