পরিবহন খাতে সুশাসনের অভাব by এ এম এম শওকত আলী

সাম্প্রতিককালে সরকারি নীতিনির্ধারকরা একাধিকবার রেলওয়ের ভাড়া বৃদ্ধির কথা বলেছেন। সর্বশেষ ঘোষণায় ১ অক্টোবর থেকে রেলওয়ের ভাড়া ৫০ শতাংশ বাড়ানোর কথা বলা হয়। এর পক্ষে জোরালো যুক্তিও প্রদর্শন করা হয়েছে।


এক. গত দুই দশকে রেলওয়ে ছাড়া অন্যান্য পরিবহন খাতের ভাড়া একাধিকবার বাড়ানো হয়েছে। দুই. ২০১১-১২ সালে রেলওয়ের আয় ছিল ৬২৯৫.৪৬ মিলিয়ন টাকা। এর বিপরীতে ব্যয় হয়েছে ১৪১৬.১৯ মিলিয়ন টাকা। অর্থাৎ আমদানি ৫০ পয়সা, খরচ এক টাকারও বেশি। তিন. রেলওয়ে খাতে ভাড়া বাড়ানো হয় ১৯৯২ সালে। দুই দশক পার হলেও আর ভাড়া বাড়ানো হয়নি। চার. কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি পেয়েছে ৪২০ শতাংশ। পাঁচ. রেলওয়ের যন্ত্রপাতি ক্রয়ের ব্যয় বেড়েছে ৩৬০ শতাংশ। ছয়. ফলে সরকারকে যথেষ্ট পরিমাণ ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। তবে ৫০ শতাংশ ভাড়া বাড়িয়েও রেলওয়ে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে পারবে না।
আলোচ্য সিদ্ধান্তটি রেলওয়েবিষয়ক সংসদীয় কমিটির সমর্থন পেয়েছে এবং সরকারপ্রধানও প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছেন। অন্যান্য খাতের (যেমন- এনার্জি) মতো এ প্রস্তাব সম্পর্কে জনমত গ্রহণ করা হয়নি। তবে দীর্ঘ দুই দশক পর প্রস্তাবিত ভাড়া বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে সমর্থনযোগ্য। একই সঙ্গে এ বিষয়ে কিছু প্রশ্ন করা যায়, যা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা শ্রেয়। সরকারি নীতিনির্ধারকরা রেলওয়ের আয় ও ব্যয়ের বিশাল পার্থক্যের বিষয়ে কেন কোনো পদক্ষেপ আগে গ্রহণ করেননি? গত দুই দশকে কয় দফা রেলওয়ে প্রশাসন ভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাব দিতে কেন ব্যর্থ হলো এবং দিয়ে থাকলে কেন তা বাস্তবায়ন করা হয়নি? রেলওয়েকে কি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পরিচালনা করা অসম্ভব? রেলওয়ে কতটুকু স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে? রেলওয়ে সচল রাখার জন্য ব্যয় বৃদ্ধির বিষয় একেবারেই অজানা ছিল না। কিছু উন্নয়ন সহযোগী এ সংকট দূর করার লক্ষ্যে একাধিকবার সংস্কারমূলক প্রস্তাব বাস্তবায়নে সচেষ্ট ছিল। এর মধ্যে অন্যতম ছিল রেলওয়ের প্রশাসনিক কাঠামোর পরিবর্তন।
পরিবর্তনের আওতায় রেলওয়ের বোর্ড থেকে মন্ত্রণালয় অধীনস্থ রেলওয়ে অধিদপ্তর এবং পরে মন্ত্রণালয়ভুক্ত পৃথক বিভাগ শেষ পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে ব্যয়ের তুলনায় আয় কম হওয়ায় রেলওয়ে চাহিদা মোতাবেক ইঞ্জিনসহ যাত্রীবাহী কোচ ক্রয় করতে সক্ষম হয়নি। সরকারের পক্ষেও একবারে এর জন্য অর্থ বরাদ্দ সম্ভব ছিল না। এগুলো বাদ দিয়েও রেলপথের সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ক্রয় করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে যেগুলো ব্যবহার হচ্ছে, তা ২৫ বছরেরও পুরনো। ফলে যাত্রীসেবার মান নিশ্চিত করতেও রেলওয়ে প্রশাসন সফল হতে পারেনি। গত দুই দশকে জনসংখ্যা বেড়েছে। যাত্রীর সংখ্যাও বেড়েছে। কিন্তু রেলওয়ের যাত্রীসহ মালামাল পরিবহনের ক্ষমতা দুই দশক আগে যা ছিল তা-ই আছে। দুই ঈদের ছুটির সময় এ বিষয়টি অধিকতর দৃশ্যমান হয়।
অধিকতর যাত্রীর কারণে রেলওয়ের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা আরো বেশি দুর্বল হয়। অভিযোগের পর অভিযোগ যাত্রীরা করে থাকে। কিন্তু সমস্যার কোনো সমাধান হয় না। অপ্রতুলসংখ্যক ইঞ্জিনের ব্যবস্থাপনা ধ্বংসপ্রায়। কয়েক বছর ধরে যাত্রীবাহী ট্রেন সময়মতো যায় না। যাত্রীদের অপেক্ষা করতে হয় তিন থেকে চার ঘণ্টা। এর সঙ্গে টিকিট বিক্রয় ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম। এ বিষয়ে মিডিয়াসহ যাত্রীরা বহু অভিযোগ করেছে। কিন্তু অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। ২২ সেপ্টেম্বরের এক সংবাদ অনুযায়ী টিকিট বিক্রির ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়ম ঘটেছে। এর জন্য বলা যায়, শুধু ঈদের সময়ই নয়; বরং টিকিট বিক্রির ব্যাপক অনিয়ম বছর ধরেই চলে। কয়েক দিন আগের এক সংবাদ অনুযায়ী লালমনিরহাট রেলস্টেশনে ট্রেন সময়মতো না আসার জন্য যাত্রীরা ছিল বিক্ষুব্ধ। কিছু ভাঙচুরও হয়েছে। সার্বিকভাবে বলা যায়, রেলওয়ের বিধ্বস্ত ব্যবস্থাপনা একমাত্র ৫০ শতাংশ ভাড়া বাড়িয়ে উন্নত করা সম্ভব হবে না। ভাড়া বাড়ালে মানসম্পন্ন সেবাও রেলওয়েকে দিতে হবে। সব মিলিয়ে পরিবহন ব্যবস্থাপনায় সুশাসনের দারুণ অভাব দৃশ্যমান। এ কথা সত্যি যে রাষ্ট্র পরিচালনাসংক্রান্ত অন্যান্য খাতেও সুশাসনের অভাব রয়েছে। রেলওয়ের নিয়োগপ্রক্রিয়ায় নিয়োগ-বাণিজ্যের ঘটনাটি ছিল বহুল প্রচলিত। সরকার নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান বিমানের ব্যবস্থাপনার চিত্রও একই। কারণও বহুলাংশে একই ধরনের। বিমানের হজ-সংক্রান্ত পরিবহনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। সব অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। কিছু আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের সময় পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়টি সত্য যে ৫০ শতাংশ ভাড়া বাড়িয়ে বিদ্যমান করুণ ব্যবস্থাপনার কোনো উন্নতি হবে না। ব্যবস্থাপনার উন্নতির জন্য সুশাসন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। কিছু ইঞ্জিন ও যাত্রীবাহী কোচ সংগ্রহের কথা শোনা গিয়েছিল। বিষয়টি সময়সাপেক্ষ। রেলওয়ের তরফ থেকে বলা হয়েছে যে ভাড়া বাড়িয়ে অতিরিক্ত আয় হবে ১৬১০ মিলিয়ন টাকা। এ হিসাব সঠিক নাও হতে পারে। কারণ বিনা টিকিটে ভ্রমণের বিষয়টি আয়ের হিসাব করার সময় আমলে নেওয়া হয়েছিল কি না সে সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। এ প্রবণতা রোধ না করতে পারলে হিসাবে ঘাটতি হবে। অনুমিত আয় হবে না।
ভাড়া বৃদ্ধির যুক্তির মধ্যে একটি ছিল অন্যান্য পরিবহন ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা। অর্থাৎ নদী পরিবহন ও জনপথ। এতে কোনো সমতা নেই। কিন্তু এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টি হিসাবে নেওয়া হয়নি তা হলো- এ দুই ব্যবস্থার প্রায় শতভাগ বেসরকারি খাতের ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিচালিত। সময়ের বিবর্তনে রেল খাত জনপথ খাতের তুলনায় অনেক বেশি অবহেলিত। যাত্রীসহ মালামাল পরিবহনে সিংহভাগ জনমানুষ জনপথকে অগ্রাধিকার দেয়। এ খাতের পরিবহন ব্যয় রেলওয়ের তুলনায় অধিকতর হলেও অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। মূল কারণ, পরিবহনে সময় অনেক কম প্রয়োজন হয়। এ ছাড়া সময়মতো যাওয়া বা মালামাল পাওয়ায় কোনো অনিশ্চয়তা নেই। এর ব্যতিক্রম হয় ফেরি ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার জন্য অথবা চিরাচরিত ট্রাফিক জ্যাম।
বিমানের ক্ষেত্রে অনেকটা একই ধরনের চিত্র। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক পরিবহনে বিমানের ভাড়া তুলনামূলক কম। কিন্তু অন্য এয়ারলাইন্সের পরিবহন ব্যবস্থাপনায় কালক্ষেপণ করতে হয়। বিমানের ক্ষেত্রে এটা প্রায় প্রতি সময় হয়। রেলওয়ের অনুরূপ বিমানেও উড়োজাহাজের সংখ্যা অপ্রতুল। দক্ষ বৈমানিকের সংখ্যাও প্রয়োজনের তুলনায় কম। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র থেকে কিছু উড়োজাহাজ সংগ্রহ করা হয়েছে। সব কয়টি এখনো পাওয়া যায়নি। নতুন ও উন্নত ধরনের উড়োজাহাজ পরিচালনার জন্য বিদ্যমান বৈমানিকদের নতুনভাবে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক। যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য এ প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। প্রশিক্ষণে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনে ব্যর্থ হলেই সমস্যা। উড়োজাহাজ আছে, অথচ দক্ষ ও নির্ভরযোগ্য বৈমানিক নেই। নতুন যে কয়টি উড়োজাহাজ সংগ্রহ করা হবে, তা পরিচালনার জন্য কতজন বৈমানিক প্রশিক্ষণের পরীক্ষায় সফল হয়েছেন, তার হিসাব কেউ জানে না। তবে বিমানব্যবস্থাপনা জানতে পারে। রেলওয়ের বা অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো বিমানেও কি নিরপেক্ষভাবে মেধাভিত্তিক বৈমানিক নিয়োগ করা হয়? প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে শোনা গিয়েছিল, কিছু বৈমানিক এ বিষয়টি সমর্থন করে না।
গত ২০০৯ সালে বিমানকে একটি কম্পানি হিসেবে রূপান্তরিত করা হয়েছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল প্রতিষ্ঠানটি বেসরকারি সংস্থার মতো দক্ষ ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে সক্ষম হবে। কিন্তু তা হয়নি। ২০০৯ সালের পর বিমান কেবল এক বছর লাভজনক ছিল। কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাঁটাইও হয়েছিল। ব্যয়ভার হ্রাস করাই ছিল উদ্দেশ্য। জানা যায়, সে পদক্ষেপও সফল হয়নি। কয়েক বছর ধরেই যে চিত্র দৃশ্যমান, তা হলো- বিমান মাটিতে বসে গেছে। অথচ এর পরিচালনা পরিষদে কয়েকজন সচিব রয়েছেন। পরিষদের চেয়ারম্যান বিমান বাহিনীর একজন সাবেক প্রধান। এ বছর বিমানের ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতার দায়িত্ব কে স্বীকার করবে? রেলওয়ের মতো যাত্রীরাও কয়েক দিন আগে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে বিক্ষোভ করেছেন। কিছু ভাঙচুরও হয়তো হয়েছে। এতে কি সমস্যার কোনো সমাধান হবে? সরকারি নীতিনির্ধারকরা এ বিষয়ে নিশ্চুপ কেন?
গত ২৫ সেপ্টেম্বরের প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী জানা যায় যে আরো দুইটি উড়োজাহাজ যুক্ত হবে বিমানবহরে। আশা করা যায়, বিমানের পরিবহন ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। তবে এর মধ্যে বিমানের একটি নিজস্ব এয়ারবাস- যা সিঙ্গাপুরে বছর ধরে আটকা ছিল, সেটি চলে এলে অবস্থার আরো উন্নতি হবে। সংবাদে বলা হয়েছে, বিমানমন্ত্রী হজ ফ্লাইট পরিচালনায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। কিন্তু যাত্রীরা যে সন্তুষ্ট নয় সে বিষয়টিও ভাবা দরকার। দীর্ঘ এক বছর বিদেশে কেন একটি উড়োজাহাজ বসে থাকবে- তার কোনো বিস্তারিত ব্যাখ্যা এখনো পাওয়া যায়নি। দেশে আসার পর যে উড়োজাহাজটি আবার অচল হবে না তারই বা নিশ্চয়তা কী? সার্বিকভাবে সরকার নিয়ন্ত্রিত বিমান সংস্থায় গতিশীল ব্যবস্থাপনার বড়ই অভাব। কোনরকমে কিছু বিমানের চলাচলব্যবস্থা চালু আছে। হজের সময় বিদেশ থেকে লিজে উড়োজাহাজ প্রায় প্রতিবছরই আনতে হবে কেন?
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.