সমকালীন প্রসঙ্গ-স্টেডিয়াম বনাম চালের ট্রাক by মনজুরুল হক

 ৫ কেজি চালে হয়তো একজন শ্রমিক মাত্র ৩০ টাকা বাঁচাতে পারে। সেই ৩০ টাকার জন্য তাকে ব্যয় করতে হচ্ছে তিন-চার ঘণ্টা। তাহলে ঘণ্টাপ্রতি তার মজুরি হচ্ছে ৮ থেকে ১০ টাকা! যদি একজন শ্রমিক যথাযথ কাজ পেত তাহলে তো তার চালের ট্রাকের পেছনে দাঁড়ানো লোকসান!
আজ থেকে পৌনে দুইশ' বছর আগে ব্রিটেনের রাজপরিবারের ডিউক, অমাত্যবর্গ, সমাজের রাজন্য ব্যক্তিবর্গরা রাজধানীর বাইরে কোনো জঙ্গলের ধারে, কিংবা জঙ্গলঘেরা মাঠে ব্যাট-বল দিয়ে সময় কাটানোর ব্যবস্থা করেন। কালক্রমে যার নামকরণ হয়ে ওঠে ক্রিকেট। সে সময় কেবল রাজপরিবারের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে সম্পর্ক আছে এমন কুলিন ব্যক্তিরাই এই ক্রিকেট নামক খেলাটির অংশগ্রহণকারী এবং উপভোগকারী হতে পারতেন। সে সময় আরও বলা হতো, ক্রিকেট হচ্ছে ব্রিটিশ সমাজের, তথা ইংরেজ সমাজের এটিকেটের অনুপম প্রদর্শনী। সাদা ছিমছাম পোশাকে মাথায় হ্যাট পরে যখন একজন ব্যাট হাতে নামেন, তখন যেন আসলেই এক রাজকীয় ভঙ্গিতে তিনি দৃশ্যমান হন। তারপর দেখে হোক না দেখে হোক, কিংবা না বুঝে হোক আম্পায়ার আঙ্গুল তোলার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাটসম্যান 'আউট' মেনে নিয়ে প্যাভিলিয়নে ফেরেন। এটাও ব্রিটিশ বা রানীর দেশের ভব্যতা বা এটিকেটকেই বোঝায়। সে বিচারে ক্রিকেটকে এক অর্থে 'দ্য গেম অব ব্রিটিশ এটিকেট'ও বলা যায়। কলোনিয়াল নিয়মেই বিশ্বের যেখানে যেখানে ব্রিটিশ শাসন জারি হয়েছে, সেখানেই কমবেশি ক্রিকেটের চল হয়েছে এবং ব্রিটিশ ভারতের অধীনে বাংলাদেশেও ক্রিকেট জনপ্রিয় হয়েছে সেই পাকিস্তান আমলেই।
দেশ স্বাধীনের পরে ওই ব্রিটিশরাই তাদের এমসিসি ক্লাব পাঠিয়ে এ দেশে ক্রিকেটের চাষবাস করার চেষ্টা করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৭ সালে আইসিসি চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম তিন দলের একটি হয়ে প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে পারে বাংলাদেশ। সেই থেকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। বাংলাদেশে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা এক সময়কার জনপ্রিয় ফুটবলকেও হার মানিয়েছে। এই ক্রিকেটকে তৃণমূলে নিয়ে গেলেই সম্ভবত বাংলাদেশের অপরাপর যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট, অসঙ্গতি, না পাওয়ার বেদনা লাঘব হয়ে যেত! মোটা দাগে বাংলাদেশে বিশ্বকাপ ক্রিকেট নিয়ে যা হয়েছে তার সঙ্গে আর কোনো কিছুর তুলনা চলে না।
এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে তো আমাদের চেয়ে শতগুণ উন্মাদনা! তা ঠিক। তবে তাদের ঠিকঠাক মানিয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্র অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা ঢাকায় ছবি করতে এসে বেশ খোলামেলা পোশাক পরলে তা নিয়ে সমালোচনার ঝড় বয়ে গিয়েছিল। অভিযোগ উঠেছিল, ঋতুপর্ণাই বাংলাদেশে নগ্নতা আমদানি করেছেন! জবাবে ঋতু বলেছিলেন, 'আমাকে ওই স্বল্প পোশাকেও মানিয়ে যায়, কিন্তু তোমাদের ময়ূরীকে তা মানাবে কীভাবে?' ভারতের ক্ষেত্রে ক্রিকেটও তেমনি। ক্রিকেট নিয়ে ওদের উন্মাদনা মানিয়ে যায়। ক্রিকেট ওদের অনেক দিয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী বোর্ড ভারতের, সারাবিশ্বের যেখানেই ক্রিকেট হোক সব বিজ্ঞাপনদাতা ভারতীয় কোম্পানি। ক্রিকেট তথা শচীন রমেশ টেন্ডুলকারকে ভারতের ৩৩ কোটি দেব-দেবীর আর একজনও ভাবা হয়। তার সঙ্গে আমাদের তুলনা কীভাবে আসে? আমাদের ক্রিকেট তো সেই গত দশকের ঘূর্ণিপাকে পাক খাচ্ছে। ভারতে ক্রিকেট তাদের অস্পৃশ্য জাতপাতের ভেদাভেদও খানিকটা ঘুচিয়েছে। মনসুর আলী পতৌদির আমলে একনাথ সোলকার মুচির ছেলে হওয়ায় স্লিপে ফিল্ডিং করাকালীন তার হাত থেকে আসা বল নবাব পতৌদি ধরতেন না। মাটিতে পড়ে গেলে অন্যরা কুড়িয়ে দিত! সেই অবস্থা থেকেও সরে এসেছে ওদের ক্রিকেট। এখন চণ্ডালপুত্র বিনোদ কাম্বলি আর শচীন জুটি বেঁধে বিশ্বরেকর্ড করেন!
ক্রিকেট নিয়ে মাতামাতি শেষে ভেতরে ভেতরে ছোবড়া হয়ে যাওয়া সাধারণ মানুষ এই ক্রিকেট ঘোরের ভেতর আরও বেশি বেসামাল হয়েছে। চালের ট্রাকের পেছনে আগে লাইনে দাঁড়াত নিম্নবিত্তরা। এখন সেখানে মধ্যবিত্তরাও তাদের দিনের তিন-চার ঘণ্টা সময় নষ্ট করে পঁাঁচ কেজি চাল কিনছে। বাজারে শুধু তো চাল নয়, সবকিছুতেই যেন আগুন লেগেছে। যে শ্রমিক মাত্র ৫ কেজি চালের জন্য তিন-চার ঘণ্টা ব্যয় করছে তার দৈনিক মজুরি তাহলে কত দাঁড়াল? ৫ কেজি চালে হয়তো সে মাত্র ৩০ টাকা বাঁচাতে পারে। সেই ৩০ টাকার জন্য তাকে ব্যয় করতে হচ্ছে তিন-চার ঘণ্টা। তাহলে ঘণ্টাপ্রতি তার মজুরি হচ্ছে ৮ থেকে ১০ টাকা! যদি একজন শ্রমিক যথাযথ কাজ পেত তাহলে তো তার চালের ট্রাকের পেছনে দাঁড়ানো লোকসান! অর্থাৎ শ্রমিকেরও হাতে কাজ নেই। তাই সে মূল্যবান তিন-চারটি ঘণ্টা ব্যয় করে ওই মাত্র ৩০ টাকা বাঁচানোর চেষ্টা করছে। এর সঙ্গে ক্রিকেট চলাকালীন ঢাকাকে সাজানো-গোছানো আর ক্রিকেটকে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে যে টাকা ব্যয় হয়েছে তার সঙ্গে তুল্য বিচারে ওই শ্রমিকের ৩০ টাকার তফাত কতখানি?
মহাজোট সরকারের মধুচন্দ্রিমাকাল শেষ হয়েছে। এখন চলছে ক্রান্তিকাল উত্তরণের চেষ্টা। সেখানে ওই ছোট্ট একটা স্ফুলিঙ্গের মতো অনেক স্ফুলিঙ্গ বিচ্ছুরণের অপেক্ষায়। এর যে কোনো একটি স্ফুলিঙ্গের কারণে পুড়ে যেতে পারে মহাজোট সরকারের ভূমিধস বিজয়েও মধুচন্দ্রিমা! সেই অনেকগুলো স্ফুলিঙ্গ বা স্পার্কের অন্যতম দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং সেই কুখ্যাত শেয়ারবাজারের ধস। যদিও এর বাইরে মহাজোট সরকারের একাধিক মন্ত্রী আর উপ বা প্রতিমন্ত্রীদের বাকচাতুর্য সরকারকে আরও আগেই বিপদে ফেলতে পারে। 'পারে' বলছি কেন? ফেলছে এবং ফেলেছেও। তারপরও সরকারের কোনো মহলেই এসব 'ছোটখাটো' বিষয়ে নজর দেওয়ার মতো সময় এবং সদিচ্ছা দেখাচ্ছেন না। প্রায় রোজই সংবাদপত্রে বড় বড় রিপোর্ট হচ্ছে। রিপোর্টে বলা হচ্ছে, ভরমৌসুমেও চালের বাজারে আগুন! মাছ-মাংস, তরিতরকারি থেকে শুরু করে এমন কোনো কিছু নেই যার দাম সাধারণ মানুষের নাগালে আছে। হ্যাঁ, এ নিয়ে অবশ্য সরকারেরও বিস্তর ব্যাখ্যা আছে। এবারকার ব্যাখ্যার পেছনে যুক্তিটাও নেহাত খোঁড়া নয়। সরকার সরকারি কর্মচারীদের একপ্রস্থ বেতন বাড়িয়েছে এবং সেই বেড়ে যাওয়ার অংশ প্রায় দ্বিগুণ। তাতে করে যুক্তিটা আসে_ মানুষের হাতে টাকা এসেছে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে! এই 'ক্রয়ক্ষমতা'র একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে! সাদা বাংলায় কিনতে পারার ক্ষমতার নামই ক্রয়ক্ষমতা।
অর্থাৎ বাজারে গিয়ে এক দিনমজুরের এক কেজি চাল কিনতে পারার ক্ষমতা! নিশ্চয়ই ক্রয়ক্ষমতা আছে। ৩৪ টাকা দরে মোটা চাল কেনার ক্ষমতা না থাকলে অসহায় দিনমজুর কী করত? নিশ্চয়ই ছিনতাই-টিনতাই করত বা কেড়েকুড়ে খাওয়ার চেষ্টা করত! সুতরাং আমরা এই সিদ্ধান্তে পেঁৗছতেই পারি যে, চাল-ডাল-তেলের দাম যতই বাড়ূক, মানুষ কিন্তু কিনতে পারছে! কিন্তু সংবাদপত্রে বলা হচ্ছে, রোজই ন্যায্যমূল্যে চাল বিক্রির ট্রাকের ধারে লাইন লম্বা হচ্ছে। নিম্নআয়ের দরিদ্র মানুষ তো আছেই, সে সঙ্গে রোজই যোগ হচ্ছে মধ্যবিত্তরাও। তারাও ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ওই ন্যায্যমূল্যের চাল কিনছেন। চাল না হয় 'ন্যায্যমূল্যে' মিলছে, কিন্তু বাদবাকি আর সবকিছু? তেল, নুন, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, তরিতরকারি, মাছ-মাংস, আটা, রুটি, বিস্কুট, ওষুধ, বাড়িভাড়া, যাতায়াত ভাড়া, কাপড়চোপড়? এসব? এসব তো ন্যায্যমূল্যে মিলছে না।

মনজুরুল হক: কলাম লেখক
monjuraul@yahoo.com
 

No comments

Powered by Blogger.