সিন্ডিকেটের সাতজন ধরাছোঁয়ার বাইরে

হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের স্বঘোষিত সম্রাট ছিলেন মাহমুদুল হক পলাশ। বিমানের কোনো কর্মকর্তা না হলেও মধ্যপ্রাচ্যগামী ফ্লাইটগুলোর পাইলট থেকে শুরু করে ফার্স্ট অফিসার ও কেবিন ক্রু হিসেবে কারা ডিউটি পাবেন তা নির্ধারণ করতেন তিনি। স্ত্রী কেবিন ক্রু নূরজাহান, ডিজিএম এমদাদ, পাইলট আবু আসলাম শহীদসহ ১০ জনের একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন বিমানের শীর্ষ এক কর্মকর্তার ধর্মপুত্র হিসেবে পরিচিত এই পলাশ। মঙ্গলবারের অভিযানে দেশের সোনা চোরাচালানের টপ সিন্ডিকিটের তিনজন গ্রেফতার হলেও এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন সাতজন। এর মধ্যে পুলিশি অভিযানের মুখে ওই চক্রের সক্রিয় সদস্য ক্যাপ্টেন শামীম নজরুল (ডেপুটি চিফ অব ট্রেনিং) বুধবার কানাডা পাড়ি জমিয়েছেন। এর বাইরে পলাশের অধীনে বিমানবন্দরে কর্মরত বিভিন্ন পর্যায়ে আরও অর্ধশত কর্মকর্তা ও কর্মচারী রয়েছেন।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেছেন, প্রায় অর্ধযুগ ধরে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে সোনা চোরাচালানের মূলহোতা ছিলেন এই পলাশ। দেশের সোনা চোরাচালানের শীর্ষ এ সিন্ডিকেটের কয়েক সদস্যকে গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যে তারা হতভম্ভ। এর মধ্যে গ্রেফতারকৃত পলাশ প্রচণ্ড প্রভাবশালী বলেও মন্তব্য করেছেন একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা।
কে এই পলাশ : বিমানবাহিনীর চাকরিচ্যুত কর্মকর্তা মাহমুদুল হক পলাশ ১০ বছর আগে বিমানে ছোটখাটো ঠিকাদারি ব্যবসা শুরু করেন। ওই সময় তিনি বিমানের একজন শীর্ষ কর্মকর্তার নজরে পড়লে রাতারাতি প্রভাবশালী বনে যান। ওই সময়ে তিনি জাল কাগজপত্র দিয়ে বিমানের পাইলট হিসেবে নিয়োগ পেতে আবেদন করেন। কিন্তু বিষয়টি ফাঁস হয়ে গেলে তার সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। তবে তিনি বিমানের তৎকালীন ফার্¯¡ অফিসার ক্যাপ্টেন শামীম নজরুল ও বিমানের এক প্রভাবশালীর ছেলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলেন। এর পরে তাকে আর পিছে ফিরে তাকাতে হয়নি। স্ত্রী কেবিন ক্রু হওয়ার সুবাদে পুরো ফ্লাইটের নিয়ন্ত্রণ চলে আসে তার হাতে। স্ত্রীর মাধ্যমে কেবিন ক্রুদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন। আর এসব কেবিন ক্রুকে দিয়েই চালাতে শুরু করেন স্বর্ণ ও ওষুধ চোরাচালানি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা যুগান্তরকে জানিয়েছেন, বিমানের সংশ্লিস্ট সবার কাছে পলাশ পরিচিত ছিলেন এক প্রভাবশালীর ধর্মপুত্র হিসেবে। বিমানের কোনো কর্মকর্তা না হয়েও তিনি পরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন সব কর্মকর্তার রুমে অবাধে যাতায়াত করতেন। গোয়েন্দা সূত্র বলেছে, সোনা চোরাচালান সিন্ডিকেট নয়, গত ৬ বছর ধরে একচেটিয়া কমিশন বাণিজ্য, পদোন্নতি, বদলিসহ সব ধরনের তদবিরের শিরোমণি ছিলেন পলাশ। বিমানবন্দরে বিশেষ করে ফ্লাইটে ডিউটি রোস্টার নিয়ন্ত্রণ হতো তার ইশারায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, স্বর্ণ চোরাচালান থেকে শুরু করে বিমানের নিয়োগ বাণিজ্যেও শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন পলাশ। সম্প্রতি হজ ফ্লাইট পরিচালনার জন্য ১০০ কেবিন ক্রু নিয়োগ দেয়া হয় তার দেয়া তালিকা অনুযায়ী। অস্থায়ী ভিত্তিতে মাত্র ৯০ দিনের জন্য এসব কেবিন ক্রুর অধিকাংশরই কাছ থেকে পলাশ হাতিয়ে নেন ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা করে। মূলত সোনা চোরাচালানে ক্যারিয়ার হিসেবে মোটা অংকের টাকা আয়ের জন্য এ পদে কেবিন ক্রুরা ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা করে দেন। আর এ টাকা উদ্ধারে শেষের দিকে তারা মরিয়া হয়ে চোরাচালানে জড়িয়ে পড়েন।
কে এই এমদাদ : সম্প্রতি পদোন্নতি পেয়ে বিমানের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার এমদাদ হোসেনও ভয়ংকর হয়ে উঠেছেন। সামান্য কর্মকর্তা হলেও তিনি মার্সিডিজ বেঞ্জ মডেলের বিলাসবহুল গাড়ি হাঁকিয়ে অফিসে আসেন। গুলশান ১ নম্বর সার্কেলে তার দুটি অভিজাত দোকান রয়েছে। এসব দোকানে বিদেশী ব্র্যান্ডের বিভিন্ন পণ্য বিক্রি হয়। আর এ বিদেশী পণ্যের জোগানদাতারা হলেন বিমানের কেবিন ক্রু ও তার সিন্ডিকেটের সদস্যরা। ঢাকায় নামে-বেনামে তার একাদিক বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ও সম্পত্তি রয়েছে।
ক্যাপ্টেন শহীদ : শিডিউলিং বিভাগের প্রধান ক্যাপ্টেন শহীদও চোরাচালান চক্রের একজন সক্রিয় সদস্য। চিফ অব শিডিউলিং হিসেবে যোগদানের পর থেকে বিমানকেন্দ্রিক সোনা চোরাচালান বেড়ে যাওয়ার নেপথ্যে তার হাত রয়েছে। মূলত তাকে দিয়েই পলাশ ফ্লাইটে ডিউটি রোস্টার তৈরি করতেন। ওই রোস্টারে পলাশের দেয়া তালিকা অনুযায়ী কেবিন ক্রু ও পাইলটদের ডিউটি দেয়া হতো। সিভিল এভিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, যোগ্যতা না থাকা এবং বেবিচকের অনুমোদন ছাড়া ক্যাপ্টেন শহীদকে বিমানের গুরুত্বপূর্ণ এ ধরনের একটি পদে নিয়োগ দেয়া হয়। আর এর পেছনে কলকাঠি নাড়েন ডেপুটি চিফ অব ট্রেনিং ক্যাপ্টেন শামীম নজরুল।
মঙ্গলবার রাতে সোনা চোরাচালানের অভিযাগে তিন কর্মকর্তাসহ পাঁচজনকে গ্রেফতারের পর বুধবার সকালেই তিনি কানাডায় পাড়ি জমিয়েছেন।
সূত্র জানায়, ক্যাপ্টেন শহীদ চাকরিতে যোগদানের পর ১৯৮৫ সালে এফ-২৫-এর টেকনিক্যাল কোর্সে উত্তীর্ণ হতে পারেননি। এ ঘটনায় তাকে চাকরি থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরে তিনি তদবির করে আবারও বিমানে যোগদান করেন। ১৯৯০ সালে তিনি বিএটিসি কোর্সে যোগদান না করে বিমানকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করান। এ ঘটনায় তাকে অসন্তুষ্টিপত্র দেয়া হয়। পরে এ পরীক্ষার আবারও শিডিউল করা হয়। কিন্তু সেখানেও তিনি যোগদান করেননি। পরবর্তী সময়ে তাকে পরীক্ষায় অংশগ্রহণে বাধ্য করা হলে তিনি পরীক্ষা দেন। কিন্তু পরীক্ষার খাতায় কিছু না লিখে শূন্য খাতা জমা দেন। ক্যাপ্টেন শহীদ একটি এটিপি উড়োজাহাজ রাজশাহী বিমানবন্দরে নিয়ে দুর্ঘটনা ঘটান।
বিমানের তদন্তে ওই সময়ে প্রমাণ মেলে তিনি কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়ে ওই বিমান দিয়ে একজন পাইলটকে ট্রেনিং দিচ্ছিলেন। এর ফলে বিমানটি দুর্ঘটনার শিকার হয়। তার দুর্বল বিমান পরিচালনার কারণে তাকে একাধিকবার শোকজও করা হয়। তারপরও তিনি এখন বিমানের শিডিউলিং বিভাগের প্রধান।
এদিকে গোয়েন্দারা ক্যাপ্টেন শহীদের ডান হাত হিসেবে পরিচিত ম্যানেজার (শিডিউলিং) শাহ আলম মিরন, পরিচালক (প্রশাসন) রাজপতি সরকারসহ আরও কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য খুঁজছেন। গোয়েন্দারা বলেছেন, এদের জিজ্ঞাসাবাদ করা গেলে সোনা চোরাচালানের অনেক অজানা তথ্য বেরিয়ে আসবে।

No comments

Powered by Blogger.