মুক্তিযোদ্ধার বাঁচার লড়াই -দেশমাতৃকার জন্য যাঁরা যুদ্ধে নেমেছিলেন তাঁদের অনেকেই আজ লড়ছেন দুবেলা দুমুঠো খাবারের জন্য। তাঁদের জীবনচিত্র নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন -মাতবর গাজী লাশ টানার কাজ করেন by ফখরে আলম

মুক্তিযুদ্ধের সময় একের পর এক শত্রুসেনা হত্যা করে তাদের লাশ ডিঙিয়ে সামনে এগিয়ে গেছেন মাতবর গাজী। শেষে ছিনিয়ে এনেছেন লাল-সবুজের বিজয় পতাকা। এখন সেই মুক্তিযোদ্ধা মাতবর গাজী খুঁজে বেড়ান অপমৃত্যুজনিত লাশ।
গ্রামগঞ্জ থেকে এ ধরনের লাশ তিনি ভ্যানে করে নিয়ে আসেন মণিরামপুর থানায়। পরে তা ময়নাতদন্তের জন্য নিয়ে যান যশোর সদরে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। ময়নাতদন্ত শেষে সেই লাশ পৌঁছে দেন স্বজনদের কাছে। মুক্তিযোদ্ধা মাতবর গাজীর এটাই পেশা।
জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে মাতবর গাজী যে দেশ স্বাধীন করেছেন, সেই দেশে তাঁর এক টুকরো জমিও নেই। শ্বশুরবাড়িতে থাকেন তিনি। এ নিয়ে কোনো দুঃখ নেই তাঁর। মাতবরের সাফ কথা, 'কারোর কতা শুইনে যুদ্ধি যাইনি। একা একাই যুদ্ধি গিচি। আমি কারোর কাছে কিছু চাইনে। আমাইর কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই।'
যশোরের মনিরামপুর উপজেলার ষোলখেদা গ্রামে মাতবর গাজীর বাড়ি। তাঁর বয়স ৬৫ বছর। তাঁর দুই ছেলে তিন মেয়ে। বড় ছেলে সেলিম মুরগি বিক্রি করেন। ছোট ছেলে লিটন ভ্যান চালান। তিন মেয়ে জোছনা, রেশমা, মাছুমার বিয়ে হয়ে গেছে।
মনিরামপুর থানায় গত সোমবার খোঁজ নিলে ডিউটি অফিসার এএসআই আবুল হোসেন জানান, মুক্তিযোদ্ধা মাতবর গাজী এ থানায় লাশ টানার কাজ করেন। তিনি লাশের সন্ধানে বাইরে গেছেন। বিকেলে দেখা হয় মাতবরের সঙ্গে। ভ্যানে লাল পতাকা উড়িয়ে তিনি থানায় ঢুকছেন। লাশের সন্ধান মেলেনি। তাতে কোনো দুঃখ নেই তাঁর।
থানার পাশের চায়ের দোকানদার রহমান বললেন, 'আমরা জন্মের পর থেকে দেখছি, গাজী ভাই লাশ টানছেন। গলা, পচা কোনো লাশেই তাঁর ভয় নেই। সব লাশ আপন করে পাটিতে জড়িয়ে তিনি গ্রাম থেকে থানায় নিয়ে আসেন।'
মাতবর গাজী বললেন, 'কেউ আত্মহত্যা করলে, কারো মৃত্যু সন্দেহজনক মনে হলে, কেউ খুন হলে সেই লাশের ময়নাতদন্তের প্রয়োজন হয়। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করে লাশ আমাকে বুঝিয়ে দেয়। আমি সেই লাশ থানা এবং হাসপাতালে নিয়ে যাই। ময়নাতদন্ত শেষে লাশ স্বজনদের কাছে পৌঁছে দিই। থানায় এর জন্য কোনো বরাদ্দ আছে কি না তা আমার জানা নেই। আমি কারো কাছে কোনো টাকাও দাবি করি না। মৃতের আত্মীয়স্বজন আমাকে এক-দুই হাজার টাকা দেয়। সেই টাকা দিয়েই আমার সংসার চলে।' তিনি আরো বলেন, 'দেশ স্বাধীন হলে বাড়ি ফিরে এসে বেশ কিছুদিন বেকার জীবনযাপন করেছি। লেখাপড়া না জানার কারণে কোনো কাজ পাইনি। এর মধ্যে আমাদের গ্রামের সুফিয়া আমাকে একটি ভ্যান দেন। ওই ভ্যান নিয়ে আমি যাত্রী বহন শুরু করি। এরপর শুরু করি লাশ টানার কাজ। ১৯৭২ সাল থেকে আমি লাশ বহন করছি। লাশ বহনে আমার কোনো ক্লান্তি নেই। আমার কোনো ঘৃণা নেই।'
জানা যায়, ১৯৭১ সালে একদল শরণার্থী তাদের গ্রাম দিয়ে ভারতে যাচ্ছিল। এই শরণার্থী দলের মধ্যে কয়েকজন নারীও ছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন একেবারেই প্রবীণ। তিনি হাঁটতে পারছিলেন না। মাতবর তাঁকে নিয়ে সীমান্তের দিকে এগোতে থাকেন। হরিদ্রপোঁতা গ্রামে পৌঁছালে রাজাকাররা শরণার্থী দলসহ মাতবরকে ধরে ফেলে। নরপশুরা কয়েকজন নারীকে লঞ্ছিত করে। মাতবরের লুঙ্গি উঁচু করে তারা পরীক্ষা নেয়, তিনি হিন্দু না মুসলমান। ওই ঘটনায় মাতবর বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। তাঁর মন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। তিনি প্রতিশোধ নেওয়ার পণ করেন। মুক্তি পেয়ে হেঁটে তিনি ভারতের হাকিমপুর ক্যাম্পে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে নাম লেখান। সেখানে ১৮ দিনের প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি মনিরামপুরের কমান্ডার ফজলুর রহমান, ছিয়ানব্বই গ্রামের সুভাষ কমান্ডার ও শওকত আকবরের নেতৃত্বে রাজগঞ্জ, ঝাঁপা, ডুমুরখালী, উজ্জ্বলপুর, দশআনী, মল্লিকপুর, ঝিকরগাছা এলাকায় হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন।
মাতবর বলেন, 'রাজগঞ্জ রাজাকার ক্যাম্পে হানাদার বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি ছিল। আমরা খবর পেয়ে হানাদারদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য কমান্ডার আকবরের নেতৃত্বে ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধা এগোতে থাকি। ঝিকরগাছার চণ্ডিপুর মাঠে আগে থেকে খবর পেয়ে হানাদাররা আমাদের ঘিরে ফেলে। আমরা পাশের খেজুর বাগানে গিয়ে পজিশন নিই। এরপর শুরু হয় যুদ্ধ। ক্রলিং করে গুলি ছুড়তে ছুড়তে রাজাকার ক্যাম্পের দিকে এগোতে থাকি। হানাদারদের পরাজয় হয়। ওই যুদ্ধে ২১ জন পাকিস্তানি সৈন্য মারা যায়। আমি একাই ১৮ জন রাজাকারকে ধরে ফেলি। তাদের একসঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে ক্যাম্পে নিয়ে আসি। ওই যুদ্ধে সহযোদ্ধা মুকুন্দ, জামাল ও খালেক শহীদ হন। তাঁদের কথা আজও মনে আছে।'

No comments

Powered by Blogger.