নাগঞ্জে নামজারি হয় না দুই লাখের কমে

কামাল উদ্দিন এক সময় গৃহশিক্ষক ছিলেন। আর্থিক দুর্দশায় ছিলেন বিপর্যস্ত। ১০ বছর আগে তার চাকরি হয় ভূমি অফিসে। এরপর এলাকাবাসীকে ‘কামাল’ করে দেখান। এখন নারায়ণগঞ্জের বন্দরের নবীগঞ্জে রয়েছে ছয়তলা বাড়ি। চালান ব্যক্তিগত গাড়ি। পারিবারিক, রাজনৈতিক যে কোনো অনুষ্ঠানে খরচ করেন লাখো টাকা। কামাল উদ্দিন বর্তমানে কুতুবপুর ইউনিয়নের সহকারী ভূমি কর্মকর্তা (তহশিলদার)। দেড় বছর ধরে তিনি এখানে কর্মরত। এলাকাবাসীর অভিযোগ, ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় থেকে তিনি জমির নামজারির নামে অবাধে লুটপাট করছেন। গত দেড় বছরেই তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন কয়েক কোটি টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের উপনির্বাচনে তিনি মহজোটের প্রার্থীর পক্ষে নিজের বাড়িতে নির্বাচনী ক্যাম্প পরিচালনা করেন। এ কারণে তাকে কুতুবপুর ভূমি অফিস থেকে প্রত্যাহার করা হয়। নির্বাচনে তার সমর্থিত প্রার্থী জয়ী হওয়ার পর তিনি আবার ফিরে গেছেন স্বপদে। সরকারি দলের নাম ব্যবহার করে তিনি দুর্নীতি করে একের পর এক পার পেয়ে যাচ্ছেন।
নারায়ণগঞ্জ সদর ইউনিয়নে সহকারী ভূমি কর্মকর্তা হিসেবে চার বছর ধরে কর্মরত আবদুস সামাদ। তিনি শহরের চাষাঢ়ায় বিলাসবহুল একটি বাড়িতে থাকেন। বাড়িটির মালিক আবদুর রব। অভিযোগ রয়েছে, রবের মাধ্যমে অনেক খাস ও ভিপি সম্পত্তি তারা নামে-বেনামে দলিল তৈরি করে নামজারির মাধ্যমে আÍসাৎ করেছেন। নিজের কেনা গাড়িতে স্ত্রী ও সন্তানরা চলাচল করলেও তিনি নিজেকে দাবি করেন একজন সামান্য কর্মচারী। অনুসন্ধানে জানা যায়, শহরের কয়েকজন প্রভাবশালী ভূমি ব্যবসায়ীর সঙ্গে আবদুস সামাদের নিয়মিত ওঠাবসা রয়েছে। সরকারি খাস জমি এবং অর্পিত সম্পত্তি তাদের নামে হস্তান্তরের কাজ করে দেন তিনি। সাবেক একজন সংসদ সদস্যের আশীর্বাদে তিনি সদর ভূমি অফিসে চার বছর আগে নিয়োগ পেয়ে এখন পর্যন্ত বহাল আছেন। জানা গেছে, গত ছয় মাসে তিনি ‘খ’ তালিকাভুক্ত প্রায় তিনশ’ জমির নামজারি করেছেন। অভিযোগ রয়েছে, প্রতিটি নামজারির জন্য কমপক্ষে দুই লাখ টাকা তাকে দিতে হয়েছে।
একই অবস্থা নারায়ণগঞ্জের অন্যান্য ভূমি অফিসেরও। দুই লাখ টাকার কমে কোনো অফিসে নামজারির কাজ সম্পন্ন করা যায় না। যদিও সরকারিভাবে নামজারির ফি খুবই নগণ্য।
সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জ সদর সহকারী ভূমি কমিশনারের কার্যালয়কে দুই ভাগে ভাগ করে সদরে ৬টি ভূমি অফিস এবং ফতুল্লায় ৩টি ভূমি অফিস নিয়ে দু’জন সহকারী ভূমি কমিশনারকে দায়িত্ব দেয়া হয়। দুর্নীতি কমানোর লক্ষ্যে এমনটি করা হলেও চিত্র পাল্টায়নি বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। এনায়েতনগরের ভূমি কর্মকর্তা জাকারিয়া, কাশিপুরের আবদুল জলিল, বক্তাবলীর আবদুল মতিন, সৈয়দপুরের আতাউর রহমান, ফতুল্লার মোহাম্মদ মফিজের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ রয়েছে।
ভূমি অফিস সূত্র জানায়, এসব ভূমি অফিসে শুধু সহকারী ভূমি কর্মকর্তাদের নয়, পিয়নদের পোস্টিং পাওয়াও সোনার হরিণ পাওয়া। ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা ব্যয় করে একজন সহকারী ভূমি কর্মকর্তাকে এক বছরের জন্য এখানে পোস্টিং নিতে হয়। তারপর তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দিতে হয় মাসিক ভিত্তিতে মাসোয়ারা। এ কারণে তারা পোস্টিং পেয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। প্রশাসনের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকলে কয়েক বছর একই অফিসে অবস্থান করা যায়। তবে সদর, কুতুবপুর, এনায়েতনগর, কাশিপুর, ফতুল্লা, বক্তাবলী, সৈয়দপুরের মতো ভূমি অফিসগুলোতে পোস্টিং পেতে অর্থের পাশাপাশি প্রয়োজন হয় রাজনৈতিক তদবিরের। এসব ভূমি অফিসে পোস্টিং পেলে এক বছরে কোটিপতি হওয়া যায়।
পাগলা এলাকার সোলেমান মিয়া অভিযোগ করেন, তার ৯ শতক জমির ওপর নির্মিত একটি বাড়ি ‘খ’ তালিকাভুক্ত ছিল। সরকার ‘খ’ তালিকা অবমুক্তির ঘোষণা দেয়ার পর তিনি নামজারি করার আবেদন করলে তার কাছে কুতুবপুর ইউনিয়নের সহকারী ভূমি কর্মকর্তা কামাল উদ্দিন চার লাখ টাকা দাবি করেন। পরে আড়াই লাখ টাকা দিয়ে নামজারি করতে হয়েছে।
একই অভিযোগ ভুইঘর এলাকার জয়নাল আবেদিনের। তিনি বলেন, তিনি বিদেশে থাকা অবস্থায় তার জমি চাচাতো ভাইয়ের নামে নামজারি করা হয়ে গেছে। তিনি এসে আবেদন করে দুই মাস ধরে কুতুবপুর ভূমি অফিসে যোগাযোগ করছেন। কিন্তু নামজারি সংশোধন করতে পারছেন না। কুতুবপুর ভূমি অফিসে কামাল উদ্দিন একটি দালাল চক্র গড়ে তুলেছেন। দালাল চক্রের মাধ্যম ছাড়া কোনো কাজ করা যায় না। একটি জমির নামজারি করতে ২-৩ লাখ টাকা দিতে হয়।
একজন তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী হয়ে কিভাবে এত বিত্তশালী হলেন- জানতে চাইলে কামাল উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, আমি আল-আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক থেকে ৮৫ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ব্যবসা করেছি। ব্যবসা এবং ব্যাংকের ঋণে বাড়ি করেছি।
তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যক্তি যেসব অভিযোগ করেছেন তা সত্য নয় বলে কামাল দাবি করেন। শহরের নিতাইগঞ্জ এলাকার আবদুল গফুর বলেন, তার দুটি ‘খ’ তালিকাভুক্ত বাড়ি অবমুক্ত এবং নামজারি করতে সদর ইউনিয়নের সহকারী ভূমি কর্মকর্তা আবদুস সামাদকে ৫ লাখ টাকা দিতে হয়েছে।
পালপাড়া এলাকার হরেন সাহা জানান, সদর ভূমি অফিসের আওতায় হিন্দু সম্পত্তি বেশি হওয়ায় হিন্দু সম্প্রদায়কে হয়রানি বেশি হতে হয়। অনেককেই জমির দলিল আটকে রেখে দিনের পর দিন হয়রানি করে থাকে। পরে তার সঙ্গে চুক্তি করে জমির নামজারি করতে হয়। এ ব্যাপারে আবদুস সামাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
জানা গেছে ‘ক’ তালিকাভুক্ত জমির মালিকানা নিয়ে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে বর্তমানে প্রায় এক হাজার মামলা আদালতে বিচারাধীন আছে। ইতিমধ্যে প্রায় ৭২টি মামলায় প্রয়োজনীয় নথি উপস্থাপন এবং যথাসময়ে তদবির না করায় সরকার পক্ষ হেরে গেছে। অভিযোগ রয়েছে, ভূমি অফিসের তহশিলদাররা মামলার বাদী পক্ষের সঙ্গে যোগসাজশে অর্থের বিনিময়ে প্রয়োজনীয় নথিপত্র উপস্থাপন করেননি। এ ব্যাপারে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সিদ্দিকুর রহমান বলেন, তহশিলদারদের দুর্নীতি এবং অবৈধভাবে অর্থ আদায়ের ব্যাপারে আমি কোনো অভিযোগ পাইনি। যদি কোনো ব্যক্তি আমার কাছে অভিযোগ করেন তাহলে অভিযুক্তদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেব।

No comments

Powered by Blogger.