বীর মুক্তিযোদ্ধা- তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না

৫৩৩ স্বাধীনতার চার দশক উপলক্ষে খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ধারাবাহিক এই আয়োজন। এম সদর উদ্দিন, বীর প্রতীকস হসী এক অধিনায়ক  মুক্তিযুদ্ধকালে অমরখানা ও জগদলহাটে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী ছিল মুখোমুখি অবস্থানে।


জুলাই মাস থেকে প্রায় দিন এখানে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। কখনো পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের, কখনো মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ করতেন। তখন দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হতো। তবে কেউ কাউকে নিজেদের অবস্থান থেকে সরাতে পারেনি। এভাবে যুদ্ধ চলে নভেম্বর মাসের প্রথমার্ধ পর্যন্ত।
এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি বৃদ্ধি হয়। তখন এম সদর উদ্দিনের নেতৃত্বে এক দল (প্রায় তিন কোম্পানি) মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি অবস্থানে চূড়ান্ত আক্রমণের প্রস্তুতি নেন। ২২ নভেম্বর রাতে তাঁরা সমবেত হন চাওয়াই নদীর পূর্ব তীরে। রাত দুইটায় তাঁরা আক্রমণ চালান। এমন আক্রমণের জন্য পাকিস্তানিরা প্রস্তুতই ছিল। সঙ্গে সঙ্গে গর্জে ওঠে তাদের আর্টিলারি। শুরু হয় নিরাপদ বাংকার থেকে অবিরাম গুলিবর্ষণ।
এম সদর উদ্দিনের নেতৃতে মুক্তিযোদ্ধারা অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তানি প্রতিরক্ষার মধ্যে ঢুকে পড়েন। এক নাগাড়ে দুই-আড়াই ঘণ্টা ধরে চলে যুদ্ধের তাণ্ডবলীলা। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল আক্রমণের মুখে পাকিস্তানিরা অমরখানা থেকে জগদলহাটে পালিয়ে যায়। ভোরের আগেই মুক্ত হয়ে যায় অমরখানা।
পঞ্চগড় জেলার উত্তর দিকে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে অমরখানা। এর দক্ষিণে তালমা নদীর পাড়ে জগদলহাট। পঞ্চগড়-তেঁতুলিয়া সড়ক এর পাশ দিয়ে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী অমরখানা এবং জগদলহাটে ঘাঁটি স্থাপন করে। এ এলাকা ছিল মুক্তিবাহিনীর ৬ নম্বর সেক্টরের ভজনপুর সাব-সেক্টরের অধীন।
অমরখানা দখলের পর মুক্তিযোদ্ধারা প্রস্তুতি নেন জগদলহাট আক্রমণের। সেখানে তাঁরা আক্রমণ চালান। এ যুদ্ধে রিইনফোর্সমেন্ট হিসেবে অংশ নেন মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব আলম। তিনি তাঁর বইয়ে লিখেছেন, ‘সকাল নটার দিকে এলেন সদরুদ্দিন সাহেব। একটা জিপে চড়ে। চোখ লাল। অবিন্যস্ত অগোছালো চেহারা। কাঁধে স্টেনগান। বোঝাই যায় সারা রাত ঘুমাননি। ফ্রন্ট আর রেয়ার, সম্ভবত এই নিয়েই কেটেছে তাঁর সারা রাত।
‘...পাক বাহিনী প্রায় ছয় মাস অনেকটা সুইসাইড স্কোয়াডের মতো মাটি কামড়ে পড়ে ছিল এ জায়গাটায় (অমরখানা)। আক্রমণ প্রতি-আক্রমণে মুখর ছিল জায়গাটা। বিচ্ছিন্নভাবে বহুবার আক্রমণ করা হয়েছে। কিন্তু তাদের সরানো যায়নি। কখনো এখান থেকে উন্মত্ত হাতির মতো একরোখা ভঙ্গিতে পাক বাহিনী এগিয়ে গেছে ভজনপুর-দেবনগর মুক্তিফৌজের অবস্থানের দিকে। কখনো অমরখানায় ভারতীয় অবস্থানের দিকে।...শতসহস্র কামান-মর্টারের গোলা বর্ষিত হয়েছে তাদের ওপর। এর মধ্যেও টিকে ছিল ওরা।’
এম সদর উদ্দিন চাকরি করতেন পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে। ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন ঢাকা এয়ার বেসে। তখন তাঁর পদবি ছিল স্কোয়াড্রন লিডার। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে যুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য সুযোগ খুঁজতে থাকেন। ঢাকা বেসে কর্মরত আরও কয়েকজনের সঙ্গে ১০ মে পালিয়ে যান। ১৪ মে ভারতে গিয়ে যুদ্ধে যোগ দেন। পরে তাঁকে ভজনপুর সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
স্থলযুদ্ধের অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও এম সদর উদ্দিন অত্যন্ত বিচক্ষণতা, দক্ষতা ও সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে মোকাবিলা করেন। তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা অ্যামবুশ, রেইড, ডিমোলিশন, আকস্মিক আক্রমণসহ নানা ধরনের অপারেশন করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে বিপর্যস্ত করতে সক্ষম হন। কয়েকটি বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে তিনি বেশ খ্যাতি পান।
মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্ব প্রদর্শনের জন্য এম সদর উদ্দিনকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৩ সালের গেজেট অনুযায়ী তাঁর বীরত্বভূষণ নম্বর ২৭৯।
এম সদর উদ্দিন স্বাধীনতার পর পর্যায়ক্রমে এয়ার ভাইস মার্শাল পদে উন্নীত হন এবং বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে অবসর নেন। বর্তমানে তিনি বিদেশে বসবাস করেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ি নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলার বাইরপাড়া গ্রামে। বাবার নাম সাদাত হোসেন, মা আবেদা আকতার। স্ত্রী নাসরিন জাহান। তাঁদের এক মেয়ে, দুই ছেলে।
সূত্র: মেজর (অব.) ওয়াকার হাসান, বীর প্রতীক, গেরিলা থেকে সম্মুখযুদ্ধে, মাহবুব আলম এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ৬।
গ্রন্থনা: রাশেদুর রহমান
ৎashedtৎ@pৎothom-alo.info

No comments

Powered by Blogger.