পাকিস্তান-ইমরান খানের গন্তব্য ওয়াজিরিস্তান by আহমদ জামান চৌধুরী

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ন্যাটোভুক্ত যৌথ বাহিনী, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশপুঞ্জ, আফগানিস্তান, ভারত এবং পাকিস্তান তো বটেই_ এসব রাষ্ট্রের সাবধানী নজর থাকবে এক আলোচিত ও বিতর্কিত পাকিস্তানি রাজনীতিবিদের দিকে।


বর্তমান দুনিয়ার পশ্চিমা চালকদের কাছে বড় হয়ে ওঠা 'সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের' বিপজ্জনক একটি কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখোয়া (সাবেক উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত) প্রদেশের ওয়াজিরিস্তান এলাকায় গতকাল শনিবার প্রায় ১ লাখ মানুষের শান্তিযাত্রা (পিস মার্চ) নিয়ে প্রবেশ করার কথা সেই রাজনীতিবিদের। এ রাজনীতিবিদ আর কেউ নন_ ইমরান খান। কিংবদন্তি ক্রিকেটার থেকে রূপান্তরিত রাজনীতিবিদ। তিনি পাকিস্তানে তালেবানদের অন্যতম ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে যাচ্ছেন। তার এ শান্তিযাত্রার বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে হুশিয়ারি সংকেত দিয়েছে পাকিস্তানের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো ও সরকার। তাদের বক্তব্য, কিছুকাল আগেই যেহেতু ইমরান খানকে তালেবানরা মৃত্যু হুমকি দিয়েছে তাই ওই অঞ্চলে ইমরান খানের শান্তিযাত্রাকে তারা সমর্থন দিতে পারেন না।
কিন্তু ইমরান খান অনড়। তিনি বলেছেন, 'মৃত্যু হুমকির পরোয়া আমি করি না। আমি যাবই ওয়াজিরিস্তানে_ সেখান থেকে আজকের পাকিস্তানে যাবতীয় উগ্রবাদী সন্ত্রাসের জন্ম হচ্ছে।'
এমনই যখন পাকিস্তানের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থি্থতি, তখন সে দেশের গণমাধ্যমও সোচ্চার হয়ে উঠেছে। তারই একটি বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে পাকিস্তানের জনপ্রিয় জিও নিউজের প্রোগ্রাম 'ক্যাপিটাল টক' টক শোতে। টক শোটি পরিকল্পনা ও পরিচালনা করেন সাংবাদিক হামিদ মির, যিনি বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য পাঠক-শ্রোতার কাছেও পরিচিত।
হামিদ মিরের বৃহস্পতিবারের টক শোতে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তিনজন_ সাবেক মার্কিন কূটনীতিবিদ মেরি অ্যান রাইট, ব্রিটিশ সাংবাদিক লরেন বুথ এবং ইমরান খান। দু'জন পশ্চিমা নারীকে নিয়ে ইমরান খানের শান্তিযাত্রার প্রাক্কালে টিভি শোতে যাত্রার উদ্দেশ্য সম্পর্কে অ্যান রাইট বলেন, 'যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে যা করছে তা সন্ত্রাস আরও বাড়াচ্ছে_ এটাই আমরা যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যসহ তামাম দুনিয়াকে জানাতে চাই।'
টিভি শোতে আসার আগে মেরি অ্যান রাইট এবং লরেন বুথ গিয়েছিলেন ইসলামাবাদে পাকিস্তানের সামরিক একাডেমীতে। তারা একাডেমীর সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনায় বুঝতে পারেন, তারা কেউই পাকিস্তান ও আফগানিস্তান সীমান্ত এলাকায় চালকবিহীন ড্রোন বিমান হামলা কোনোভাবেই পছন্দ করেন না।
পশ্চিমা কূটনীতিক-সাংবাদিকরা এরপর পাকিস্তানে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসে গেলে তারা তাদের ওয়াজিরিস্তানে যেতে নিষেধ করে এবং বলে, ওয়াজিরিস্তান ও সেখানকার দুর্গম পাহাড়ি গুহাখাদ থেকে পাকিস্তানি তালেবানদের অভিযানের নকশা তৈরি হয়।
কিন্তু তারা সাবধানবার্তা শোনেননি এবং এ জন্যই তারা ইমরান খানের শান্তিযাত্রায় শামিল হয়েছেন।
তালেবান শব্দটির অর্থ শিক্ষার্থী। দেড়-দুই দশক আগে আফগানিস্তান থেকে ছড়িয়ে পড়ার পর তালেবান সংস্কৃতি ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে ওসামা বিন লাদেনের আল কায়দার দর্শন নিয়ে পাশাপাশি ছড়িয়ে পড়ে সারা দুনিয়ার মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে। এমনই পরিপ্রেক্ষিতে ইতিমধ্যে ২০০১-এর টুইন টাওয়ারসহ অনেক ঘটনা ঘটেছে। তালেবানদের মূল কেন্দ্র আফগানিস্তান। কিন্তু সনি্নহিত সীমান্ত অঞ্চল, মুসলমান এবং জাতিগতভাবে পশতুন হওয়ার কারণে পাকিস্তানের উত্তর ও দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে তালেবানদের একটি অংশ ছড়িয়ে পড়ে। এই ছড়িয়ে পড়া অংশের ওপরই পাক-আফগান সীমান্ত এলাকায় ড্রোন হামলা শুরু হয়। ড্রোন হামলা ইতিমধ্যে এই যুগের মানবতাবিরোধী হামলায় পরিণত হয়েছে, যা নিয়ে আমেরিকার জনগণসহ পৃথিবীর বহু দেশ সোচ্চার হয়ে উঠেছে।
পাকিস্তানের জিও টিভি নিউজের অনুষ্ঠানে সে কারণেই আমেরিকার সাবেক কূটনীতিবিদ মানবাধিকার কর্মী মেরি অ্যান রাইট বলেছেন, এখানে আসার আগে পাকিস্তানের আমেরিকান দূতাবাস বলেছে, ওয়াজিরিস্তান বিপজ্জনক এলাকা। আমি এমবাসিওয়ালাদের বলেছি, আমি মার্কিন নাগরিক হিসেবে দেখতে চাই, একটি দেশের একটি অঞ্চলকে তোমরা কতটা বিপজ্জনক বানিয়েছ। ইমরান খানের এই শান্তিযাত্রার বিরুদ্ধে পাকিস্তানের ইমরানবিরোধী মহল খুবই সোচ্চার। তারা বলছে, এটি ইমরান খানের 'ড্রামাবাজি' বা নাটুকেপনা। এর উত্তরে ইমরান বলেন, 'ঠিক আছে, আমি নাটক করার জন্য ওয়াজিরিস্তান যাচ্ছি। তো এই নাটক তারাও করে দেখাক না।'
হামিদ মিরের টিভি শোতে সবশেষে জিজ্ঞাসা করা হয়, বুঝলাম আপনি এক লাখ মানুষ, এই দুই সাংবাদিক এবং আরও প্রায় একশ' পশ্চিমা মিডিয়াকর্মী নিয়ে ওয়াজিরিস্তানে যাচ্ছেন_ তো আপনারা কি নিরাপদ বোধ করছেন?
ইমরান খান বলেন, আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানে যা-ই হচ্ছে তার জন্য আমেরিকাই মূলত দায়ী। আমি সেই দায় থেকে মুক্ত হয়ে ড্রোন হামলায় যাতে নিষ্পাপ মানুষ মারা না যায়, সেটাই দুনিয়াকে জানাতে যাচ্ছি।

আহমদ জামান চৌধুরী : সাংবাদিক
 

No comments

Powered by Blogger.