আরএসওর সঙ্গে কয়েকটি এনজিওর সংশ্লিষ্টতা আছে! by পারভেজ খান ও তোফায়েল আহমেদ

কক্সবাজারের রামুর বৌদ্ধপল্লীর ভয়াল ঘটনায় রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনসহ (আরএসও) কয়েকটি এনজিওর সংশ্লিষ্টতা নিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। এরই মধ্যে তদন্তে তাদের সংশ্লিষ্টতার অনেক তথ্য পেয়েছে তদন্ত কমিটি।


তদন্ত কর্মকর্তাদের মতে, গত ২৯ ও ৩০ সেপ্টেম্বরের বৌদ্ধপল্লীর নারকীয় হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার নেপথ্যে আর্থিক লেনদেন হয়েছে। আর এসব কাজ করেছে ওই সব বেসরকারি সংস্থা। তাদের এই অর্থায়ন ছাড়া এ ধরনের পরিকল্পিত নারকীয় ঘটনা ঘটতে পারে না। পাশাপাশি বৌদ্ধপল্লীতে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার সময় কক্সবাজারে আরএসও নেতাদের তৎপরতা ছিল বলেও অভিযোগ উঠেছে। এমনকি সাগরপাড়ের একটি বিলাসবহুল হোটেলে সংগঠনটির নেতারা কয়েক সপ্তাহ ধরে ডেরা গেড়ে একের পর এক বৈঠক করেছেন বলেও নিশ্চিত হয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। সর্বশেষ গত সোমবার সকালেও ওই হোটেলে আরএসও নেতারা সকালে নাশতা করেছেন বলে তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছে খবর আছে। তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
তদন্ত সূত্রগুলো জানায়, কারা এসব ঘটনা ঘটিয়েছে, কারা অর্থায়ন করেছে- এর অনেকটাই এখন প্রায় স্পষ্ট। অনেক নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে। আর ঘটনার কারণ সম্পর্কেও বেরিয়ে আসছে চমকে ওঠার মতো নানা তথ্য। এনজিওগুলো একটি বিশেষ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ব্যবহার করেছে স্থানীয় নেতা-কর্মী আর ধর্মান্ধদের। আর টাকার মোহে দলীয় আদর্শ ভুলে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতসংশ্লিষ্ট কিছু লোক মিলে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন একজন সংসদ সদস্যও। আরো অবাক হওয়ার বিষয়, এ ঘটনার সঙ্গে স্থানীয় রামু থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এ কে নজিবুল ইসলামের সম্পৃক্ততার খবর মিলেছে। আর খবরের ভিত্তিতে তাঁকে গত শুক্রবার মধ্য রাত থেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। অবশ্য এর আগেই গত ৩ অক্টোবর তাঁকে থানার দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছিল। এ ছাড়া পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ উঠেছে। ওই কর্মকর্তা দেড় বছর ধরে কক্সবাজারে আছেন। এ ঘটনায় জড়িত হিসেবে কক্সবাজারের কলাতলী আদর্শ গ্রামের ছালামতুল্লাহ নামের একসময়ের একজন মাদ্রাসাশিক্ষকের নামও এসেছে। তিনি আরএসওর সাবেক সাধারণ সম্পাদক।
গতকাল এ ঘটনায় সরকার গঠিত তদন্ত কমিটি বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তাঁদের মধ্যে একজন সাংবাদিকও রয়েছেন।
তদন্ত কমিটির প্রধান চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার নুরুল ইসলাম গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁদের কাছে মনে হচ্ছে, ঘটনাটি পরিকল্পিত। এ ছাড়া গোয়েন্দারা কেন এ ধরনের একটি ঘটনার ব্যাপারে আগাম কোনো তথ্য পায়নি, সেটাও গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।
গোয়েন্দা ও তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, রোহিঙ্গা সংগঠনটি মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশের অর্থানুকূল্য পেয়ে সীমান্ত এলাকাকে অস্থিতিশীল করে তোলার কাজে জড়িত রয়েছে কি না, সেটা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে স্থানীয় জনগণ। এ ঘটনাকে প্রাথমিকভাবে একটি ভয়াবহ ঘটনার আগাম সংকেত হিসেবে দেখছেন তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
নাইক্ষ্যংছড়ি-গর্জনিয়া থেকে আসা লোকজনদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে : গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে নাইক্ষ্যংছড়ি ও পাশের গর্জনিয়া-কচ্ছপিয়া এলাকা থেকে এসে রামুর বৌদ্ধপল্লীতে হামলাকারীদের জিজ্ঞাসাবাদের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। তদন্তদলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ওই রাতে রামুতে এসে নিজেদের বাড়িঘরে ফিরে যাওয়ার সময় ভোর রাতে বিজিবি সদস্যদের হাতে ৩৭ জন আটক হয়েছিল। তাদের মধ্যে রাসেল নামের একজন ছাত্রলীগ নেতাসহ চারজনকে ছেড়ে দিয়ে বাকি ৩৩ জনকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। নাইক্ষ্যংছড়ি থানার পুলিশের এ ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতার সুপারিশে রাসেলকে ছেড়ে দেওয়া হয়। আরো অভিযোগ উঠেছে, গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় যে অভিযোগ আনা হয়েছে, সেখানেও প্রচুর ফাঁকফোকর রাখা হয়েছে। তাদের গ্রেপ্তার করা হয় অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর রামু থেকে নাইক্ষ্যংছড়িতে ফিরে যাওয়ার পথে। অথচ থানার মামলায় উল্লেখ রয়েছে, তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে রামু যাওয়ার পথে। গ্রেপ্তার হয়ে ছাড়া পাওয়াদের মধ্যে মনজুর নামের একজন পরিবহন শ্রমিক গতকাল কালের কণ্ঠকে জানান, রামু থেকে ফেরার পথে তাঁদের ধরা হয়েছিল। এ ব্যাপারে নাইক্ষ্যংছড়ি থানার ওসি এ এস এম আজাদ গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এটি অনিচ্ছাকৃত ভুল। আমি ঘুম থেকে উঠে বিজিবির একজন কর্মকর্তার ফোনে শুনে আটককৃতদের ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে মামলাটি রুজু করি। আমার শোনায় কোনো ভুলও হয়ে থাকতে পারে। এটি সংশোধন করে দেওয়া হবে।' ওসি এভাবে তাঁর ভুলের ব্যাখ্যা দিলেও থানার অন্য সূত্র মতে, আসামিদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে এটি করা হয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, গর্জনিয়া থেকে কক্স লাইন পরিবহনের একটি মিনিবাসে করে রামুতে আসা লোকজনদের বেশির ভাগই স্থানীয় বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মী। তাঁদের মধ্যে সৈয়দ আলম, সরোয়ার, আবদুশ শুকুরসহ আরো কয়েকজন রয়েছেন। এ ছাড়া নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যানের কয়েকজন আত্মীয়ও সেই রাতে রামুর ঘটনায় অংশ নিয়ে এখন গা-ঢাকা দিয়েছেন।
পলাতক বিএনপি-জামায়াতের অর্ধশতাধিক নেতা-কর্মী : রামুর সহিংসতায় জড়িত বিএনপি-জামায়াতের অর্ধশতাধিক নেতা-কর্মী আত্মগোপন করেছেন। গ্রেপ্তার এড়াতে তাঁদের বেশির ভাগই এখন মোবাইল ফোনও বন্ধ করে রেখেছেন। কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, ঘটনার রাতে কক্সবাজার শহরের ভোলাবাবুর পেট্রল পাম্পসংলগ্ন এলাকায় কর্মী বাহিনী নিয়ে অবস্থান নেওয়া জেলা জামায়াতের প্রচার সম্পাদক আবু হেনা মোস্তফা কামাল, শিবিরের সাবেক নেতা ও কক্সবাজার সরকারি কলেজের সাবেক ভিপি শহিদুল আলম বাহাদুর, শহরের পাহাড়তলী এলাকার শিবির ক্যাডার শেখ সেলিম, বাসটার্মিনাল এলাকার জামায়াতকর্মী মনিরসহ অর্ধশতাধিক নেতা-কর্মী এখন আত্মগোপনে। তাঁদের মধ্যে শহিদুল আলম বাহাদুর তাঁর বাহিনী নিয়ে রামু কলেজ গেট এবং বাইপাস মোড়ে দমকল ও পুলিশের গাড়ি আটকে দিয়েছিলেন। তাঁরা হামলা চালিয়েছিলেন রামুর শ্রীকুলের লালচিং ও সাদাচিং বৌদ্ধবিহারে। রামুর বিভিন্ন এলাকা থেকে মাদ্রাসাছাত্র ও রোহিঙ্গাদের খবর দিয়ে নিয়ে আসার হোতা রামুর জোয়ারিয়ানালা মাদ্রাসার শিক্ষক হাফেজ আবদুল হক গত রবিবার থেকে পলাতক। কক্সবাজার কেন্দ্রীয় বাসটার্মিনাল থেকে জে কে এন্টারপ্রাইজের ট্রাক ভাড়া নেওয়ার হোতা স্থানীয় জামায়াত নেতা মনিরও পলাতক। টার্মিনালের পাশে লারপাড়া এলাকায় তাঁর বাসায় গিয়েও তাঁকে পাওয়া যায়নি। আত্মগোপনে রয়েছেন ইসলামী ঐক্যজোটের জেলা পর্যায়ের একজন বিতর্কিত নেতাসহ এক ডজন নেতা-কর্মী। এমনকি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িতদের কয়েকজনও এ ঘটনার পর থেকে পলাতক। তাঁদের কয়েকজন হলেন রামুর সাদ্দাম, আনসারুল হক ভুট্টো, হাফেজ আহমদ, জিন বাবু, আজিজুল হক প্রমুখ। বিএনপির দুই জনপ্রতিনিধি মিজান উদ্দিন মেম্বার ও কামাল উদ্দিনসহ আরো কয়েকজন ঘটনার পর থেকে গা-ঢাকা দিয়েছেন।
রামুর সেই কম্পিউটার দোকানের মালিকসহ আটক ৩ : বৌদ্ধপল্লীতে হামলার ঘটনার সূত্রপাত যে দোকানে ঘটেছে সেই কম্পিউটার কম্পোজের দোকানের মালিক ওমর ফারুক, ফতেখারকুল আমতলিয়াপাড়ার মোহাম্মদ বেলাল উদ্দিন ও জসিম উদ্দিনকে গতকাল শনিবার ভোর রাত ও সকালে আটক করেছে রামু থানার পুলিশ।
প্রতিবাদ অব্যাহত : রামুর ঘটনায় প্রতিবাদ অব্যাহত রয়েছে। গতকাল শনিবার বিকেলে উখিয়া, টেকনাফ, কক্সবাজার সদর ও রামুর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে রামুতে সম্প্রীতি সমাবেশ করেছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদারের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল এ কর্মসূচিতে অংশ নেয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নেতা ড. গাজী সালেহ উদ্দিনের নেতৃত্বে আরেকটি প্রতিনিধিদল গতকাল ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বীর বাহাদুর এমপির নেতৃত্বে ছাত্রলীগের সাবেক নেতাদের একটি দল গতকাল রামুর বৌদ্ধপল্লী পরিদর্শন করে। প্রতিনিধিদলে অন্যদের মধ্যে সাইফুজ্জামান শেখর, এনামুল হক শামীম, মাহফুজুর হায়দার চৌধুরী ও শাহজাদা মহিউদ্দিন রয়েছেন। গতকাল বিকেলে রামুতে পৃথক একটি প্রতিবাদ সভা করেছে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ। সমাবেশে স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ অন্য নেতারা বক্তব্য দেন।
বিএনপির তদন্তদলের কক্সবাজার ত্যাগ : ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের নেতৃত্বে গঠিত বিএনপির আট সদস্যের তদন্তদল গতকাল টেকনাফের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে চট্টগ্রামের পটিয়া হয়ে ঢাকায় ফিরে গেছে।

No comments

Powered by Blogger.