উপেক্ষিত মুক্তিযোদ্ধারা! by এম আবদুল হাফিজ

বলা হয়ে থাকে, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল এক ধরনের জনযুদ্ধ, যাতে কিছু চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধী ছাড়া দেশের আপামর জনসাধারণ কোনো না কোনোভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু এদের সামান্য সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধাকেই আমরা জাতীয় পর্যায়ে নানা প্রশংসা ও বিশেষণে বিভূষিত হতে দেখি।
বাকিরা জীবনযুদ্ধে হারিয়ে গেছেন দৃশ্যপট থেকে। বিস্মৃতির অতল গহ্বর থেকে সচেতন প্রয়াসে কেউ এদের টেনে আনেননি আলোর জগতে। এমনকি চলমানজীবনের নিরন্তর সংগ্রামের মধ্যেও অনেকেই এদের হয়তো মনেই রাখেননি। একাত্তরের টগবগে তরুণ বা যুবক, যারা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে শুধু বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে তারই ডাকে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন। বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়া একদিনের সেই দুঃসাহসী যোদ্ধারা স্বাভাবিক নিয়মেই আজ জীবনসায়াহ্নে। আবার অনেকে ওপারে পাড়িও জমিয়েছেন।
যারা ধুঁকে ধুঁকে আজও এই নশ্বর পৃথিবীতে আছেন; কদাচিৎ কেউ তাদের সন্ধান রাখেন। কেননা, তারা তো আর রাজনীতি করতে মুক্তির রণাঙ্গনে যাননি। তারা রাজনীতি বুঝতেনও না। রাজনীতি বা প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে টিকে থাকার মন্ত্র অর্থাৎ বন্দনা বা স্তাবকতায় পটুত্ব না থাকায় ছিটকে পড়েছেন অনেকেই যুদ্ধোত্তর 'সোনার বাংলা'র মূল মঞ্চ থেকে।
আমাদের গণমাধ্যমের প্রতিবেদকরা বিস্মৃতির অন্ধকার জগৎ থেকে অধুনা এদের ওপরে তুলে এনেছেন। এদের কেউ এখন রিকশা বা ভ্যানচালক, কেউ পথিপাশর্ে্বর ভাত বিক্রেতা_ বস্তিবাসী, পথশিশু বা অনাহূত যে কোনো আগন্তুককে খাইয়ে যার আনন্দ। কেউবা দর্জিগিরি করেন, কিন্তু চশমাটা পুরনো হয়ে যাওয়ায় তার কাজে গ্রাহককে খুশি করতে পারেন না। তবু কারও অবজ্ঞার ভ্রূকুটি দেখতে চান না এসব উপেক্ষিত মানুষ।
এই বিজয়ের যত উল্লাস, আনন্দ, স্মৃতিচারণ; কিন্তু সেসব 'এলিট' আয়োজনে এদের প্রতিনিধিত্ব নেই। অবশ্য কিছু বাছাই করা মুক্তিযোদ্ধা সেসব বিরল সম্মান পান। সশস্ত্র বাহিনী দিবসে সংবর্ধিত হন বা বঙ্গভবনে বিজয় দিবসের অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হন। জনযুদ্ধের কুশীলবরা উপকৃত হন যখন সারাদেশের আর্থ-সামাজিক বিন্যাসে বা প্রবাহে রক্তের সঞ্চালন থাকে, দারিদ্র্য-বৈষম্য হ্রাস পায়, দুর্নীতি-অপচয়-অবক্ষয় (নৈতিক) বিলুপ্ত হয়। তার জন্য সম্ভবত আরেকটি জনযুদ্ধের প্রয়োজন, যার রূপরেখা এই যোদ্ধাদেরই নির্ধারণ করতে হবে।
অধিকারের সংগ্রামে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধের ময়দানে থেকেই নিজ নিজ পাওনা পাওয়া নিশ্চিত করতে হয়। আজকের উপেক্ষিত মুক্তিযোদ্ধারা যখন তা বুঝবেন, তাদের এখনকার এই দৈন্যদশা কেটে যাবে। এটা কখনোই হতে পারে না, একই যুদ্ধ করে কেউ পরিত্যক্ত, নিঃস্ব; আবার কেউবা ভোগবিলাসের অধিকারী। এমনটি ঘটলে সেখানে সংঘাত অনিবার্য এবং রাজনৈতিক-সামাজিক স্থিতিশীলতাও অবিশ্বাস্য।
মুক্তিযোদ্ধারা তাদের লক্ষ্যে অবিচল থাকলে জয় তারা পাবেনই। সে জয় হবে সমাজের সুবিধাবঞ্চিতদের সম্মিলিত জয়। মিছিলে বা যুদ্ধে যাওয়ার একটা সময় থাকে। আজকের উপেক্ষিত মুক্তিযোদ্ধাদের সে সময় অনেক আগেই পেরিয়ে গেছে। সমাজের সচেতন অংশকেই বিরাজমান অসঙ্গতি ঘোচানোর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। যে যুদ্ধাপরাধীদের আজ সঙ্গত কারণেই বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়, তাদেরই এক সময়ের লক্ষ্যবস্তু বিস্মৃতপ্রায় মুক্তিযোদ্ধারা উপেক্ষিত থেকে যাবে_ তা একটি নিদারুণ অসঙ্গতি।
বিবেকবান কোনো দেশবাসী এটা মেনে নিতে পারে না যে, স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কোনো মুক্তিযোদ্ধা ভিক্ষার হাত বাড়াবেন বা ধুঁকে ধুঁকে রিকশা-ভ্যান চালাবেন; তাদের সন্তানরা সমাজের উচ্ছিষ্টে পরিণত হবে বা পথশিশুর দলে ভিড়বে এবং তাদের স্ত্রী-কন্যারা ঝি-চাকরানির কাজে লিপ্ত হবে; হয়তোবা কোনো স্বাধীনতাবিরোধীর গৃহেই। শুনেছি, কিছু চতুর রাজাকার মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে আগামীর বার্তায় শঙ্কিত হয়ে ভোল পাল্টিয়ে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এদের সংখ্যাও নগণ্য নয় এবং তাদের সামাজিক অবস্থান তাদের প্রতিষ্ঠাও দিয়েছে।
আজ পর্যন্ত নাকি মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাই চূড়ান্ত হয়নি। যখন যে দল ক্ষমতায় এসেছে, সে দলই তার অনুকূলে এদের তালিকা প্রণয়ন করেছে। সেই প্রক্রিয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাও কলুষিত হয়েছে বাছবিচারহীন নতুন নতুন অন্তর্ভুক্তিতে। এই তালিকার শুদ্ধতা নিশ্চিত করার সময়ও পেরিয়ে গেছে। মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু ফায়দা গ্রহণেরই একটি চোরাপথ এটি এখন। এরই ঘূর্ণাবর্তের শিকার আলোচনাধীন মুক্তিযোদ্ধারা, যারা আজ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে উপেক্ষিত।

ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ :সাবেক মহাপরিচালক বিআইআইএসএস ও কলাম লেখক

No comments

Powered by Blogger.