সিলেটে সড়ক দুর্ঘটনা-মৃত্যুর এই মিছিল থামাতেই হবে

কথায় বলে, কারো কারো জন্য নাকি 'সাত খুন মাফ'। আমাদের দেশের গাড়িচালকদের জন্য কথাটা সম্ভবত খেটে যায়। আর তাইতো সড়ক দুর্ঘটনার নামে প্রতিদিন চলে মানুষ খুনের মহোৎসব। গত শুক্রবার ভোরেও তেমনি একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটেছে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে।


সিলেটের দক্ষিণ সুরমার তেতলি নামক স্থানে একটি যাত্রীবাহী বাস গুঁড়িয়ে দিয়েছে এক মাইক্রোবাসকে। নিহত হয়েছেন মাইক্রোবাসের চালকসহ ১৩ আরোহী। তাঁদের ৯ জন একই পরিবারের। বাকিরাও নিহতদের স্বজন। বাসেরও অনেক যাত্রী আহত হয়েছেন। আর যথারীতি বাসের চালক পালিয়ে গেছে। এর কারণ, অনেক বলার পরও এ দেশে চালকদের জন্য নির্ধারিত কোনো পোশাকের ব্যবস্থা করা যায়নি। ফলে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে তারা দিব্যি সটকে পড়তে পারে।
সড়কে এ মৃত্যুর মিছিল আমরা আর কত দেখব? ২০১১ সালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মিরসরাইয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪৮ শিক্ষার্থীকে আমরা হারিয়েছি। কিছুদিন আগে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের দুই তারকা তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরকে হারিয়েছি। এমন কত হৃদয়বিদারক দুর্ঘটনা তো অহরহই ঘটে চলেছে। অথচ এই দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর কোনো উদ্যোগই নেওয়া হচ্ছে না। ফলে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের হিসাব অনুযায়ী, বছরে ১২ হাজারের বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনায়। একই ইনস্টিটিউটের আরেক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ সালে দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সাত হাজার কোটি টাকারও বেশি। অথচ ২০০২ সালে তা ছিল তিন হাজার ৯০০ কোটি এবং ২০০৬ সালে পাঁচ হাজার ১৭৬ কোটি টাকা। গত দুই বছরে এই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিঃসন্দেহে আরো অনেক বেড়েছে।
বিভিন্ন সময়ে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, অর্ধেকেরও বেশি গাড়িচালকের কোনো বৈধ লাইসেন্স নেই। গত শুক্রবার যোগাযোগমন্ত্রী ঢাকার কেরানীগঞ্জে নিজেই এক বাসচালককে ধরেছেন, যার কোনো লাইসেন্সই নেই। অথচ তারা রাস্তায় দিব্যি গাড়ি চালাচ্ছে। যাঁদের এসব দেখার কথা, তাঁরা দেখেন না। আর যাদের লাইসেন্স আছে, তাদেরও প্রায় ৮০ শতাংশ অনুমোদিত কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে চালক হিসেবে প্রশিক্ষণ নেয়নি, অন্য কোনো চালকের কাছ থেকে কোনোরকমে স্টিয়ারিং ধরা শিখেছে মাত্র। আর বৈধ লাইসেন্স! এটি প্রায় ওপেন সিক্রেট, কিছু টাকা খরচ করলে তাও অনায়াসেই পাওয়া যায়। অথচ দিব্যি এরাই সারা দেশের সড়কগুলো দাবড়ে বেড়াচ্ছে। প্রশাসনের অনিয়ম ও অব্যবস্থাই তাদের বেপরোয়া হওয়ার শক্তি জোগাচ্ছে। সিলেটের দুর্ঘটনার ব্যাপারে স্থানীয় মেট্রোপলিটান পুলিশের কমিশনার নিজেই সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, দুর্ঘটনার স্থান দেখে বোঝা যায়, বাসটি 'রং সাইড'-এ এসে মাইক্রোবাসটিকে চাপা দিয়েছে।
আর আইনের প্রয়োগ? ২০০৩ সালে চট্টগ্রামেরই আরেকটি দুর্ঘটনা সারা দেশকে কাঁদিয়েছিল। হিউম্যান হলারের ধাক্কায় ১১ কিশোর ক্রিকেটার মারা গিয়েছিল দুর্ঘটনায়। বিচারে ঘাতক সেই চালকের মাত্র তিন বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। তাও তাকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। মিরসরাইয়ের ঘটনায়ও লাইসেন্সহীন চালকের মাত্র পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। কারণ, এর ওপরে শাস্তির বিধান নেই। ব্রিটিশ আমল থেকে বিদ্যমান আইনটি আশির দশকে সংশোধন করে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছিল। কিন্তু প্রভাবশালী বাস-ট্রাক মালিক সমিতি এবং 'প্রগতিশীল' শ্রমিক নেতাদের চাপে শেষ পর্যন্ত এই সাজা কমিয়ে পুনরায় তিন বছর করা হয়। এই প্রভাবশালী শ্রমিক নেতারা কি সিলেটের সেই পরিবারটির কথা কিংবা প্রতিবছর নিহত হওয়া ১২ হাজার মানুষ ও তাদের পরিবারের অসহায়ত্বের কথা ভেবে দেখেছেন? আমরা এমন অন্তহীন মৃত্যুর মিছিল আর দেখতে চাই না। আমরা সড়কে শৃঙ্খলা চাই। যথাযথ আইন এবং এর বাস্তবায়ন চাই।

No comments

Powered by Blogger.